logo
আপডেট : ২৯ এপ্রিল, ২০২২ ১০:১৭
দেশে আস্থার সংকট
বিপুলসংখ্যক রোগী চিকিৎসা নিতে বিদেশে যান
নিখিল মানখিন

বিপুলসংখ্যক রোগী চিকিৎসা নিতে বিদেশে যান

প্রতীকী ছবি

থামানো যাচ্ছে না চিকিৎসার জন্য বিদেশগামী রোগীর ঢল। আস্থার সংকটে পড়েই প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক রোগী বিদেশে চিকিৎসা করাতে যাচ্ছেন। বিদেশগামী রোগীদের সঙ্গে আলাপ করে এমন তথ্য জানা গেছে। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, তথ্যবিভ্রাটের শিকার হয়ে অনেকে বিদেশে যান। ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসা গ্রহণ করে আত্মতৃপ্তি পেতেই বিদেশে গিয়ে থাকেন। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কেউ কেউ দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। তাদের অনেকে দেশের প্রথম শ্রেণির সব হাসপাতালের খোঁজখবর নেন না। আর অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা বাধ্য হয়েই বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

টাঙ্গাইলের মধুপুরের শ্যামল সরকার (৪৩) গত দেড় বছর ধরে ব্রেইন টিমার সমস্যায় ভুগছেন। রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, ‘বেসরকারি হাসপাতালে রাজি হলেও টিউমার এমন পজিশনে রয়েছে, যা অপারেশন করানো ঝুঁকিপূর্ণ বলে সরকারি নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের চিকিৎসকেরা সার্জারি করাতে অপরাগতা প্রকাশ করেছেন। দেশে সার্জারি করানোর বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেছি।’ শেষ পর্যন্ত ভারতে যাওয়ার পারিবারিক সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান শ্যামল সরকার।

দেশের বাইরে চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সাংবাদিক আরিফ সাওন। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, আমি কোমরে ব্যথা নিয়ে প্রথমে ব্যথার ওষুধ খাই। ব্যথা না কমায় একজন নিউরোলজিস্টকে দেখাই। তিনি কিছু ওষুধ দেন। তাতে অবস্থার উন্নতি হয়নি। পরে ফিজিক্যাল মেডিসিনের ডাক্তার দেখাই। তিনি এমআরআই করিয়ে থেরাপি নিতে বলেন। তাতেও উন্নতি হয়নি। কয়েক মাস পরপর ব্যথার মাত্রা বাড়তে থাকলে অর্থোসার্জনের শরণাপন্ন হই। তিনি নিউরো সার্জনের কাছে পাঠান। রিপোর্ট দেখে অপারেশনের পরামর্শ দেন। এরপর আবার আরেকজন অর্থোপেটিক্সের ডাক্তার দেখাই। তিনি থেরাপির পরামর্শ দেন। কাজ না হলে অপারেশন করতে হবে বলে জানান। যেখানে থেরাপি নিতে গিয়েছি তিনি সবকিছু বাদ দিয়ে নিজের মতো করে ওষুধ লিখেছেন। নিজের মতো করে চিকিৎসা দিয়েছেন। আমার অভিজ্ঞতা হলো যখন যে ডাক্তারের কাছে গিয়েছি, তিনি আগের ডাক্তারের ওষুধ রাখেননি। না রেখে নিজের মতো করে ওষুধ দিয়েছেন। যে ডাক্তার যে বিষয়ে দক্ষ আমার রোগটাও সেই বিভাগের বলে মনে করেছেন তারা। এসব অভিজ্ঞতার কারণে বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান আরিফ সাওন।

ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার বালুপাড়া ইউনিয়নের দরিদ্র কৃষক মো. আবুল কাশেমের স্ত্রী সুফিয়া বেগম কয়েক বছর ধরে পেটের জটিল যন্ত্রণায় ভুগছেন। আবুল কাশেম ভোরের আকাশকে জানান, তার স্ত্রীর পেট ফুলে যাচ্ছে। বিভিন্ন হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করে দেশের একটি হাসপাতালে ডাক্তারের পরামর্শে এন্ডোস্কোপি করান, কিন্তু রোগ শনাক্ত করা যায়নি। তাই ভারতে যাওয়ার সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে বলে জানান আবুল কাশেম। এদিকে চিকিৎসক সংগঠনের নেতারা জানান, দেশের সর্বত্র প্রাথমিক চিকিৎসা সেবার অবকাঠামো বেশ মজবুত। কিন্তু দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রযুক্তিগত দিক এখনো সর্বজনীনভাবে আন্তর্জাতিক মানের হয়ে উঠতে পারেনি। সম্প্রতি রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বলেন, প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে অসংখ্য রোগী চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাচ্ছেন, এর ফলে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছি। রোগীদের বিদেশ যাওয়া রোধ করতে অবশ্যই দেশের চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের প্রচুরসংখ্যক চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে, কিন্তু মানের দিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।

