আশঙ্কা থাকলেও এবারের ঈদযাত্রা অনেকটাই স্বস্তিদায়ক। ঈদের আগে বৃহস্পতিবার ছিল শেষ অফিস। অফিস শেষে অনেকই বাড়ির পথে যাত্রা শুরু করেছেন।
গতকাল শুক্রবার সকাল থেকেই মানুষের গন্তব্য ছিল বাড়ির অভিমুখে। এ কারণে রাজধানীর সব রুটেই এখন ঘরে ফেরা মানুষের ভিড়। তবে ঈদযাত্রার তৃতীয় দিন গতকাল ঢাকা নদীবন্দরে নৌপথ থেকে শুরু করে সবখানেই কমবেশি যাত্রীচাপ থাকলেও স্বস্তিতেই সবাই ঘরে ফিরতে পারছেন।
রাস্তায় ফেরিঘাটগুলোতে ভোগান্তি হলেও বেশির ভাগই রুটেই ঈদযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী ২ অথবা ৩ মে পালিত হবে ঈদুল ফিতর। এবারে ঈদের ছুটির সঙ্গে যোগ হয়েছে মে দিবসের ছুটি।
এছাড়া ঈদের আগে পরে সাপ্তাহিক ছুটিসহ মোট ৯ দিনের ছুটি পাচ্ছেন সবাই। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা এবারের আগভাগেই ঘরে ফেরা এবং বাড়তি ছুটি কারণেও ঈদ যাত্রাও অনেকটা স্বস্তিদায়ক হয়ে উঠেছে। হাতে সময় নিয়েই ঘরে ফিরছেন।
এছাড়া স্কুল-কলেজ ছুটি হয়েছে যাওয়ায় শিক্ষার্থী অভিভাবকদের অনেকেই আগেই রাজধানী ছেড়েছেন। ছুটি বেশি পাওয়ায় ঘরে ফেরার সময় অনেক বাড়ছে। ফলে ঈদ যাত্রায় তাড়াহুড়াও নেই করো।
রাজধানীর সেই চিরচেনা যানজটও এখন নেই।
ঈদযাত্রার তৃতীয় দিন শুক্রবার রাজধানীর চিত্র ছিল অনেকটাই ফাঁকা। কোথাও যানজট ছিল না। গাবতলী ও সায়েদাবাদ ও মহাখালি বাসস্ট্যান্ডগুলোতেও যাত্রী চাপ লঞ্চ স্বাভাবিক ছিল।
এছাড়াও ঈদ যাত্রার আগে রাস্তায় বিশৃঙ্খলা এড়াতে নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ। সরকারের এই পদক্ষেপের সুফল পাচ্ছেন নাড়ির টানে ঘরে ফেরা মানুষেরা।
এদিকে গতকাল সকাল থেকেই সদরঘাট নদীবন্দরে ঘরমুখো মানুষের ভিড় দেখা গেছে। কোনো কোনো লঞ্চ বাড়তি যাত্রী নিয়ে উত্তরের বিভিন্ন পথে যাত্রা করে। সাধারণ যাত্রীদের কেউ কেউ বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন।
তবে নৌ নিরাপত্তা বাড়ানোর তাগিদ সাধারণ মানুষের। আর লঞ্চ মালিকরা বলছেন, এবারো এখনো যাত্রী চাপ তেমন হয়নি। আগামীকাল গার্মেন্টস ও বেসরকারি অফিস ছুটি হলে যাত্রী বাড়তে পারে বলে জানান তারা।
ভোলার চরফ্যাশন অভিমুখী এমভি কর্ণফুলী-১২ লঞ্চের যাত্রী ছিলেন কামাল হোসেন। কিন্তু অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে লঞ্চে উঠতে পারেননি। তিনি জানান, দুপুরে পর প্রচুর যাত্রী চাপ ঘাটে। লঞ্চের টিকিট কেটেও উঠতে পারলাম না। এতো মানুষের ভিড় কোনোভাবেই লঞ্চে উঠতে পারিনি।
এখন পরবর্তী লঞ্চের জন্য অপেক্ষা করছি। যাত্রীদের যে ভিড় সন্ধ্যার দিকেও উঠতে পারব কিনা সন্দেহ।
তবে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় থাকলেও পর্যাপ্ত সংখ্যক লঞ্চ যাত্রার জন্য তৈরি হয়েছে বলে জানায় বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ যুগ্ম পরিচালক (বন্দর) আলমগীর কবির সাংবাদিকদের বলেন, ঈদযাত্রার জন্য ১৫০টিরও বেশি লঞ্চ প্রস্তুত করা হয়েছে।
বিকেলে ৫০টি লঞ্চ বিভিন্ন গন্তব্যে ঘাট ছেড়ে গেছে। আর ৭০টি লঞ্চ প্রস্তুত রয়েছে যাত্রীদের জন্য। যাত্রীদের জন্য কোনো লঞ্চ সংকট হবে না।
এদিকে আগত যাত্রীদের যাত্রা নির্বিঘ্ন করার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে নৌ পুলিশ। সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছে নৌ পুলিশ। বিষয়ে নিয়ে সদরঘাট নৌ পুলিশ থানার ওসি কায়ুম আলী সরদার বলেন, যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।
এছাড়া ঈদযাত্রায় জননিরাপত্তার কোনো ঘাটতি না থাকে সেদিকেও আমাদের নজর রয়েছে। অপরাধীরা মানুষের ভিড় দেখে যেন কোনো ধরনের অপরাধ না করতে পারে সেদিকে আমাদের কঠোর নজরদারি রয়েছে।
করোনাকালে ঈদে ঘরে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। মহামারির কারণে বিগত দুই বছরের ঈদে ঘরে ফিরতে পারেনি কেউ। এই সময়কালে রাজধানীতেই অনাড়ম্বর পরিবেশে ঈদ যাপন করতে হয়েছে। ঘরে বসেই নামাজ আদায়।
ঈদের খুশিও ছিল অনেকটা ঘরবন্দি। সেই পরিস্থিতি এবার আর নেই। করোনা মহামারি এখন শূন্যের কোটায়। ফলে দুই বছর পর প্রিয়জনের সঙ্গে এবার প্রথম ঈদ করার সুযোগ পাচ্ছেন রাজধানীবাসী। এজন্য রয়েছে বাড়তি আনন্দ।
