করোনা সংকট থেকে গাঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। দুই বছর ধরে অনেক মানুষের আয়-রোজগার কমেছে। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা অনেকেই এবার নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছেন। ৭০ শতাংশের বেশি মানুষকে করোনার টিকার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে বলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া বেগবান হচ্ছে।
আর বিগত দুটি জাতীয় বাজেটেই অর্থনীতিকে প্রণোদিত করতে জিডিপির ৬ শতাংশের মতো অর্থপ্রবাহের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এমন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস দেখাচ্ছে। তবে এরই মধ্যে হঠাৎ করে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি অস্থির হয়ে উঠেছে। কোভিড-১৯-এর ফলে ভেঙে পড়া সরবরাহ চেইন মেরামত করার উদ্যোগ নিচ্ছিল সারা বিশ্ব। এরই মধ্যে এই যুদ্ধ শুরু হওয়ায় এই সরবরাহ চেইন বেশ নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। জাহাজ পরিবহন খরচ কয়েক গুণ বেড়েছে। ইনস্যুরেন্স তথা ঝুঁকি খরচও বেড়েছে। ফলে খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের আমদানি ব্যয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিশ্ব খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৩ শতাংশ বেড়েছে বলে এফএও জানিয়েছে।
এসবের প্রভাব আমাদের ওপরও পড়েছে। তাই আমদানি করা খাদ্যপণ্যের দাম বেশ বেড়েছে। সরকার কম দামে খাদ্য সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি প্রচলিত সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোও চালু রয়েছে। বিশেষ বিশেষ কর্মসূচি আরো প্রসারিত করার কথাও সরকার ভাবছে। কৃষি আমাদের রক্ষাকবচ। তাই কৃষির জন্য সরকার যা লাগে, তা-ই করতে প্রস্তুত । অন্যদিকে প্রবাস আয়ের ধারা অক্ষুণœ রাখতে বাড়তি প্রণোদনারও প্রয়োজন রয়েছে। আর রপ্তানি খাতের চাঙ্গা ভাব ধরে রাখার জন্য এ খাতে আগে থেকে দেওয়া বাজেটারি সুবিধা চালু রাখতেই হবে। অন্যদিকে তেল আমদানি খরচও বেড়েই চলেছে। তাই তেলের জন্য দেওয়া ভর্তুকিও অক্ষুণœ রাখতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে খুবই ভেবেচিন্তে আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেট প্রণয়ন করতে হচ্ছে সরকারকে। আমদানি বাড়ায় রাষ্ট্রের আয় এখন বাড়ন্ত। তবু সব কিছুর দাম বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আয় বুঝে ব্যয় করার সংস্কৃতি জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই। তাই আসন্ন বাজেট হতে যাচ্ছে খুবই সাবধানি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচন করতেই হবে। অথচ করোনায় বিপর্যস্ত অর্থনীতির চাহিদা সম্প্রসারণমূলক বাজেট। কেননা বাড়তি কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যও আমাদের পূরণ করতেই হবে। এই দুটি চাহিদার টানাপড়েনের মধ্যে কেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ বাজেট দেবেন মাননীয় অর্থমন্ত্রী, তা-ই দেখার অপেক্ষায় আছি।
এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে বাজেটের আকার ও বিভিন্ন সূচক নিয়ে বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির বৈঠক হয়ে গেছে। এই সভা সূত্রে আসন্ন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট কেমন হতে যাচ্ছে তার কিছুটা ধারণা পাওয়া গেছে। জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ৭.২ শতাংশের খানিকটা বেশি। মহামারি সত্ত্বেও আমাদের প্রবৃদ্ধি অন্য বেশির ভাগ দেশের তুলনায় যে ‘রেজিলিয়েন্স’ দেখিয়েছে, তাতে এই প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাকে খুবই অর্জনযোগ্য বলে মনে করি। ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার কবলে না পড়লে এই লক্ষ্যমাত্রা ৮ শতাংশ বা তারও বেশি হতে পারত। আসন্ন বাজেটের আকার ধরা হচ্ছে প্রায় ছয় লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে বেড়েছে ১২ শতাংশেরও বেশি। তবে জিডিপির শতাংশ হিসেবে বাজেটের অনুপাত কিন্তু কমছে। চলতি বছরে ১৭.৫ থেকে আসন্ন অর্থবছরের বাজেট কমে হতে পারে জিডিপির ১৫.৪ শতাংশ। এই যে ২ শতাংশ কমে যাওয়া—এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, আমাদের নীতিনির্ধারকরা বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রতি সংবেদনশীল থেকেই সাধারণত যে হারে এক অর্থবছর থেকে অন্যটিতে বাজেটের আকার বাড়ানো হয়, সে পথে হাঁটেননি।
