logo
আপডেট : ২৮ এপ্রিল, ২০২২ ০৬:০০
নিউমার্কেটে সংঘর্ষ
দেশের সব মিন্টুই কি মামলার আসামি?
* রিমান্ড শেষে কারাগারে বিএনপি নেতা মকবুল * মোরসালিন হত্যার ঘটনাটি এখনো ‘ক্লুলেস’: ডিবি
এমদাদুল হক খান

দেশের সব মিন্টুই কি মামলার আসামি?

নিউমার্কেটে সংঘর্ষ (ফাইল ছবি)

রাজধানীর নিউমার্কেটে শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের করা মামলার আসামিদের নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। এজাহারভুক্ত ২৩ নম্বর আসামি মিন্টু মৃত এবং চার নম্বর আসামি ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি টিপু সাত বছর ধরে জাপানে আছেন-- আদালতে আইনজীবীর এই দাবির পর নিউমার্কেট থানার ওসি বলেছেন, মিন্টু-টিপু নাম কি শুধু একজনের হয়? এরপরই সাধারণ মানুষের মাঝে প্রশ্ন উঠে -তাহলে এজাহারভুক্ত আসামি মিন্টু কে? নাকি দেশের সব মিন্টুই এ মামলার আসামি?

এদিকে এ মামলায় গ্রেপ্তার বিএনপি নেতা মকবুল হোসেনকে তিন দিনের পুলিশ রিমান্ড শেষে বুধবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এছাড়া বুধবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, নিউমার্কেটের দোকানকর্মী মোরসালিন হত্যার ঘটনাটি এখনো ‘ক্লুলেস’।

প্রাথমিকভাবে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে ধারণা করা হচ্ছে, মোরসালিন মূলত ইটের আঘাতে জখমপ্রাপ্ত হয়ে মারা গেছেন। এ ইট কোথা থেকে এসেছে, সেটি সুনির্দিষ্টভাবে এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে যারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে, এ ধরনের কাজে নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদেরও এর দায়ভার গ্রহণ করতে হবে। এ সময় কারা নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদের শনাক্ত করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, হেলমেট মাথায় দিয়ে হামলায় অংশ নেওয়া সবাই সন্ত্রাসী। তাদের ধরে আইনের আওতায় আনা হবে।

রাজনৈতিক বিবেচনায় নয়, হেলমেটধারীদের সন্ত্রাসী হিসেবেই গ্রেপ্তার করা হবে বলে উল্লেখ করেন মাহবুব আলম। তিনি বলেন, তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হচ্ছে।

যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, আমরা তাদের দলীয় পরিচয় এখনই নিশ্চিত করছি না। তাদের দলীয় পরিচয় দেখারও বিষয় নেই। এ ছাড়া এখানে (ঢাকা কলেজ) কোনো কমিটি নেই, ছাত্রলীগ বলতে কোনো জিনিস নেই। কেউ যদি পরিচয় দিয়ে থাকে, সেটা হতে পারে। তবে আমরা এ ধরনের কিছু পাইনি। যারা হেলমেট পরে মিশনে অংশ নিয়েছেন, তারা অবশ্যই সন্ত্রাসী।

নিউমার্কেটে সংঘর্ষের সময় হামলার শিকার হন সাংবাদিকরাও। (ফাইল ছবি)

 

নিউমার্কেটে সংঘর্ষের ঘটনায় করা দুটি হত্যা মামলা ডিবি তদন্ত করছে। একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেন হত্যা এবং অন্যটি দোকানকর্মী মোহাম্মদ মোরসালিন হত্যা।

নাহিদ হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ঘটনার সময় ধারণ করা ফুটজ দেখে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে নাহিদ হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। চিহ্নিতকরণের কাজ অনেক এগিয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ঢাকা কলেজের ছাত্রাবাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকে বাড়িতে চলে গেছেন বা আত্মগোপনে আছেন। আত্মগোপনে যারা আছেন, তাদের গ্রেপ্তারে ডিবির একাধিক টিম কাজ করছে। শিগগিরই ভালো ফল জানানো সম্ভব হবে।

এদিকে নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের মামলার আসামির তালিকায় মৃত এবং বিদেশে অবস্থানরত দুই কর্মীর নাম এসেছে বলে যে দাবি বিএনপি নেতাদের আইনজীবীর তরফ থেকে দাবি করা হয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তরে নিউমার্কেট থানার ওসি শ ম কাইয়ুম বুধবার বলেন, পৃথিবীতে এক নামে মানুষ কি একজনই থাকে?

