রাজধানীর নিউমার্কেটে ব্যবসায়ী-শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় হেলমেট পরা চার যুবককে শনাক্ত করে নজরদারিতে রেখেছে গোয়েন্দা পুলিশ। সংঘর্ষের ঘটনায় সংগ্রহ করা বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাদের শনাক্ত করা হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ডিবি সূত্র জানায়, কুরিয়ার কর্মী নাহিদকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে রাব্বী নামে এক যুবক। সে ঢাকা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। থাকে ঢাকা কলেজের নর্থ হলে। নাহিদকে কোপানো আরেক যুবকের চেহারা স্পষ্টভাবে দেখতে পাওয়া গেলেও তার পরিচয় নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে ডিবি পুলিশ। মোরসালিনকে রামদা দিয়ে হত্যা করা যুবকের চেহারাও শনাক্ত করেছে পুলিশ। তার পরিচয় নিশ্চিত হতে তদন্ত চলছে। তবে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানিয়েছে, এদের মধ্যে একজনের নাম কাইয়ুম, অন্যজনের নাম বলতে চায়নি পুলিশ। দুজনেই ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির একজন নেতার অনুসারী। এ ছাড়া ধারালো অস্ত্র হাতে গত মঙ্গলবার রাস্তায় যাদের দেখা গেছে, তাদের মধ্যে আরো দুজনকে শনাক্ত করা গেছে। তারাও ঢাকা কলেজের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
ডিবি বলছে, নাহিদকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হেলমেটধারী এবং হেলমেট ছাড়া একাধিক ব্যক্তি কুপিয়েছেন। এর মধ্যে একজনের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। যার নাম রাব্বী।
পুলিশ সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সংঘর্ষের সময় ধারালো অস্ত্র ও হেলমেট পরে ঢাকা কলেজের যেসব শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির চার নেতার অনুসারীরা বেশি সক্রিয় ছিলেন। এর মধ্যে নাহিদ হত্যায় জড়িত ব্যক্তিরা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জসীম উদ্দিন ও নতুন কমিটিতে শীর্ষ পদপ্রত্যাশী ফিরোজ হোসেনের অনুসারী।
এ বিষয়ে জসীম উদ্দিন বলেন, ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে, তাদের তিনি চেনেন না। ঘটনার দিন পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া কাইয়ুম সম্পর্কে তিনি বলেন, কাইয়ুমকে কলেজের ছাত্রাবাসে দেখেছেন। অন্য গ্রুপের রাজনীতি করেন কাইয়ুম। তবে ছাত্রলীগের কোন নেতার অনুসারী কাইয়ুম, সেটা তিনি নিশ্চিত নন।
নাহিদকে কোপানোর ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের একজন ঢাকা কলেজের উত্তর ছাত্রাবাসের ২০১ নম্বর কক্ষে থাকেন বলে নিশ্চিত হয়েছেন ডিবি কর্মকর্তারা। সেই কক্ষে জসীম উদ্দিনের অনুসারীরাও থাকেন বলে ছাত্রলীগের এশটি গ্রুপ জানিয়েছে। এ বিষয়ে জসীম উদ্দিন বলেন, ২০১ নম্বর কক্ষে একাধিক গ্রুপের ছাত্ররা থাকে।
ডিবি জানায়, তাদের ধরতে ইতোমধ্যে সারা দেশে অভিযান শুরু হয়েছে। সীমান্ত এলাকাগুলোতেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। শিগগিরই তাদের গ্রেপ্তার করা হতে পারে।
ডিবির রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক বলেন, নাহিদ হত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। ভিডিও ফুটেজে যাদের দেখা যাচ্ছে, তাদের বিষয়ে একেকজন একেক ধরনের তথ্য দিচ্ছেন। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছে ডিবি।
এ বিষয়ে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এম হাফিজ আক্তার বলেন, এই ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে এবং তদন্ত চলছে। ঘটনাস্থলের সব ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ১৮ এপ্রিল রাতে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা এ সংঘর্ষে কয়েকজন শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী আহত হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এ সময় আহত হন বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যও। পরদিন ১৯ এপ্রিল সকালে আবারো সংঘর্ষে জড়ান শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীরা। মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে তারা ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকেন।
ছাত্রদের অনেকে হেলমেট পরে এবং লাঠি হাতে নিয়ে সংঘর্ষে জড়ান। ব্যবসায়ী-কর্মচারীরাও লাঠিসোঁটা ও লোহার রড নিয়ে ছাত্রদের ওপর হামলা চালানো শুরু করেন। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এ সংঘর্ষ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে গোটা নিউমার্কেট ও সায়েন্সল্যাব এলাকায়। থেমে থেমে সারা দিন চলে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এতে শতাধিক শিক্ষার্থী এবং প্রায় অর্ধশত ব্যবসায়ী-কর্মচারী আহত হন। দুই শিক্ষার্থীসহ বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন।
ছাত্রাবাস ছাড়ছেন ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীরা
এদিকে ডেলিভারিম্যান নাহিদ মিয়া হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ঢাকা কলেজের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করার খবর পাওয়ার পর পরই দলে দলে ছাত্রাবাস ত্যাগ করতে শুরু করেছেন ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থীরা। তবে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের সঙ্গে ছাত্রলীগের কোনো সম্পর্ক নেই বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। এর আগে, সংঘর্ষ চলাবস্থায় কলেজ কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ছাত্রাবাস ছাড়ার নির্দেশ দেয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা কলেজের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, শনিবার রাত ১২টার পর থেকে বহু শিক্ষার্থীকে ছাত্রাবাস ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে দেখেছেন তিনি। তিনি নিজেও বর্তমানে ছাত্রাবাসের বাইরে আছেন বলে জানান।
ছাত্রাবাসে পুলিশ যেকোনো সময় অভিযান চালাতে পারে, এমন তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এরপর থেকে শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাস ত্যাগ করা শুরু করেছেন। তবে পুলিশ বলছে, এখন পর্যন্ত তারা ঢাকা কলেজ ছাত্রাবাসে কোনো অভিযান শুরু করেনি। কেবল শিক্ষার্থীদের নজরদারিতে রেখেছে। যেকোনো সময় অভিযান শুরু হতে পারে।
এ বিষয়ে নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শ. ম. কাইয়ুম বলেন, আমরা এখনো কোনো অভিযান শুরু করিনি। তবে বিষয়টি নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। দক্ষিণ ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক শিক্ষক আনেয়ার মাহমুদ বলেন, ছাত্রাবাসে কোনো অভিযান হয়নি। আমরা একটু ব্যস্ত সময় পার করছি।