logo
আপডেট : ২৮ এপ্রিল, ২০২২ ০৮:৫৩
ঈদযাত্রা: সংকটেও সৈয়দপুর রেল কারখানায় বিশেষ কর্মযজ্ঞ
শরিফুল ইসলাম, নীলফামারী

ঈদযাত্রা: সংকটেও সৈয়দপুর রেল কারখানায় বিশেষ কর্মযজ্ঞ

নীলফামারীর সৈয়দপুর রেল কারখানায় ট্রেন সংস্কারের ক্জ করছেন শ্রমিক-প্রকৌশলীরা

বছর ঘুরে আবার আসছে ঈদ। মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে গত চার ঈদে ঘরমুখো মানুষ গ্রামে যেতে না পারলেও এবার তেমনটি হচ্ছে না। এবার পরিস্থিতি বদলেছে। মহামারি করোনা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। ফলে এবারের ঈদুল ফিতরে সড়কের পাশাপাশি রেলপথে থাকবে ঘরমুখো মানুষের চাপ। তবে ব্যাপক যাত্রী চাহিদা থাকা সত্ত্বেও নানা সংকটের মুখে অনেকটা জোড়াতালি দিয়েই ঈদযাত্রার প্রস্তুতি নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

প্রয়োজনের মাত্র ২৫ শতাংশ জনবলের পাশাপাশি বাজেটস্বল্পতা নিয়ে রেলওয়ের ঈদবহরে ৫০টি বগি সংযুক্ত করতে যাচ্ছে দেশের বৃহত্তম সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। নষ্ট এবং চলাচল অযোগ্য বগিগুলোকেই সচল করে তুলেছে এখানকার শ্রমিক-কর্মচারীরা। চরম কর্মব্যস্ততায় সময় কাটছে তাদের।

সৈয়দপুরের এই ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে কারখানায় পুরনো ট্রেনকে নতুন করার কাজ চলে আসছে ব্রিটিশ আমল থেকে। ব্রিটিশ সরকার ১৮৭০ সালে সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানাটি স্থাপন করে। সেই সময় সৈয়দপুর কারখানায় কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজারের মতো। ধীরে ধীরে জনবল কমে যাওয়ার পরেও এ কারখানায় প্রতিদিন একটি কোচ ও একটি ওয়াগন মেরামত করা হয়। এ ছাড়া রেলওয়ের নানা ধরনের যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয় এখানে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রয়োজনের মাত্র ২৫ শতাংশ জনবল নিয়ে কাজ হচ্ছে কারখানাটিতে। কারখানার যান্ত্রিক শাখায় দুই হাজার ৮৫৯ জনবলের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন মাত্র ৬৯১ জন। বৈদ্যুতিক শাখায় ৩৩৭ জনবলের বিপরীতে কর্মরত রয়েছেন ১৪৮ জন।

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানার জিওএইচ, উৎপাদন মেশিন শপ, ক্যারেজ শপ, হুইল শপ, বগি শপ ও সিএইচআর শপ ঘুরে দেখা গেছে, কোথাও চলছে নষ্ট হয়ে যাওয়া বগি মেরামত। কেউ ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ কেউ-বা ব্যস্ত চাকা মেরামতে। আবার কেউ ওয়েল্ডিং ও কোচের সিট মেরামতে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। কোথাও আবার মেরামত করা বগিকে নতুন রং লাগিয়ে চকচকে করে তোলা হচ্ছে- যেন দম ফেলার সময় নেই তাদের কারো। তীব্র জনবল সংকটের মধ্যেও মানুষের সেবার ব্রত নিয়ে কাজ করছেন শ্রমিকরা। তাদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত জনবল ও কিছু কাঁচামালের অভাবে পুরো কর্মযজ্ঞ কিছুটা বাধাগ্রস্ত।

