logo
আপডেট : ২৭ এপ্রিল, ২০২২ ১১:৩৫
মাহে রমজানে নাজাতের তাৎপর্য
নিজস্ব প্রতিবেদক

মাহে রমজানে নাজাতের তাৎপর্য

সব কলুষতা, মলিনতা ও পাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করা বা মুক্ত হওয়াই সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য। রমজান মাসের প্রথম দশক রহমতের, দ্বিতীয় দশক মাগফিরাতের, শেষ দশক নাজাতের। নাজাত মানে মুক্তি, মুক্তি পাওয়া, মুক্তি দেওয়া, মুক্ত হওয়া।


রমজানের শেষ দশকের নাজাতের অর্থ হলো- এ দশকে মানুষ পাপ-পঙ্কিলতা, গুনাহ থেকে মুক্ত হবে; জাহান্নাম থেকে মুক্ত হবে; পাপের আকর্ষণ থেকে মুক্ত হবে; আল্লাহর আজাব ও গজব থেকে মুক্ত হবে এবং আসমানি জমিনি ও রুহানি জিসমানি (আত্মিক ও শারীরিক) রোগশোক, জরা-ব্যাধি থেকে মুক্ত হবে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন তাঁর প্রতিনিধিরূপে। মানুষের কল্যাণের পথে রয়েছে তিনটি বাধাদানকারী শক্তি-জিন শয়তান, মানব শয়তান ও নফস শয়তান। বিষয়টি কোরআন কারিমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তুমি বলো, “আমি আশ্রয় লই মানুষের প্রতিপালক, মানুষের মালিক, মানুষের মাবুদের (আল্লাহর) নিকট, প্ররোচনাদাতা খান্নাসের (শয়তানের) অনিষ্ট থেকে; যে মানুষের অন্তরে ওয়াছওয়াছা দেয়, সে জিন হতে ও মনুষ্য হতে (সুরা-১১৪ নাস, আয়াত: ১-৬)।”’ আর অবশ্যই আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং আমি জানি তাকে তার নফস যে বিষয়ে প্ররোচনা দেয় (সুরা-৫০ কাফ, আয়াত: ১৬)।’


সব মানুষের সঙ্গে শয়তান নিযুক্ত আছে আর জীবন-মরণে ও ইহকাল-পরকালে একান্ত সঙ্গী হিসেবে নফস রয়েছে। নফস হলো ষড়রিপু- কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। নবী-রাসুলরা মাসুম বা নিষ্পাপ হওয়ার কারণে তাঁরা শয়তানি কুমন্ত্রণা ও রিপুর তাড়না থেকে মুক্ত ছিলেন। এ ছাড়া যেসব মুমিন মুসলিম শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব ধরনের পাপ থেকে মুক্ত থাকার সৌভাগ্য লাভ করেন, তাঁদের মাদারজাদ (আজন্ম) ওলি বলা হয়।
রমজানে জিন শয়তানকে বন্দী করে রাখা হলেও মানুষ পাপাচার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারে না। এর থেকে মুক্তির জন্য প্রথমে ষড়রিপুর তাড়নামুক্ত হয়ে নফস শয়তানকে পরাভূত করতে হবে। দ্বিতীয়ত মনুষ্য শয়তানের প্রভাবমুক্ত হওয়ার জন্য অসৎসঙ্গ ত্যাগ করে সৎসঙ্গ অর্জন করতে হবে। এই দুটি সুসম্পন্ন হলেই জিন-শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আত্মরক্ষা করা যাবে।


মানব সত্তা তথা রিপুর সমন্বয়ে গঠিত নফসের তিন অবস্থা- নফসে আম্মারা, নফসে লাউওয়ামা এবং নফসে মুৎমাইন্না। নফসে আম্মারা ‘পাপাকৃষ্ট সত্তা’, যে পাপে অনুরক্ত ও পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত। নাফসে লাউওয়ামা ‘অনুতপ্ত সত্তা’, যে শয়তানের ধোঁকায় বা রিপুর তাড়নায় অথবা পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রভাবে সাময়িক পাপ করে এবং লজ্জিত, অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে। অর্থাৎ কখনো পাপে অনুরাগ ও কখনো অনুতাপ হয়। নফসে মুৎমাইন্না ‘প্রশান্ত আত্মা’, যার পাপের প্রতি বিরাগ এবং নেকির প্রতি অনুরাগ থাকে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর তাকে তার অসৎ কর্ম ও সৎ কর্মের জ্ঞান দান করেছেন। সে সফল হলো যে তার নফসকে পবিত্র করেছে; আর সে ব্যর্থ হলো যে নফসকে কলুষিত করেছে (সুরা-৯১ শামস, আয়াত: ৮-১০)।’


নাজাতের অর্থ হলো ওই সব দোষত্রুটি থেকে নিজেকে মুক্ত ও পবিত্র করা এবং সদ্গুণাবলি অর্জন করে স্থায়ী মুক্তি নিশ্চিত করা, যাতে নফস মুৎমাইন্না অবস্থা থেকে পুনরায় লাউওয়ামা বা আম্মারার দিকে ফিরে না যায়।
মোহমুক্তি বা নাজাতের উপায় হলো তওবা ও ইস্তিগফার করা। তওবা মানে হলো পাপ ছেড়ে পুণ্যে মনোনিবেশ করা। ইস্তিগফার হলো কৃত অপরাধের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং পুনরায় পাপ না করার অঙ্গীকার করা। তওবা ও ইস্তিগফারের চমৎকার একটি মাধ্যম হলো ইতিকাফ। এতে বান্দা দুনিয়ার সব মোহ-মায়া-আকর্ষণ থেকে মুক্ত হয়ে একান্তভাবে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যায়। আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর দিকে পালিয়ে আসো (সুরা-৫১ যারিয়াত, আয়াত: ৫০)।’
হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম মহিমান্বিত রজনী শবে কদর পাওয়ার জন্য ইতিকাফ সবচেয়ে ভালো মাধ্যম। রমজানের বিশেষ সুন্নতে মুআক্কাদা কিফায়া আমল ইতিকাফ। তাকওয়ার রুদ্ধদ্বার প্রশিক্ষণ হলো ইতিকাফ।


লেখক: বাংলাদেশ ইসলামিক স্কলার্স ফোরামের চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম-মহাসচিব এবং আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সূফীজমের সহকারী অধ্যাপক