কিছুটা সংকোচনমুখী নীতির আভাস পাওয়া গেলেও সরকার করোনাপরবর্তী চাহিদার বিষয়েও সচেতন রয়েছে। এ কারণেই আসন্ন বছরের বাজেটের আকার বরাবরের মতো হারে বৃদ্ধি না পেলেও বাজেট ঘাটতি কিন্তু আড়াই লাখ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫.৫ শতাংশ। প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদরা বরাবরই বিপর্যয়কালে বাজেট ঘাটতি নিয়ে বেশি ভাবিত না হওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন। আমি করোনাকালের দুটি বাজেটেই ঘাটতি গতানুগতিক ৫ থেকে আরো ১-২ শতাংশ বাড়ানোতেও কোনো বড় ঝুঁকি নেই বলেছিলাম। আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক শক্তি ও দায় শোধের যে ইতিবাচক ট্র্যাক রেকর্ড আছে তার ভিত্তিতেই এমন বলেছি। এবার বাজেট ঘাটতি ৫.৫ শতাংশ রেখে করোনাপরবর্তী এবং ইউক্রেন যুদ্ধকালীন সংকট মোকাবেলার যে নীতি-কৌশল দেখা যাচ্ছে, সেটিকে ইতিবাচক ও সময়োপযোগীই বলব। কাজেই বলা চলে যে বাজেটের আকার খুব বেশি না বাড়িয়ে যেমন বিদ্যমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিষয়ে সরকারের সচেতনতা প্রতিফলিত হয়েছে, তেমনি বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের নিচে নামানোর উদ্যোগ না নেওয়ার মাধ্যমে পুনরুদ্ধারকালীন অর্থনৈতিক চাহিদার প্রতি নীতিনির্ধারকদের সংবেদনশীলতার প্রমাণ মিলছে।
আসন্ন অর্থবছরের বাজেটের তথ্যাদি এখনো বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তবে অর্থ বিভাগের বরাতে পাওয়া প্রাথমিক তথ্যগুলোরই আরেকটু বিশ্লেষণ করার সুযোগ রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, পুরো বাজেটের আকার চলতি বছরের তুলনায় ১২ শতাংশের বেশি বাড়ার সম্ভাবনা থাকলেও সে তুলনায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিগুলোর আকার কম বাড়বে বলে মনে হচ্ছে (বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির বৈঠকের তথ্য অনুসারে ৯ শতাংশের কম বৃদ্ধি হবে)। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম তো বাড়ছে। কারণগুলো শুরুতেই বলেছি। এই বাস্তবতায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আকার আরো বড় হওয়া দরকার বলে মনে করছেন কেউ কেউ। এটা মানতে হবে, এ ক্ষেত্রে কিছুটা সংকোচনের পথে সরকারকে হাঁটতে হচ্ছে। তবে সঙ্গে এটাও স্মরণে রাখা দরকার যে পদ্মা সেতুসহ অনেক মেগাপ্রকল্পই কিন্তু প্রায় শেষের পথে। এ অবস্থায় এমনিতেও উন্নয়ন আগের গতিতে বাড়বে-এমন আশা করা ঠিক নয়। এ ছাড়া বেশ কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প কাটছাঁট করার উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে এ কথা বলা যায় যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির এই তুলনামূলক কম প্রবৃদ্ধি নিয়ে আদতে খুব বেশি ভাবিত হওয়ার কিছু নেই। আর এটাও তো সবারই জানা, আমাদের উন্নয়ন কর্মসূচিগুলোর ব্যয় যে প্রায়ই বাস্তবায়নে সময় বেশি লাগার কারণে বেড়ে যাচ্ছে। তাই তা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকার ব্যাপক সচেষ্ট রয়েছে। এই বাস্তবতায় উন্নয়ন বরাদ্দের কিছুটা লাগাম টেনে ধরা দরকার। এবারের এডিপিতে সেটাই খানিকটা ঘটেছে।
আয় বুঝে ব্যয় করার উপলব্ধি থেকেই এই বাস্তবমুখী বাজেট পেশ হতে যাচ্ছে বলা চলে। সংসদে উত্থাপনের পর এ নিয়ে বিশদ তথ্য পাওয়া যাবে।
