দেশ যতই এগিয়ে চলেছে পুরুষের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিটি কাজে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, ব্যবসাবাণিজ্য, প্রবাস, আইসিটিসহ অর্থনীতির প্রতিটা ক্ষেত্রে নারীর অবদান বাড়ছে। যেখানে নারীরা ঘরের কাজ করতেন এখন সেখানে কেউ চাকরি, কেউ ব্যবসা করছেন। উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারীর ক্ষমতায়ন হলো দেশের উন্নয়ন কাজে নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের উন্নয়নের রোল মডেল। চতুর্থ শিল্পবিল্পবের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। এজন্য কাজ করছে বিশাল জনসংখ্যা। এই বিশাল জনসংখ্যার অংশ হলো নারী ও পুরুষ। যে দেশগুলো বিশ্বে উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়াতে পেরেছে সেই সব দেশই নারীর ক্ষমতায়নের পথ সুগম করেছে। নারী ও পুরুষের পাশাপাশি অবদানেই এগিয়ে চলেছে। একসময় যে ক্ষেত্রগুলোতে নারীর অংশগ্রহণ চিন্তা করা যেত না অথবা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যেত সেই ক্ষেত্রগুলো এখন মুক্ত। ফলে নারীরা স্বাধীনভাবে এসব ক্ষেত্রে অংশ নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন।
গত কয়েক বছরে অনেক বদলে গেছে বাংলাদেশ। এই সময়ে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংসার পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে তারা চাকরি না হয় ব্যবসা করছে। এখন গ্রামে প্রায়ই ছোটোখাটো দোকান চালাতে দেখা যায় নারীদের। পশুপালনেও রয়েছে নারীর অবদান। গ্রামের অধিকাংশ নারীই এখন পশু পালনের সঙ্গে যুক্ত। কেউ কেউ আবার পশু পালনকে ব্যবসা হিসেবে গ্রহণ করছেন।
দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে ঘরে বসে আজ ই-কমার্সের যুগে নারীরা ব্যবসা করছেন। ২০১০ সালে যেখানে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা ছিল ১৬ দশমিক ২ লাখ সেখানে ২০১৬-১৭ সালে এসে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬ লাখ। এই সময়ের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে।
শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশের ১ কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের প্রায় ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী, যারা মূলত কৃষিকাজ, পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছচাষ ইত্যাদি কৃষিসংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত। সেখানে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন রকম নির্যাতনের শিকার হয়ে তাদের অনেকে দেশে ফিরে আসছে। কিন্তু এরপরও বহু নারী প্রবাসে শত কষ্ট সহ্য করেও গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাচ্ছে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যে, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে মোট ৯ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৬ জন নারী প্রবাসে কাজ করতে গেছেন। বাংলাদেশের এখন যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি এর পেছনে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদান রয়েছে।
নারীর কাজের ক্ষেত্র এখন সীমাবদ্ধ নেই। বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম বড় ক্ষেত্র পোশাক শিল্পে একটি বিপুলসংখ্যক নারী কাজ করছেন। শহরে কর্মজীবী নারীর সঙ্গে গ্রামীণ নারীরাও। হাতের কাজ যেমন- নকশিকাঁথা বোনা, বাঁশ ও বেতের কাজ ছাড়াও নানা হস্তশিল্প, হাঁস-মুরগির খামার, গাভি পালন, পাখি ও কবুতরের খামার, কৃষিকাজ ইত্যাদি নানাভাবে সংসারের আর্থিক অবস্থা পুনর্গঠনে সাহায্য করছে এবং কোনো কোনো সংসারে আর্থিক আয়ে নারীই প্রধান ভূমিকা পালন করছে। কাজের জন্য নারীরা বিদেশে যাচ্ছেন। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী কৃষিকাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
অন্যদিকে দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে নারীদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ তৈরি করে নিতে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। নারীদের কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে। তবে কাজের ক্ষেত্র বাড়লেও কমেনি নারীর ওপর সহিংসতার হার। বরং দিন দিন সহিংসতার নতুন নতুন ঘৃণ্য রূপ সমাজকে প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। যে সহিংসতা থেকে বাদ পড়ছে না তিন থেকে ত্রিশ বা তদূর্ধ্ব বয়সি নারীরা। তাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে, কুপিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখা হচ্ছে, বাসে ট্রামে গণধর্ষণ শেষে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এত সব করেও নারীরা আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রার সমান অংশীদার। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অর্ধেক শক্তি। নারীশক্তি বাদ দিয়ে দেশের অগ্রযাত্রা অসম্ভব।
২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দেশে ১ হাজার ১৫৪ জন নারীর যৌতুকের আগুনে জীবন বিনষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে ২০১২ সালে ১৯৭ জন, ২০১৩ সালে ২৪৫ জন, ২০১৪ সালে ২৩৬ জন, ২০১৫ সালে ২০৩ জন, ২০১৬ সালে ১৭৩ জন নারীর জীবন যৌতুকের আগুনে ধ্বংস হয়েছে। মূলত বাল্যবিয়ে এবং যৌতুক নামক এক ভয়ংকর প্রাচীন কিন্তু আধুনিক জীবনের আদিমতা থেকে আজো বের হতে পারেনি এ বিশ্ব। কারণ কেবল বাংলাদেশ নয়, ভারত, পাকিস্তানসহ অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের প্রধান বাধা এই বাল্যবিয়ে এবং যৌতুক প্রথা।