সংঘর্ষের সময় ‘দাঙ্গা-হাঙ্গামা, জ্বালাও-পোড়াও, পুলিশের কাজের বাধা দেওয়ার’ অভিযোগে নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়ামিন কবিরের করা এ মামলায় ২৪ জনের নাম উল্লেখ করে আরো কয়েকশ ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়েছে। এ মামলার প্রধান আসামি অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেনকেই এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যে দুটি দোকানের কর্মীদের বচসাকে কেন্দ্র করে গত ১৮ এপ্রিল ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ওই সংঘাতের সূত্রপাত, সেই দোকান দুটির মালিক মকবুল নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং বর্তমান মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।

আসামিদের কারো রাজনৈতিক পরিচয় মামলায় বলা হয়নি। তবে মকবুলের দাবি, রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই তাকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় নাম আসা বাকি ২৩ জনও বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী বলে দলটির নেতাদের ভাষ্য। ওই ২৩ জনের মধ্যে ১৪ জন মঙ্গলবার হাইকোর্টে আবেদন করে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন পেয়েছেন। জামিনের মেয়াদ শেষে তাদের বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে।

জামিন শুনানি শেষে তাদের আইনজীবী কায়সার কামাল আদালতের বাইরে সাংবাদিকদের বলেন, ২৪ জনের বিরুদ্ধে যে মামলাটি পুলিশ করেছে, তার মধ্যে ২৩ নম্বর আসামি মিন্টু মারা গেছেন দুই বছর আগে। তিনি যুবদলের রাজনীতি করতেন। আর চার নম্বর আসামি ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি টিপু সাত বছর ধরে জাপানে আছেন।

নিউমার্কেটে সংঘর্ষের সময় ভাঙচুর করা হয় একটি রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স। (ফাইল ছবি)

 

এ মামলার আসামিদের রাজনৈতিক পরিচয় এবং মিন্টু ও টিপুর বিষয়ে কয়েকটি সংবাদমাধ্যমও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর পরপরই দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসে মৃত মানুষ কি করে সংঘর্ষে অংশ নেয়?

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে ট্রল করে শত শত মানুষ। কেউ কেউ লিখেন, গ্রেপ্তার আতঙ্কে কবরে আত্মগোপনে আছেন মিন্টু। একজন নারী অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘কবর থেকে উঠে এসে মৃত ব্যক্তিরা ভোট দেয়, আবার মারামারিও করে? বাপরে! কী সাংঘাতিকদের আমল এটা। ফেরাউন নমরুদও ফেইল। পুলিশের করা মামলার ২৩ নম্বর আসামি বিএনপি নেতা মিন্টু দুই বছর আগে মারা গেছেন।’

তবে পুলিশ তাদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে নারাজ। নিউমার্কেট থানার ওসি পাল্টা প্রশ্ন করলেন, গ্রেপ্তারের আগে আইনজীবী কীভাবে নিশ্চিত হলেন যে, ওই দুই ব্যক্তিই সেই দুজন? এই মিন্টু যে সেই মিন্টু তা উকিল সাহেব কীভাবে নিশ্চিত হলেন? মিন্টু নাম কী একজনের হয়! আর টিপুর বিষয়টা ওই যে বলা হয়, ‘ঠাকুর ঘরে কে রে আমি কলা খাই না’ ব্যাপারটা এমনই মনে হচ্ছে। আসলে উকিল সাহেবের এজাহার পড়া উচিত ছিল।

মামলার এজাহারে বলা হয়, ওই রাতে (১৮ এপ্রিল) সংঘর্ষের পর মকবুল, আমীর হোসেন আলমগীর, মিজান, টিপু, হাজি জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারি, হাসান জাহাঙ্গীর মিঠু, হারুন হাওলাদার, শাহ আলম শন্টু, শহীদুল ইসলাম শহীদ, জাপানি ফারুক, মিজান ব্যাপারী ও আসিফের ‘উসকানিতে’ রহমত, সুমন, জসিম, বিল্লাল, হারুন, তোহা, মনির, বাচ্চু, জুলহাস, মিঠু, মিন্টু ও বাবুল সরাসরি সংঘাতে অংশ নেয়। তবে এজাহারে কারো বাবা-মায়ের নাম, ঠিকানা সব অজ্ঞাত দেখানো হয়।

এ ব্যাপারে গতকাল বুধবার আইনজীবী কায়সার কামাল মোবাইল ফোনে ভোরের আকাশকে বলেন, এ মামলায় যেসব আসামি জামিন নিতে এসেছিলেন, তারা আমাকে বলেন, এজাহারভুক্ত আসামি মিন্টু দুই বছর আগে মারা গেছেন। আর আসামি টিপু সাত বছর ধরে বিদেশ থাকেন। তাদের কথা অনুযায়ী আমি আদালতকে বিষয়টি জানাই। এখন পুলিশ বলুক, মিন্টু মারা গিয়ে না থাকলে এজাহারভুক্ত আসামি মিন্টু কোন মিন্টু। তার পরিচয় প্রকাশ করুক।

 গ্রেপ্তার বিএনপি নেতা মকবুল হোসেন এ মামলায় এখন পর্যন্ত একমাত্র আটককৃত আসামি। তাকে রিমান্ড শেষে কারাগারে
পাঠানো হয়েছে।

 

রিমান্ড শেষে মকবুল কারাগারে

এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের মামলায় গ্রেপ্তার বিএনপি নেতা মকবুল হোসেনকে তিন দিনের পুলিশ রিমান্ড শেষে বুধবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক হালদার অর্পিত ঠাকুর এ দিন মকবুলকে আদালতে হাজির করে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন।

অন্যদিকে মকবুলের পক্ষে তার আইনজীবী জামিনের আবেদন করেন। ঢাকার মহানগর হাকিম ইশরাত জাহান জামিন শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার দিন রেখে মকবুলকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

মকবুল হোসেনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন ঢাকা বারের সাবেক সভাপতি ইকবাল হোসেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন আইনজীবী আজাদ রহমান।

মকবুল হোসেনের অসুস্থতার কথা বলে চিকিৎসার আবেদন করেছিলেন আইনজীবী ইকবাল। আদালত কারাবিধি অনুযায়ী তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন।

গত ২২ এপ্রিল বিকেলে ধানমন্ডির বাসা থেকে মকবুলকে গ্রেপ্তারের পরদিন রিমান্ডে পাঠিয়েছিলেন আদালত। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।

এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে নিউমার্কেট থানার ওসি শ ম কাইয়ুম বলেন, নতুন করে আর পুলিশ হেফাজত চাওয়া হয়নি। কারণ অনেক তথ্য পাওয়া গেছে, এখন যাচাই-বাছাই করতে হবে তথ্যগুলো। যাচাই-বাছাই পরই পরবর্তী পদক্ষেপ।

গত ১৮ এপ্রিল রাতে ও পরের দিন নিউমার্কেটের দোকান মালিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। এতে দুজনের প্রাণহানি এবং দেড় শতাধিক মানুষ আহত হন। এ সংঘর্ষের ঘটনায় সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ভাঙচুর ও জখম, হত্যার অভিযোগে নিউমার্কেট থানায় মোট পাঁচটি মামলা হয়েছে। একটি মামলায় আসামিদের নাম উল্লেখ করা হলেও বাকিগুলোর আসামি অজ্ঞাত। এ ঘটনায় মকবুল হোসেন নামে এক বিএনপি নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়।