মেরামতকৃত এসব কোচ দিয়ে ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-পার্বতীপুর রুটে দুটি বিশেষ ট্রেন চালু করা হবে। আর বাকি কোচ দিয়ে অন্যান্য ট্রেনের সঙ্গে সংযুক্ত করা হবে। রেলবহরে বাড়তি কোচগুলো যুক্ত হলে ঘরমুখো মানুষের যাত্রাপথের ভোগান্তি কিছুটা হলেও লাঘব হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রতিদিন সকাল সাতটা থেকে শুরু করে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাজ চলছে কারখানার ২৪টি বিভাগে। ইতোমধ্যে প্রস্তুত হওয়া ৫০টি বগি চলে গেছে রেলওয়ের পাকশী ও লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের কাছে।

ক্যারেজ শপের ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি রাশেদুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতি ঈদে আমাদের অতিরিক্ত একটা টার্গেট দেওয়া হয়, সেই টার্গেট পূরণ করতে আমাদের স্বল্পসংখ্যক জনবল নিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমাদের নির্ধারিত ডিউটির বাইরেও এক ঘণ্টা করে অতিরিক্ত ডিউটি করে এই অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করার চেষ্টা করছি। আশা করি এবারের ঈদে ঘরমুখী অতিরিক্ত পাঁচ হাজার যাত্রী নির্বিঘ্নে বাড়ি পৌঁছাবে প্রতিদিন।

তিনি আরো বলেন, জনবল সংকটের মধ্য দিয়ে আমরা যেখানে আমার সেকশনে লোক ছিল ৩৫ জন, বর্তমানে সেই লোক কমে এসে গেছে ১৩ জনে। এই ১৩ জন লোক দিয়ে আমার সেকশনে কাজ করা খুব কষ্টসাধ্য হচ্ছে। সরকারের উচিত পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ করা। বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, সরকার যদি পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ করে- তা হলে আমরা আরো বেশি মানুষকে সেবা দিতে সক্ষম হব।

একই শপের শ্রমিক মিজানুর রহমান বলেন, কারখানায় মেরামতের জন্য যে কোচগুলো আসে- সেগুলোর ইনজুরি হয় সাধারণত এক বছর থেকে ছয় মাস ব্যবহারের পর। এই কোচগুলো একদম রুগ্ন অবস্থায় আসে। এগুলোকে আমরা প্রচুর কাজ করে নিখুঁত করে মেরামত করার চেষ্ট করি। মেরামতের জন্য যে গাড়িগুলো আসে, এগুলোর ৯০ শতাংশ অকেজো থাকে। এসব গাড়িকে আমরা শতভাগ মেরামত করে থাকি। ঈদের কারণে বর্তমানে এক ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় পরিশ্রম করতে হচ্ছে আমাদের।

হুইল শপের শ্রমিক ইলিয়াস হোসেন বলেন, সাধারণ সময়ে দিনে দুই থেকে তিনটি চাকার কাজ করা যায়। কিন্তু ঈদের চাপ থাকায় বর্তমানে অতিরিক্ত সময় এবং বাড়তি পরিশ্রম মিলিয়ে প্রতিদিন পাঁচটি চাকার কাজ করতে হচ্ছে। যাত্রীদের নিরাপদ ভ্রমণের কথা ভেবে এখন আমরা কোনো ছুটি কাটাচ্ছি না।

পেইন্ট শপের শ্রমিক আউয়াল হোসেন বলেন, আমাদের শপের কাজ হচ্ছে গাড়িকে রং করে গাড়ির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা। গত ঈদগুলোয় আমরা স্বল্পসংখ্যক লোক নিয়ে সময়ের আগে গাড়িগুলোর কাজ শেষ করি। যদিও পুরো কারখানায় ২৫ শতাংশ লোক নিয়ে আমরা কাজ করি, ৭৫ শতাংশই ঘাটতি।

‘কর্তৃপক্ষ যদি জনবল নিয়োগ দিয়ে এই ঘাটতিটা পূরণ করে, তা হলে আমরা বেশি গাড়ি দিতে পারব। লোকসংখ্যা কমের কারণে খুব কষ্টের মধ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। সেটা কর্তৃপক্ষের চাপে হোক কিংবা আমাদেও দায়িত্ব থেকে হোক। রেল যেহেতু সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, আমরা সেবার জন্য শ্রম সবসময় বেশি করে দেই- যেন যাত্রীদের কোনো ভোগান্তি না হয়’, বলেন আউয়াল হোসেন।