নারীর মেধা এবং পারদর্শিতার স্বীকৃতি দিতে কার্পণ্য করা ব্যক্তির এ সমাজে অভাব নেই। অধিকার ফলানোতেই যেন তাদের আনন্দ সীমাবদ্ধ। বাল্যবিয়ে, যৌতুক, ধর্ষণ, রাস্তাঘাটে যৌন হয়রানি, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে নিগ্রহ, পরিবারে অনিশ্চয়তা সবকিছু মিলিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রই যেন নারীদের জন্য ভয়ংকর হয়ে উঠছে।
এদিকে নারীদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য পুরুষদেরই এগিয়ে আসতে হবে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, পুরষেরা নারীর প্রতি যত সহনশীল হবে নারীরা ততই এগিয়ে যাবে। দয়া নয়, অধিকারের দৃষ্টিতে দেখার অভ্যাস করতে হবে নারীদের। সেই অভ্যাসটা পরিবার থেকেই তৈরি করতে হবে। পরিবারেই যদি মেয়েদের নেতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় বা কোনো পুরুষ সদস্যের সঙ্গে তুলনায় খাটো করা হয় তাহলে সমাজেও তার প্রভাব পড়ে। বাসে, অফিসে, রাস্তায় সব সময় যদি নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং তাদের নিরাপত্তা পেতে আলাদা কোনো সাহায্য প্রয়োজন হবে ততদিন পার্থক্য সুস্পষ্ট থেকে যাবে।
সমাজে প্রতিটি ক্ষেত্রই নারীদের চলাচল এবং বসবাসের জন্য হবে নির্বিঘ্ন। যার নিশ্চিত পরিবেশ আমাদেরই তৈরি করতে হবে। নারীর কর্মক্ষেত্র আরো বেশি নির্বিঘ্ন করতে হবে। ২০৪১ সালে উন্নত দেশের যে লক্ষ্য নিয়ে দেশ এগিয়ে চলেছে তা পূরণ করতে হলে পুরুষের সঙ্গে নারীকেও এগিয়ে যেতে হবে।
বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে গ্রামীণ অর্থনীতির ভূমিকা অনস্বীকার্য। গ্রামীণ অর্থনীতির ওপর ভিত্তি করেই দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। সেটা প্রমাণিত হয়েছে মহামারি করোনাকালে। সংকটে যখন দেশের শিল্প, সেবা, রপ্তানি ও অন্য খাতের শোচনীয় অবস্থা সেই সময়ে গোটা জাতিকে মাতৃস্নেহে আগলে রেখে খাদ্য সংকটের সম্ভাবনাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার এক অবিশ্বাস্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কৃষি খাত।
লকডাউনের কারণে অন্য সব খাত ও প্রবাসী আয় হতে অর্থের জোগান ব্যাপক হ্রাস পায়। এ সময়ে কৃষি খাতের বর্ধিত আয়ের মাধ্যমে সে ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ হওয়ার একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে অর্থনীতির অন্যান্য খাত জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর ঋণাত্মক প্রভাব ফেলেছে, সেখানে কৃষি খাত জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতি যে বুনিয়াদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সেই বুনিয়াদকে শক্তিশালী করেছে কৃষি খাত। আর এ কৃষি খাতকে যারা সচল রেখেছে, তাদের মধ্যে ৫৩ শতাংশই নারী।
নারীরা কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত ২১টি ধাপের মধ্যে মোট ১৭টি ধাপেই কাজ করে থাকেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদন মতে, ফসলের প্রাক-বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বিপণনের সঙ্গে ৬৮ শতাংশ নারী কাজ করেন। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী কৃষিকাজে নিয়োজিত রয়েছেন। ঘরোয়া ও গ্রামীণ পরিবেশের হওয়ায় তারা সহজেই এ পেশার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারেন।
তাছাড়া বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের পুরুষরা অধিক উপার্জনের আশায় শহরকেন্দ্রিক বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হওয়ার কারণে তাদের পারিবারিক কার্যাবলি নির্বাহ করার পাশাপাশি খাদ্য ও সামগ্রিক চাহিদা পূরণের জন্য নারীদের বিভিন্ন ধরনের কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হতে হচ্ছে। পশুপালন, মৎস্য চাষ, খামার প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজে নারীরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রাখছে। তবে কৃষি খাতে প্রায় ৪৬ শতাংশ কাজই নারীরা করেন বিনামূল্যে। ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী কৃষিসংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত থাকলেও তাদের কাজের মূল্যায়ন কিংবা স্বীকৃতি সেভাবে করা হয় না। ফলে আমরা জাতীয় আয়ের যথার্থতা নিরূপণ করতে পারছি না। কৃষি থেকে প্রাপ্ত পারিবারিক আয়েও নারীদের ভাগ থাকে না। এটিকে তাদের প্রাত্যহিক ও পারিবারিক শ্রম হিসেবে গণ্য করা হয়, যার কারণে শ্রমের মজুরি দেওয়ার কথা চিন্তাই করা যায় না।
শ্রমশক্তির সংজ্ঞানুযায়ী, ২৯ শতাংশ নারীই কেবল শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। অন্যদিকে কৃষিঋণসহ সব সরকারি সুযোগ-সুবিধা অধিকাংশ নারী কৃষকরা পান না। এক্ষেত্রে নারীর নাম ব্যবহার করে পুরুষরা কৃষিঋণ তুললেও নারীদের কোনোরকম পরামর্শ তারা আমলে নেন না। আবার কখনো নারীকে পারিবারিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়। পণ্য বাজারজাতকরণের ক্ষেত্রেও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়।