বিষয়টি সম্পর্কে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল সাফী মজুমদার ভোরের আকাশকে জানান, তথ্যবিভ্রাটের শিকার হয়ে অনেকে বিদেশে যান। ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসা গ্রহণ করে আত্মতৃপ্তি পেতেই বিদেশে গিয়ে থাকেন। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কেউ কেউ দেশীয় চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর আস্থা রাখতে পারেন না। তাদের অনেকে দেশের প্রথম শ্রেণির সব হাসপাতালের খোঁজখবর নেন না। আর অনেক ক্ষেত্রে রোগীরা বাধ্য হয়েই বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান।

বিদেশে যাওয়ার পেছনে দেশীয় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রযুক্তিগত দুর্বলতাকে দায়ী করলেন ডক্টর ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদী-ই মাহবুব। তিনি জানান, বাংলাদেশিরা মূলত দুটি কারণে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান। একশ্রেণির মানুষ বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ করে আত্মতৃপ্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন। আর দেশে চিকিৎসা গ্রহণের পরও শারীরিক অবস্থার উন্নতি না ঘটলে ওই রোগী বিদেশে যাওয়ার চিন্তা করে থাকেন। তিনি আরো জানান, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের অবকাঠামো অনেক শক্তিশালী। কিন্তু এখনো দেশের সর্বত্র বেশকিছু জটিল রোগের চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা নেই। শুধু তাই নয়, কিছু জটিল রোগের চিকিৎসা পদ্ধতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়ে গেছে। শুরু হয়েছে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন ও লিভার সংযোজন কার্যক্রম। প্রাথমিক চিকিৎসা নয়, জটিল রোগের চিকিৎসা করানোর জন্যেই মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে পাড়ি জমায়। গবেষণায় দেখা গেছে, সামর্থ্যানুযায়ী মানুষ চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন দেশে গিয়ে থাকেন। এ সামর্থ্যরে মধ্যে তিনটি উপাদান রয়েছেÑ আর্থিক সঙ্গতি, লোকবলের সঙ্গতি, যোগাযোগের সঙ্গতি।

চিকিৎসা সেক্টরের প্রযুক্তিগত দিক আরো শক্তিশালী করার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা প্রদানের ওপর জোর দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত। তিনি বলেন, বাংলাদেশের অনেক হাসপাতাল ইতোমধ্যে মেডিকেল প্রযুক্তিতে উন্নতি লাভ করেছে। এখন বাড়াতে হবে দক্ষ জনবল। আর স্বল্প খরচে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা থেকে জীবন বাঁচানোর মতো সব ধরনের চিকিৎসাসেবাই বাংলাদেশে রয়েছে বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা বৈজ্ঞানিক ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, প্রথমে দেশে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার দিকে নজর রাখতে হবে। দেশের চিকিৎসা অবকাঠামো এমনিতেই বিভাগ থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। তারপর জেলা ও বিভাগ পর্যায়ের প্রথম শ্রেণির চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো অত্যাধুনিক করে সাজাতে হবে। সব রোগের উন্নত চিকিৎসাসেবার নিশ্চয়তা দিতে হবে বলে জানান ডা. মুশতাক হোসেন।

এদিকে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন সূত্রে জানা যায়, ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ভারতে ২০০৯ সালে চিকিৎসা নিতে অন্য দেশ থেকে যত মানুষ গেছেন, এর মধ্যে বাংলাদেশির হার ছিল ২৩.৬ শতাংশ। তখন ৫৭.৫ শতাংশ মেডিকেল ট্যুরিস্টে তালিকার শীর্ষে ছিল মালদ্বীপ। পরবর্তী বছরগুলোয় বাংলাদেশির হার বেড়েছে; বিপরীতে কমেছে মালদ্বীপের। ১০ বছর পর ২০১৯ সালে ভারতে মেডিকেল ট্যুরিস্টদের মধ্যে বাংলাদেশির হার দাঁড়ায় ৫৭.৫ শতাংশ, বিপরীতে মালদ্বীপের হার মাত্র ৭.৩ শতাংশ। বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরামের তথ্য মতে, প্রতি বছর গড়ে ৮ লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান, যাদের বেশিরভাগ যান ভারতে। দ্বিতীয় প্রধান গন্তব্য থাইল্যান্ড। তৃতীয় স্থানে সিঙ্গাপুর। অনেকে ভ্রমণ ভিসায় বিদেশে গেলেও চিকিৎসাও করিয়ে আসেন। ফলে প্রকৃত সংখ্যা কারো পক্ষে জানার সুযোগ নেই। বিবিএসের জরিপ, বাংলাদেশ থেকে বছরে ৪ লাখ ৬০ হাজার মানুষ দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যান। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে, বিদেশগামী বাংলাদেশিদের ৬০.৪১ শতাংশের গন্তব্য ছিল ভারত।