পোস্টারের ওপরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। নিচে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয়, মহানগর ওয়ার্ড মিলিয়ে আরো সাত জনের ছবি রয়েছে। মাঝখানে সবাইকে ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়ে ছবি দিয়েছেন পল্টন থানা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের দপ্তর সম্পাদক শহীদুল ইসলাম (নাঈম)। তবে পোস্টারের মধ্যে সবার থেকে নিজের ছবিটিই বড়!
রাজধানীর ফকিরাপুল, দৈনিক বাংলা, পল্টন থেকে শুরু করে আশপাশের এলাকাজুড়ে এখন নাঈমের ঈদ শুভেচ্ছার পোস্টার, বোর্ড শোভা পাচ্ছে। কোথাও বিদ্যুতের খুঁটি, কোথাও গাছে বা দেয়ালে ঝুলতে দেখা গেছে তার শুভেচ্ছা বার্তা। এভাবেই গোটা শহরে এখন দৃষ্টিকটু ঈদ শুভেচ্ছার ছড়াছড়ি। নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডের চিত্র এটি। কোনো নেতা এলাকাবাসীর পক্ষে শুভেচ্ছা জানালেও এলাকার লোকজন কেউ জানেন না তিনি যে সবার পক্ষে শুভেচ্ছার কথা লিখেছেন। মূলত এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই সব নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে পোস্টারের রাজনীতিতে ব্যস্ত এখন অনেকেই।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা ঈদ শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উড়াল সড়ক, দেয়াল, বিদ্যুতের খুঁটি থেকে শুরু করে সবখানেই কম-বেশি ঈদ শুভেচ্ছার পোস্টার শোভা পাচ্ছে। এ ছাড়া শুভেচ্ছা জানাতে অনেকে বেছে নিয়েছেন বিলবোর্ড।
দরজায় কড়া নাড়ছে ঈদুল ফিতর। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে একসময় ছিল ঈদকার্ড। এখন সেটির প্রচলন অনেকাংশে কমে এসেছে। কিন্তু তাই বলে শুভেচ্ছা জানানোর কমতি নেই। এখন বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে শুভেচ্ছাবার্তা। এর মধ্যে এখন অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে পোস্টার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও শুভেচ্ছা বার্তার কমতি নেই।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, প্রচারশিল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় হচ্ছে পোস্টার। পোস্টারের আবির্ভাব হয়েছে মতাদর্শ, তথ্য কিংবা ঘটনা প্রচারের জন্য। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল, অল্প সময়ে পাঠক-দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করা। ইংরেজ শাসন আমলে স্বদেশিরা গোপনে পোস্টার ঝোলাতেন তাদের মতাদর্শ জানানোর জন্য। তবে এসব ছিল হাতে লেখা ও আঁকা। পরবর্তী সময়ে লেটার প্রেসের বদৌলতে পোস্টারের পরিবর্তন আসে।
রাজনৈতিক অঙ্গনে পোস্টার এখন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বিশেষ করে কোনো দলের বার্ষিক জাতীয় সম্মেলন থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে পোস্টারের ব্যবহার বেড়েছে। পাশাপাশি বিলবোর্ড ও ব্যানারের ব্যবহারও বেড়েছে। কিন্তু কোনো কোনো উৎসব এলেই পোস্টার অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় ভিন্ন মাত্রায়।
আর মাত্র কদিন পরই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। এ উৎসবকে ঘিরে শুভেচ্ছা জানাতে ঢাকা শহর পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গেছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের ৭১নং ওয়ার্ডের আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি হাজী মো. বিপ্লব হোসেন ও সাংগঠনিক সম্পাদক ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়ে পোস্টার সাঁটিয়েছেন।
এই পোস্টারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মণি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেকের ছবি প্রকাশ পেয়েছে। তাদের ছবির চেয়ে শুভেচ্ছা জানানো ব্যক্তির ছবির সাইজ বড়।
