অরণ্য, পাহাড়, ঝরনা আর হ্রদের শহর রাঙামাটি এখন পুরোদমে প্রস্তুত পর্যটকদের বরণ করে নিতে। পর্যটকদের আগমন ঘিরে নিরাপদ ভ্রমণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ প্রয়োজনীয় সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টরাও। সব মিলিয়ে চাঙা হচ্ছে রাঙামাটির পর্যটন শিল্প।
মূলত যান্ত্রিক শহুরে ক্লান্তি দূর করতে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসেন রাঙামাটি। বিনোদনের খোঁজে পাহাড়ে আসা পর্যটকদের আনন্দ আর উচ্ছলতা সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ভুলিয়ে দিচ্ছে জীবনের নানা জটিলতা। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে দুই দফায় লকডাউনে থমকে যায় রাঙামাটির পর্যটন ব্যবসা।
এখন উল্লেখযোগ্য হারে পর্যটকের আগমন ঘটায় এরই মধ্যে আড়মোড়া ভেঙে সতেজ হতে শুরু করেছে পর্যটন ব্যবসা। এতে পর্যটন এলাকায় বেড়েছে নিত্যদিনকার কোলাহল ও কর্মচাঞ্চল্য। স্বস্তি ফিরেছে ব্যবসায়ীদের মাঝে।
আগামী ২৯ এপ্রিল থেকে টানা ৭ দিনের সরকারি ছুটি। ফলে গত দুই বছরে অনেকটাই ‘বন্দি অবস্থা’ থেকে মুক্তির স্বাদ নিতে এই বন্ধের সুযোগটিকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে চাইছেন ভ্রমণপিপাসুরা। প্রকৃতিপ্রেমিদের প্রথম পছন্দের তালিকায় রয়েছে পাহাড় আর সমুদ্র। বিপুল সংখ্যক পর্যটক এরই মধ্যে আগাম বুকিং দিয়ে রেখেছেন রাঙামাটি ও সাজেকের হোটেল, মোটেল ও কটেজ। ফলে ঈদ মৌসুমজুড়ে পর্যটন ব্যবসা চাঙা থাকবে বলে আশা করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
রাঙামাটিতে পর্যটন কমপ্লেক্স ও সুভলং ঝর্ণা মিলে দুটি সরকারি পর্যটন স্পট রয়েছে। এছাড়া বেসরকারিভাবে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা ৫০টি হোটেল-মোটেল ও ১৭টি ইকো রিসোর্ট ও বেশ কয়েকটি পর্যটন স্পট আছে। সেখানে প্রতিনিয়ত ভিড় জমান ভ্রমণে আসা পর্যটকরা। পর্যটন কমপ্লেক্সের অধীন দুটি হোটেল-মোটেল, ছয়টি কটেজ রয়েছে। এসব হোটেল-মোটেলে রয়েছে ৮৮টি কক্ষ। এতে প্রতিদিন তিন হাজার অতিথি হোটেল-মোটেলে থাকতে পারে।
পর্যটকদের সেবা দিতে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে চার শতাধিক। নৌভ্রমণের জন্য রয়েছে ৬ শতাধিক স্বল্প ও দ্রুতগতির নৌযান। পর্যটন স্পটগুলোতে সড়ক ও নৌপথে পর্যটকদের সহজে যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে। তাই আসন্ন ঈদকে ঘিরে এরই মধ্যে পর্যটকদের বরণে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাঙামাটিতে পর্যটকদের মূল আকর্ষণ ৩৩৫ ফুট দৈর্ঘ্যরে ঝুলন্ত সেতুকে ঘিরেই। তাই পর্যটকেরা প্রথমেই ছুটে যান পর্যটন কমপ্লেক্স এলাকায়। বছরে প্রায় দুই লাখ দেশি ও বিদেশি পর্যটক সেতুটি দেখতে আসেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে পর্যটকদের উপচেপড়া ভিড় থাকে। পছন্দের তালিকায় আছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গড়ে ওঠা শহরের পুলিশের ‘পলওয়েল পার্ক’, ডিসির ‘রাঙামাটি পার্ক’ সেনাবাহিনীর ‘আরণ্যক’ কাপ্তাইয়ে বিজিবি’র ‘ঝুম রিসোর্ট। এছাড়া হালের আকর্ষণ ‘সাজেক ভ্যালি’ পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি টানছে। সেখানে ১০৬টি কটেজ-রিসোর্ট রয়েছে।
আকর্ষণের তালিকায় আছে কাপ্তাই, রাঙামাটি-কাপ্তাই সড়কে বড়াদাম এলাকায় গড়ে ওঠা ইকো রিসোর্ট ‘বড়গাঙ’ ‘বারগী’, ‘রাইন্যা টুগুন’।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হোটেল-মোটেল, রেস্টুরেন্ট (খাবারের দোকান), টেক্সটাইল (পাহাড়িদের তৈরি কাপড়), সড়ক ও নৌযান এবং বিনোদন কেন্দ্রকে (বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান) ঘিরেই মূলত পাহাড়ের পাঁচ পর্যটন খাত। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে দুই দফায় পর্যটকদের আগমন না থাকায় তাঁত ও হস্তশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত কয়েক হাজার মানুষও আর্থিক সংকটে পড়েন। বিশেষ করে স্থানীয় পাহাড়িদের কোমর তাঁতে তৈরি কাপড়, পোশাক, বাঁশ ও বেতের তৈরি হস্তশিল্পে উৎপাদিত জিনিসপত্র বিক্রি বন্ধ হয়ে পড়ায় উৎপাদনও হ্রাস পায়।
ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে স্থানীয় অর্থনীতিতেও। তখন সব মিলিয়ে জেলা শহরে পর্যটনের পাঁচটি খাতে দিনে গড়ে অন্তত দেড় কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
পর্যটন টুরিস্ট বোট মালিক সমিতির বোট ঘাটের সহকারী ব্যবস্থাপক মো. করিম বলেন, ‘আমরা সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। আশা করছি, এই ঈদ মৌসুমে পর্যটন চাঙা হবে।’
বোট মালিক মো. হাসান সুমন বলেন, ‘গত দুই বছরে করোনার কারণে টুরিস্ট আসেনি। ব্যবসায় মন্দা গেছে। আশা করছি, এই ঈদে পর্যটক আসলে ভালো আয় হবে।’
রাঙামাটি আবাসিক হোটেল-মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও হোটেল ড্রিমওয়ের মালিক মোস্তফা কামাল উদ্দিন বলেন, ‘করোনার লকডাউনে দুই দফায় মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দা পার করেছি। ঈদ মৌসুম আগামী ২৯ এপ্রিল থেকে টানা ৭ দিনের ছুটিতে পর্যটন ব্যবসা চাঙা থাকবে বলে আশা করছি।’
রাঙামাটি পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বড়ুয়া বলেন, ‘আমরা পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। আমাদের অঙ্গনকে সাজিয়েছি। মেরামত কার্যক্রমও সম্পন্ন করেছি। এখন পর্যন্ত আমাদের ৭০ শতাংশ বুকিং হয়ে আছে। অনলাইনেই বুকিং দিচ্ছেন পর্যটকরা। আমরা আশা করছি, ঈদে ভালো সমাগম হবে এবং পর্যটকেরা আনন্দ উৎসবে মেতে উঠবেন।’