এ কারণে আশঙ্কা ছিল এবার ঈদযাত্রায় ভোগান্তি অনেক গুণ বেড়ে যেতে পারে। তবে ঈদযাত্রার শুরুতেই আশঙ্কার বদলে যোগ হয়েছে স্বস্তিদায়ক ঘরে ফেরার আনন্দ।
ঈদে ঘরমুখো মানুষের যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সরকারের পক্ষ থেকেই নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে রাজধানীর বিভিন্ন বাসটার্মিনাল পরিদর্শন করেছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, বিগত যে কোনো সময়ের তুলনায় এবার দেশের সড়ক-মহাসড়ক অনেক ভালো বলে উল্লেখ করেন। এছাড়াও নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী এ দিন শিমুলিয়া ঘাট পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে চাপ ও বিড়ম্বনা এড়াতে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাট ব্যবহারের পরামর্শ দেন।
গতকাল সরেজমিন দেখা গেছে গাবতলীতে যাত্রী চাপ নেই বললেই চলে। দূরপাল্লার বিভিন্ন রুটে সঠিক সময়ে গন্তব্যস্থলে উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। শুধুমাত্রা যারা অগ্রিম টিকিট নিয়েছিলেন তারাই মূলত এ দিন রাজধানী ছেড়েছেন।
এর বাইরে বাড়তি যাত্রীর চাপ এই বাস টার্মিনালে লক্ষ্য করা যায়নি। টিকিট ছাড়া অন্য যাত্রীর চাপ তুলমামূলক অনেক কম দেখা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাত্রী সংকটের কারণে অনেক বাসযাত্রা বাতিল করা হয়েছে। অনেক সিট খালি রেখেই বাস ছাড়তে হয়েছে, যা ঈদের সময়ে অন্যান্য বছরের তুলনায় অকল্পনীয়।
এদিকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত সাভার ও আশুলিয়ার সড়ক-মহাসড়কগুলোতে গাড়ির চাপ থাকলেও যানজটের কোনো চিত্র দেখা যায়নি। ঈদুল ফিতরের সময়টুকু প্রিয়জনের সঙ্গে কাটাতে স্বস্তিতেই এখন পর্যন্ত বাড়ি ফিরছেন যাত্রীরা।
এদিকে উত্তরবঙ্গগামী ঘরমুখো মানুষদের ভোগান্তি কমাতে বঙ্গবন্ধু সেতুতে টোল আদায়ের জন্য স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ লেন বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এই রুটে গতকাল সকাল থেকেই সেতুর পূর্ব প্রান্তের গোলচত্বর থেকে টোলপ্লাজা পর্যন্ত মোটরসাইকেলের দীর্ঘ লাইন লেগে গেছে। এতে করে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মোটরসাইকেলের যাত্রী ও চালকদের।
এদিকে ঈদকে কেন্দ্র করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বেড়েছে গাড়ির চাপ। তবে শুক্রবার ঈদযাত্রায় কোনো যানজট সৃষ্টি হয়নি। এতে করে কোনো রকমের ভোগান্তি ছাড়াই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন যাত্রীরা।
তবে ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জ অংশে ৬৭০ জন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
কাঁচপুর হাইওয়ে থানার ওসি মো. নবীর হোসেন বলেন, স্বাভাবিকভাবে এই মহাসড়কে ২০ থেকে ২৫ হাজার গাড়ি চলাচল করলেও বৃহস্পতিবার থেকে এই মহাসড়ক দিয়ে তার চেয়ে বেশি গাড়ি চলাচল করেছে। ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তি নিরসনে প্রতিটি পয়েন্টে পর্যাপ্ত পুলিশ ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে।
এদিকে গতকাল সকাল থেকে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়াঘাটে ঘরমুখো মানুষ ও যানবাহনের চাপ বেড়েছে। ভোর থেকে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার ও মাঝিকান্দি নৌরুটে পদ্মা পাড়ি দিতে ঘাটে আসছে হাজার হাজার মানুষ।
বাড়তি যানবাহনের চাপে হিমশিম খাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। তবে ফেরি কম থাকায় বিপুল সংখ্যক যানবাহন পারপারে বেশি সময় লাগছে। এতে ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে যাত্রীদের।
এদিকে ট্রেন যাত্রায় দুই দিন শিডিউল বিপর্যয় হলে শুক্রবার থেকে ট্রেন যাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। ঈদযাত্রার তৃতীয় দিনে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে নির্ধারিত শিডিউল অনুযায়ী ছেড়ে গেছে বেশির ভাগ ট্রেন।
সকাল থেকে ২০ জোড়া ট্রেন কমলাপুর রেলস্টেশন ছেড়ে গেছে। এ সময় প্রতিটি বগিতে ছিল যাত্রী চাপ।