স্বাস্থ্য বাজেটের আকার বৃদ্ধির একটি সময়োচিত দাবি নাগরিক সমাজ ও গবেষকদের দিক থেকে ধারাবাহিকভাবে করা হচ্ছে। বিশেষত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বাবদ সরকারি ব্যয় বাড়ানো গেলে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য ‘আউট অব পকেট কস্ট’ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমানো সম্ভব। অথচ স্বাস্থ্যের বরাদ্দের অর্ধেকের মতো যায় যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে, সেখানে দেওয়া বরাদ্দের মধ্যে গড়ে প্রায় অর্ধেক অব্যয়িত থাকছে। স্বাস্থ্য বিপর্যয় সামাল দিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে-এটি সত্য। তবু দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে এই মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর বাজেট বাস্তবায়ন দক্ষতা বাড়ানোর সময় বয়ে যাচ্ছে। অন্য মন্ত্রণালয়গুলোর জন্যও এ কথাগুলো কমবেশি প্রযোজ্য। যে মন্ত্রণালয়গুলো বাজেট বাস্তবায়নে তুলনামূলক বেশি দক্ষতা দেখাচ্ছে, তাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েই এ ক্ষেত্রে এগোনো যাবে। আবার একই মন্ত্রণালয়ের যে ধরনের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে বেশি সফলতা আসছে, সেগুলো থেকেও শেখার সুযোগ আছে। আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ তো আছেই। তবে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার চমৎকার ট্র্যাক রেকর্ডও আমাদের আছে।
বাজেট সম্পর্কে এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের মধ্যে আলাদা করে ইতিবাচক মনে হয়েছে এনবি আরের রাজস্ব আহরণের গতি বৃদ্ধির বিষয়টি। অর্থ বিভাগ জানাচ্ছে, চলতি বছরের শুরুতে রাজস্ব আহরণে কাক্সিক্ষত গতি না দেখা গেলেও দ্বিতীয়ার্ধে এসে নাটকীয় উন্নতি হয়েছে। এনবি আরের আয় বাড়ছে বলেই চলতি বছরের তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার যে লক্ষ্যমাত্রা তাদের জন্য রয়েছে, তা আসন্ন অর্থবছরে বাড়িয়ে তিন লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। এই দুর্যোগকালে বাড়তি রাজস্ব দেশ পরিচালনার জন্য আসলেই দরকার। তবে আসন্ন অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রাটিও কিন্তু জিডিপির শতাংশ হিসেবে ১০ শতাংশের নিচে থেকে যাচ্ছে। আমরা বেশ কয়েক বছর ধরেই বলে আসছি যে দেশের অর্থনীতি যে হারে বলশালী হচ্ছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর-জিডিপি অনুপাত ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হওয়া চাই। এ জন্য এনবি আরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, রাজস্ব আদায় পদ্ধতি ডিজিটাল করতে হবে এবং যথাযথ কর প্রদানে নাগরিকদের উৎসাহিত করার উদ্যোগও নেওয়া চাই। এ ছাড়া ছোট ছোট নীতি-উদ্যোগ বাজেটের মাধ্যমে নেওয়া গেলেও স্বল্প থেকে মধ্য মেয়াদে তার সুফল মিলবে। একটি উদাহরণ দেওয়া যায়, চলতি বছরের চেয়ে আসন্ন অর্থবছরে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো বেশি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হচ্ছে এনবিআরের জন্য। সিগারেটসহ অন্যান্য তামাকপণ্যের ওপর সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপসহ কার্যকর করারোপের যে প্রস্তাবগুলো তামাকবিরোধী নাগরিক সংগঠন ও গবেষকদের দিক থেকে আছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলেই এনবি আর আরো ৯ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পেতে পারে (পাশাপাশি তামাক ব্যবহারের হারও কমানো যাবে)। অর্থাৎ বাড়তি রাজস্বের যে লক্ষ্য আছে তার এক-চতুর্থাংশের মতো আসতে পারে তামাকপণ্যে যথাযথ করারোপ থেকেই। একই সঙ্গে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার যে অঙ্গীকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করেছেন, তা বাস্তবায়নের দিকেও আরো এক কদম হাঁটতে পারব আমরা।
নিজেদের অর্থনৈতিক, সঙ্গে সম্ভাবনা ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে একটি সময়োপযোগী বাজেট প্রণীত ও বাস্তবায়িত হবে বলেই মনে করি। আয় বুঝে ব্যয় করার ভাবনা থেকে তৈরি আসন্ন অর্থবছরের বাজেটটি বাস্তবায়নে সব পক্ষ সমন্বিতভাবে কাজ করে আমাদের পুনরুদ্ধারের পথটি মসৃণতর এবং আরো ‘রেজিলিয়েন্ট’ করবে-এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করে শেষ করছি।
লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর