logo
আপডেট : ২৮ এপ্রিল, ২০২২ ১৩:৫৮
‘বাড়তি ভাড়ায় সিন্ডিকেটের পকেটে যাবে ৮০০০ কোটি টাকা’
নিজস্ব প্রতিবেদক

‘বাড়তি ভাড়ায় সিন্ডিকেটের পকেটে যাবে ৮০০০ কোটি টাকা’

‘ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধের দাবিতে’ বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন। ছবি- ভোরের আকাশ

ঈদ সামনে রেখে সড়ক, নৌ, রেল ও আকাশপথের যাত্রীদের গুণতে হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। সেই টাকা যাত্রীদের কাছ থেকে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আদায় করা হচ্ছে। আবার পরিবহন শ্রমিকদের ঈদে বেতন-বোনাস দেওয়া হয় না। সড়ক পথে ৪০ কোটি ট্রিপে যাত্রীপ্রতি গড়ে ১০০ টাকা বেশি আদায় করা হলে প্রায় ৪০০০ কোটি টাকা এবং নৌ, রেল ও আকাশপথে ২০ কোটি ট্রিপে যাত্রীপ্রতি গড়ে ২০০ টাকা বেশি আদায় করা হলে প্রায় ৪০০০ কোটি টাকা বাড়তি ভাড়া আদায় হবে। এভাবে এবারের ঈদে ৮০০০ কোটি টাকার বেশি ভাড়া সিন্ডিকেটের পকেটে যাবে।

আজ বৃহস্পতিবার (২৮ এপ্রিল) সকালে ‘ঈদযাত্রায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধের দাবিতে’ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী এসব কথা বলেন।

লিখিত বক্তব্যে মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরো বলেন, বরাবরের মতো এবারো আকাশপথে ভাড়ানৈরাজ্য চরমে পৌঁছেছে। ঢাকা-বরিশাল ৬১ অ্যারোনটিক্যাল মাইলের উড়োজাহাজের ভাড়া ১৫০০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত ঢাকা-ব্যাংককের ভাড়ার প্রায় দেড়গুণ বাড়তি আদায় করা হচ্ছে। এই রুটে ইউএস বাংলায় ৪০০০ টাকার ভাড়া এখন ১০৮০০ টাকা। নভোএয়ারের ৪৮০০ টাকার টিকিট এখন ৮৪০০ টাকা। বাংলাদেশ বিমানে ৩০০০ টাকার টিকিট ৭৪০০ টাকা। ঢাকা-সৈয়দপুর, ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ৪৫০০ টাকার নিয়মিত ভাড়া ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায় ঠেকেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসাধু সদস্যদের পৃষ্ঠপোষকতার কারণে সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেও ভাড়ানৈরাজ্য বন্ধ করতে পারছে না বলে এসময় উল্লেখ করেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব।

তিনি বলেন, এবারের ঈদে ২৫ এপ্রিল থেকে ১০ মে পর্যন্ত সব পথ মিলে প্রায় ৬০ কোটি ট্রিপ যাত্রী হতে পারে। তার সিংহভাগ অর্থাৎ ৪০ কোটি ট্রিপ সড়কপথে, ২০ কোটি ট্রিপ রেল, নৌ ও আকাশপথে হতে পারে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ২৫ এপ্রিলের পর থেকে শহরাঞ্চলে রিকশা ভাড়া ২০ ভাগ বেড়ে গেছে। আগামীকাল শুক্রবার থেকে এই ভাড়া ১০০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। এখন অটোরিকশা, ইজিবাইক ভাড়াও দ্বিগুণ-তিনগুণ বাড়তি আদায় করা হচ্ছে। সব রুটে লেগুনা ভাড়াও দিগুণ আদায় করা হচ্ছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, চালক-সহকারীর বেতন ও দুই ঈদের ঈদ বোনাস যাত্রী সাধারণের কাছে থেকে আদায় করা হলেও তাদের বেতন-বোনাস দেওয়া হয় না। এর ফলে রাজধানীর বাস-মিনিবাসে ঈদের তিন দিন আগে থেকে ঈদের তিন দিন পর পর্যন্ত উঠানামা সর্বনিম্ন ভাড়া ৫০ টাকা হারে আদায় করা হয়। এবারো এ হারে ভাড়া আদায়ের লক্ষ্যে চালক-শ্রমিক ও পরিবহন চাঁদাবাজরা মরিয়া হয়ে উঠেছে।

উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে যাত্রাপথে বিভিন্ন বাসে যাত্রী প্রতি ১০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে- অভিযোগ করে তিনি বলেন, নৌপথেও ভাড়ানৈরাজ্য চরমে ঠেকেছে। রেলে টিকিট কালোবাজারি, অনলাইনে টিকিট পেতে বিড়ম্বনা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার চরমে পৌঁছেছে। আকাশপথেও এহেন ভাড়া নৈরাজ্যের কারণে যাত্রীসাধারণ এখন দিশেহারা।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, গত বছরের নভেম্বরে সরকার ডিজেলের মূল্য ২৩ ভাগ বাড়ানোর সময়ে বাসভাড়া ২৭ ভাগ ও লঞ্চভাড়া ৩৬ ভাগ বাড়ানো হলেও লঞ্চমালিকেরা নানা কারচুপির মধ্যে দিয়ে সর্বোচ্চ ৪৬ শতাংশ হারে বর্ধিত ভাড়া আদায় করে আসছিলেন। ঢাকা-বরিশাল নৌ-রুটে আগে ডেকের ভাড়া ছিল ২০০ টাকা। ভাড়া বৃদ্ধির পর তা ৩৫০ টাকা হারে আদায় করা হলেও এবারের ঈদে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা হারে আদায় করা হচ্ছে।

লঞ্চে এক শয্যার কেবিনের ভাড়া ১০০০ টাকা ছিল। ভাড়া বৃদ্ধির পর তা ১২০০ টাকা করা হলেও এবারের ঈদে ১৫০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। দুই শয্যার ডাবল কেবিনের ভাড়া আগে ছিল ১৮০০ টাকা। ভাড়া বৃদ্ধির পর তা ২৪০০ টাকা করা হলেও এখন আদায় করা হচ্ছে ৩০০০ টাকা। আবার এসব টিকিটের কালোবাজারিরা আরো ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা বর্ধিত মূল্য নিয়ে যাত্রীদের হাতে তুলে দিচ্ছে।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, সড়কপথে ঢাকা-চুয়াডাঙ্গা, বগুড়া, রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রামসহ উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি রুটে যাত্রী প্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে, যা আগামীকাল শুক্রবার থেকে দিগুণে পৌঁছে যাবে।

ঢাকা-রংপুর রুটে হানিফ এন্টারপ্রাইজের ভাড়া আগে ১০০০ টাকা নেওয়া হলেও এখন ১৮০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। এ রুটে ঈগল পরিবহনের ভাড়া ১২০০ টাকা হলেও এখন ১৮০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। শাহআলী পরিবহন ৮৫০ টাকার জায়গায় নিচ্ছে ১৪০০ টাকা। ঢাকা-লালমনিরহাট রুটের শুভ বসুন্ধরায় ভাড়া ৮০০ টাকা, নেওয়া হচ্ছে ১৩০০ টাকা। ঢাকা-পটুয়াখালী রুটের সাকুরা পরিবহনের এসি বাসের ১০০০ টাকার ভাড়া ১৪০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।

চট্টগ্রাম থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলের পথে বিভিন্ন বাসে দিগুণ ভাড়া আদায় করার অভিযোগ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, আবার কিছু কিছু রুটে স্বল্প দূরত্বে যেতে চাইলেও টিকিট নেই অযুহাত দিয়ে বেশি দূরত্বের টিকিট নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। যেমন ঢাকা-চট্টগ্রামের কেরানীহাট বা লোহাগড়ার যাত্রীদের ১০০ কিলোমিটার বেশি দূরত্বের কক্সবাজারের টিকিট কিনতে হচ্ছে। কেউ কাপ্তাই যেতে চাইলে তাকে রাঙামাটির টিকিট কিনতে হচ্ছে। কেউ রাজশাহী যেতে চাইলে তাকে নওগাঁর টিকিট কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, এই নৈরাজ্যের কারণে নিম্নআয়ের লোকজন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাস-ট্রাক ও ট্রেনের ছাদে, কাভার্ড ভ্যান, পণ্যবাহী পরিবহন ও ফিটনেসহীন যানবাহনে কম ভাড়ায় যাতায়াত করতে বাধ্য হবে। ফলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়বে। তাই জরুরিভিত্তিতে এহেন ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রী হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানাচ্ছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।

সংবাদ সম্মেলনে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ আবদুল হক, সংগঠনের সহ-সভাপতি তাহিদুল হক রিপন, উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য শরিফুজ্জামান শরীফ প্রমুখ আরো উপস্থিত ছিলেন।