ক্যারেজ শপের সুপারভাইজার আব্দুর রশিদ বলেন, ‘কথা বললে তো দোষ হয়ে যাবে। আমরা তো খুব বিপদের মধ্যে আছি। লোকবল নাই, এক বছর-ছয় মাস করে চাকরি আছে আমাদের। আমি একটা সুপারভাইজার, আমি টেবিলে বসে লেখালেখি করব আমি করছি ওয়েল্ডিংয়ের কাজ। লোকবল বলতে নাই কিছু, সেটা কর্তৃপক্ষকে বললে তারা কর্ণপাতও করে না। এগুলো বলতে গেলে তো আমাদের অপরাধ হয়ে যাবে। সত্য কথা তো এখানে বলা যাবে না।’

কারখানার বগিশপের ইনচার্জ সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী জহুরুল হাবীব বলেন, ‘আমরা বগিশপে হুইল, ব্রেকিং সিস্টেমসহ যত সেফটি আইটেম আছে, সবগুলোরই কাজ করে থাকি। রিপেয়ার, রিকনডিশন, বিল্ডআপ করা হয় এখানেই। আর আমরা মাত্র ২৫ শতাংশ জনবল নিয়ে কাজ করছি, সে জন্য লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রাখতে আমাদের প্রত্যেক শ্রমিককে বেশি কাজ করতে হচ্ছে। রোজা থেকে তাদের বেশি কাজ করতে হচ্ছে।’

কারখানার ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী মমিনুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছরই ঈদকে সামনে রেখে অধিকসংখ্যক কোচ মেরামতের টার্গেট হাতে নেওয়া হয়। আমাদের এবারের লক্ষ্যমাত্রা এ মাসেই ৫০টি কোচ আউটর্টান দিব।

কারখানার উৎপাদন মেশিনশপের ইনচার্জ প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, জনবল সংকট প্রধান সমস্যা এখানে। প্রয়োজনীয় জনবল থাকলে কারখানাটি আরো উন্নত সেবা দিতে পারবে রেল বিভাগকে। ঈদের সময় আমরা সবাই বাড়তি কষ্ট নিয়ে কাজ করি। লক্ষ্য বাস্তবায়নে তখন আমরা সেসব আমলে নেই না। যে যার মতো মেধা শ্রম দিয়ে কাজ শেষ করার ব্রত নিয়েই দিন কাটাই।

সৈয়দপুর কারখানার বিভাগীয় তত্ত্বাবধায়ক সাদেকুর রহমান বলেন, আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে যাত্রীরা যেন সহজেই নির্বিঘ্নে তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারেন, এ জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের পক্ষ থেকে দুটি বিশেষ ট্রেন পরিচালনা করা হবে। বিশেষ ট্রেনসহ অন্য ট্রেনগুলোয় অতিরিক্ত কোচ লাগানোর জন্য আমরা এ মাসেই ৫০টি কোচ আউটর্টান দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছি।

তিনি আরো বলেন, মাত্র ২৫ শতাংশ জনবল নিয়ে কারখানা চলছে, পর্যাপ্ত জনবল না থাকাতে আমরা ওভারটাইমের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের পরে শ্রমিকদের এক ঘণ্টা করে কাজ করিয়ে কাজগুলো আদায় করছি। যদিও তাদের রোজা রেখে কাজ করতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। শুধু যাত্রীরা যেন নির্বিঘ্নে নিরাপদে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারে এ লক্ষ্যে কারখানার এই উদ্যোগ।

জনবল নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া কয়েকটি কারণে সম্পন্ন হয়নি। এরই মধ্যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। এই নিয়োগ শেষ হলে আমাদের ঘাটতি কিছুটা কমে আসবে। আমাদের যেহেতু জনবলের ঘাটতি, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী আমরা এই মুহূর্তে ২০০ জন অনিয়মিত শ্রমিক দিয়ে কাজ করাচ্ছি। আরো যদি শূন্য পদের বিপরীতে অনিয়মিত শ্রমিক বাড়ানো যায়, তা হলে কারখানার উৎপাদন আরো বাড়ানো সম্ভব।