মাণ্ডা ইউনিয়নের সাবেক ছাত্রলীগ মো. মশিউর রহমানের পোস্টারেও বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবির সঙ্গে কয়েকজনের ছবি সংযুক্ত করা হয়েছে। এই পোস্টারের প্রচারে রয়েছে মাণ্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ। মুগদার এ ওয়ার্ডে ছাত্রলীগ সভাপতির যে ছবি ছাপা হয়েছে সেটিও বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবির চেয়ে বড়। আর এ পোস্টারে অসংখ্য নেতার ছবি সংযুক্ত করা হয়েছে, যা একেবারেই দৃষ্টিকটু।
১ ১জনের ছবি ব্যবহার করে ঈদ শুভেচ্ছার একটি পোস্টার দেখা গেছে মতিঝিল এলাকায়। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. শফিকুল ইসলাম সেন্টু এই পোস্টারের মালিক। সব নেতার থেকে বড় করে নিজের ছবি শোভা পাচ্ছে পোস্টারজুড়ে। বড় কথা হলো তাকে কেন পোস্টারে শুভেচ্ছা জানাতে হবে? এ ব্যাপারে তার মুঠোফোনে কয়েকবার যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন ধরেননি।
ফকিরাপুল সড়কের আইল্যান্ডে থাকা গাছে ঝুলছে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু কিশোর পরিষদের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মাহমুদের ঈদ শুভেচ্ছার পোস্টার। শেখ রাসেলসহ ছয়জনের ছবি শোভা পাচ্ছে তার পোস্টারজুড়ে। সবার থেকে নিজের ছবি বড়, তাই পোস্টারটি দেখতে রীতিমতো দৃষ্টিকটু। সারা বছর রাজনৈতিক নেতারা সংগ্রামের মধ্যে টিকে থাকা গাছগুলোর যত্ন না নিলেও পেরেক ঠুকে ঠিকই পোস্টার ঝুলিয়েছেন।
মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের পক্ষে সাইফুল ইসলাম মাসুদ সেরনিয়াবাতের পহেলা বৈশাখ ও বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা পোস্টার ও বিলবোর্ড ঝুলছে মতিঝিল এলাকাজুড়ে। তিনি শুভেচ্ছা বার্তায় ছয়জনের ছবি ব্যবহার করেছেন। এর মধ্যে নিজের ছবিই সবচেয়ে বড় দেখা গেছে।
আটজনের ছবি ব্যবহার করে শাজাহানপুর মোড়ে বিশাল আকৃতির ঈদ শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন লেখা ব্যানার ঝুলছে বেশ কয়েক দিন ধরেই। ১১নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সভাপতি কামরুজ্জামান বাবুল ও সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন যৌথভাবে এই শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
ঈদ এলেই কেন এত পোস্টার ও বিলবোর্ড? এ প্রশ্নের উত্তরে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবির বলেন, এটা মূলত একটা আবেগের ব্যাপার। তবে হ্যাঁ, অনেকে নিজের অবস্থান জানানোর জন্য ছবি বেশ বড় করে দেন। এটা ঠিক নয়। বিশেষ দিবসে এ ধরনের পোস্টার লাগানোর ব্যাপারে তিনিও মাঝেমধ্যে নেতাদের নিরুৎসাহিত করেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, অনেক নেতাই আছেন না বুঝে ইচ্ছেমতো পোস্টার টানাচ্ছেন। রাজনীতিতে দক্ষতা লাগে। পোস্টারে বড় হওয়া যায় না।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া বলেন, নিজেদের ইচ্ছামতো পোস্টার দিয়ে নগরকে অসুন্দর করা হচ্ছে। বিশ্বের উন্নত যেকোনো শহরে এটা করা মোটেই সম্ভব নয়। রাজনীতিতে অনেকেই নিজের প্রচার নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কারো মাথায় থাকে না নগরের সৌন্দর্য নষ্টের কথা।
এসব পোস্টার শহরকে বেশ কিছুটা অপরিচ্ছন্ন করছে, এ ব্যাপারে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য কর্মকর্তা এয়ার কমডোর সিতওয়াত বলেন, আমরা মাঝেমধ্যে পোস্টারগুলো পরিষ্কার করি। শহরে পোস্টার লাগানোর আগে অনুমতি নেওয়ার নিয়ম থাকলেও অনেকেই নেন না। এ ব্যাপারে আমরা নীতিমালা তৈরি করছি। আশা করি আস্তে আস্তে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।