তীব্র দাবদাহে পুড়ছে সারা দেশ। বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন। ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। খাঁ খাঁ করছে দেশের মাঠ প্রান্তর। খাল-বিল, নদী-নালা ও জলাশয় ফের পানিশূন্য হয়ে পড়ছে। ঘরে-বাইরে সব জায়গাতেই বিরাজ করছে অস্বস্তিকর পরিবেশ।
আগামী তিন দিনে চলমান আবহাওয়ার খুব বেশি পরিবর্তন হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। ডায়রিয়া ও হিটস্ট্রোকের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
মঙ্গলবার আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, বায়ুমণ্ডলে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি। পশ্চিমা লঘুচাপের সঙ্গে পুবালী লঘুচাপের সংযোগ না ঘটায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হচ্ছে না। দেশের অধিকাংশ জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা অনেক বেড়ে গেছে।
মঙ্গলবার দেশের অধিকাংশ আবহাওয়া কেন্দ্রে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৬ থেকে ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। আর ৩০টি আবহাওয়া কেন্দ্রে রেকর্ড হয়েছে ৩৪ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর চার জেলায় বয়ে যাচ্ছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এরমধ্যে রাজশাহী, পাবনার ঈশ্বরদী ও চুয়াডাঙ্গায় আজ তাপমাত্রা ছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং যশোরে রেকর্ড হয় ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি, তাপপ্রবাহ এবং সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য হ্রাস পাওয়ার কারণে ভ্যাপসা গরম অনুভূত হচ্ছে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য যত বেশি হ্রাস পাবে, তত বেশি তীব্র গরম অনুভূত হবে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আজিজুর রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, প্রতি বছরই এপ্রিলে তাপমাত্রা বেশি থাকে। এ বছর এপ্রিল থেকে মে মাসে দেশের কোথাও কোথাও দুই থেকে তিনটি মৃদু/মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। দিনের তাপমাত্রা স্বাভাবিক অপেক্ষা সামান্য বেশি এবং রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকতে পারে। বঙ্গোপসাগরে ২ থেকে ৩টি নিম্নচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. রাশেদুজ্জামান বলেন, আগামী তিন দিনে চলমান আবহাওয়ার খুব বেশি পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এ সময় দক্ষিণ দিক থেকে আসা বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প থাকে। যে কারণে শরীর থেকে প্রচুর ঘাম ঝরে। প্রচণ্ড গরম ও ঘামের কারণে শরীরে অস্বস্তি বেড়ে যায়। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি, তাপপ্রবাহ এবং সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য হ্রাস পাওয়ার কারণে ভ্যাপসা গরম অনুভূত হচ্ছে বলে জানান তিনি।
রাজধানীর আকাশেও স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত নেই। দিনের অধিকাংশ সময় থাকছে তীব্র রোদ। গরমে অতিষ্ঠ নগরবাসী। প্রখর রোদ উপেক্ষা করেই চলতে হচ্ছে পথচারীদের। এত অস্বাভাবিক গরমে পরিবহনগুলোর ভেতরের তপ্ত পরিবেশে অস্থির হয়ে ওঠেন যাত্রীরা। দাবদাহে জর্জরিত মানুষের কাছে বেড়ে যায় ঠাণ্ডা পানীয়ের চাহিদা। রোজার কারণে দিনের বেলা রোজাদারদের কষ্টের অনুভূতি আরো বেশি। এদিকে, রাজধানীর বায়ুদূষণ এই পরিস্থিতি আরো অস্বস্তিকর করে তুলছে।
ঢাকায় গত এক সপ্তাহের তাপমাত্রা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রেকর্ড হয়েছে। আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বিরাজ করছে ২৭ থেকে ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। ঢাকার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার পার্থক্য হ্রাস পেয়ে ৭ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকছে। শুধু তাই নয়, রাজধানীসহ শহুরে এলাকার জন্য সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস অনেকটাই দুর্বিষহ অবস্থা সৃষ্টি করে বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। বর্তমানে রাজধানীবাসীকেও এমন বিরূপ আবহাওয়া ও ইট-পাথরের প্রতিকূল অবস্থায় পড়ে চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।
এদিকে এই খরতাপে পানিবাহিত রোগী বিশেষ করে ডায়রিয়া ও হিটস্ট্রোকের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
আইসিডিডিআরবি,র বিজ্ঞানী ড. মো. শাহাদাত হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে গেলেই এ দেশের মানুষের হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। যতটা সম্ভব প্রখর রোদ এড়িয়ে চলতে হবে। তীব্র তাপমাত্রায় ডায়রিয়ার জীবাণু সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যায় বলে জানান তিনি।
আবহাওয়া অফিসের পরামর্শও প্রায় একই। ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তাপমাত্রা এ দেশের মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এর ওপরে চলে গেলে তা হবে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, যা সহ্য করতে এ দেশের মানুষ অভ্যস্ত নয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই সতর্ক থাকতে হবে। দীর্ঘক্ষণ রোদে থাকা যাবে না। প্রচুর পরিমাণ তরল জাতীয় বিশেষ করে ওরস্যালাইন খেতে হবে। ঢিলেঢালা জামা পরিধান করতে হবে। আর হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হলে তাকে ছায়ায় নিতে হবে। শরীর মুছে দিতে হবে। এতে আক্রান্তের অবস্থার উন্নতি না হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
তিনি বলেন, হিটস্ট্রোকে আক্রান্তের আগে শরীরে তাপমাত্রা স্বাভাবিক অবস্থার বেশি থাকবে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়বে। বমি বমি ভাব দেখা দেবে। মাথা ঘুরতে থাকবে। প্রস্রাব কমে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তের চাপও কমে যাবে। এসব লক্ষণ দেখা দিলেই ছায়াচ্ছন্ন স্থানে বিশ্রাম নিতে হবে। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই বিশেষ সতর্ক থাকার ওপর বেশি জোর দিয়েছেন তিনি।