সরকারি সতর্কবাতার পরও অবাধে চলছে ভুয়া ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের অসাধু ব্যবসা। এমন চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে দেশে কার্যকর ও নিয়মিত অভিযান নেই বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সতর্কবার্তা দিয়েই দায়িত্ব শেষ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি)। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নসহ (র্যাব) কয়েকটি সংস্থার অভিযান কার্যক্রমও চলে সীমিত পরিসরে।
তাদের পক্ষে অলিগলিতে বসে থাকা মোট ভুয়া ডিগ্রিধারী চিকিৎসকের ১০ ভাগের কাছেও পৌঁছা সম্ভব হয়ে ওঠে না। স্বীকৃত পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসকদের কেউ কেউ নিজেকে ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন, যা বিএমডিসি আইনের পরিপন্থি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সাইনবোর্ড, প্রেসক্রিপশন প্যাড, ভিজিটিং কার্ড ইত্যাদিতে ‘বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক’ লেখা দেখে চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রত্যাশিত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন রোগীরা।
পাশাপাশি ন্যূনতম এমবিবিএস অথবা বিডিএস কোর্স সম্পন্ন না করেও অনেকে তাদের নামের পূর্বে ‘ডাক্তার’ পদবি ব্যবহার করে যাচ্ছেন। এতে একদিকে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা হয়ে পড়ছে প্রশ্নবিদ্ধ; অন্যদিকে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন অনেক রোগী। রোগী ও তাদের স্বজনরা পড়ছেন আর্থিক এবং শারীরিক ক্ষতিতে।
বিএমডিসি কিংবা একাডেমিক সনদধারী কোনো রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ছিলেন না তারা। কিন্তু রোগীদের কাছে তাদের পরিচয় ছিল ডিগ্রিধারী বড় ডাক্তার। চিকিৎসা প্রদানের নামে রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই ছিল তাদের বড় কাজ। সম্প্রতি কুমিল্লা জেলার সদর উপজেলায় পৃথক স্থানে অভিযান চালিয়ে এমনই ৫ ভুয়া চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
র্যাব-১১, সিপিসি-২, কুমিল্লার কোম্পানি অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ভুয়া ডিগ্রিধারী চিকিৎসকরা লোকজনকের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে মামলা করার পর তাদের আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
আরেকটি ঘটনায় চীনের তাইশান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিবিএস পাসের ভুয়া সনদধারী সাত চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ভুয়া ১২ চিকিৎসক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) দুই কর্মকর্তাসহ মোট ১৪ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। এভাবে ভুয়া ডিগ্রি ব্যবহারকারী ও ভুয়া চিকিৎসকদের অপতৎপরতা সারা দেশে অবাধে চলছে।
এ দিকে বিএমডিসি আইনের কিছু অংশ উল্লেখ করে চিকিৎসকদের বারবার সতর্ক করে দেয় বিএমডিসি। ২০২১ সালে বিএমডিসির সর্বশেষ সতর্কীকরণ বার্তায় বলা হয়, স্বীকৃত ডিগ্রিপ্রাপ্ত অনেকে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের নিবন্ধন ব্যতীত চিকিৎসা কার্য পরিচালনা করছেন।
কোনো কোনো নিবন্ধিত চিকিৎসক বা দন্তচিকিৎসক তাদের সাইনবোর্ড, প্রেসক্রিপশন প্যাড, ভিজিটিং কার্ড ইত্যাদিতে, পিজিটি, এফসিপিএস (পার্ট-১, ২), এমডি (ইন কোর্স, পার্ট-১, ২, থিসিস পর্ব), এমএস (পার্ট-১, ২, থিসিস পর্ব, সিসি) ইত্যাদি ব্যবহার করছেন, যা কোনো স্বীকৃতি অতিরিক্ত চিকিৎসা যোগ্যতা নয়।
তাছাড়া স্বীকৃত পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, সার্জারি বিশেষজ্ঞ, গাইনি বিশেষজ্ঞ, শিশু বিশেষজ্ঞ, চক্ষু বিশেষজ্ঞ ইত্যাদি ব্যবহার করছেন, যা বিএমডিসি আইনের পরিপন্থি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আবার কোনো কোনো চিকিৎসক তাদের ব্যবস্থাপত্রে এমন কিছু ওষুধ লিখছেন, যা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ।
নিবন্ধিত চিকিৎসকদের উপরোল্লিখিত আইনপরিপন্থি কাজ হতে বিরত থেকে যথাযথাভাবে অনুসরণকরত চিকিৎসা কার্য পরিচালনা করার জন্য জানানো হয় বিএমডিসির অফিসিয়াল বিজ্ঞপ্তিতে।
বিএমডিসি আইনের ২২(১) ধারা অনুযায়ী, নিবন্ধন ব্যতীত এলোপ্যাথি চিকিৎসা নিষিদ্ধ। অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, এ আইনের অধীনে নিবন্ধন ব্যতীত কোনো মেডিকেল চিকিৎসক বা ডেন্টাল চিকিৎসক এলোপ্যাথি চিকিৎসা করতে অথবা নিজেকে মেডিকেল চিকিৎসক বা ক্ষেত্রমতো ডেন্টাল চিকিৎসক বলে পরিচয় প্রদান করতে পারবেন না। কোনো ব্যক্তি এ ধারা লঙ্ঘন করলে ওই লঙ্ঘন হবে একটি অপরাধ এবং তার জন্য তিনি ৩ বছর কারাদণ্ড অথবা ১ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। ২৯(১) ধারা অনুযায়ী ভুয়া পদবি ইত্যাদি ব্যবহার নিষিদ্ধ।
এ আইনের অধীন নিবন্ধনকৃত কোনো মেডিকেল চিকিৎসক বা ডেন্টাল চিকিৎসক এমন কোনো নাম, পদবি, বিবরণ বা প্রতীক এমনভাবে ব্যবহার বা প্রকাশ করবেন না, যার ফলে তার কোনো অতিরিক্ত পেশাগত যোগ্যতা আছে মর্মে কেউ মনে করতে পারে। যদি না তা কোনো স্বীকৃত মেডিকেল চিকিৎসা-শিক্ষা যোগ্যতা বা স্বীকৃতি ডেন্টাল চিকিৎসা শিক্ষা যোগ্যতা হয়ে থাকে।
ন্যূনতম এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রিপ্রাপ্তরা ব্যতীত অন্য কেউ তাদের নামের পূর্বে ‘ডাক্তার’ পদবি ব্যবহার করতে পারবে না। কোনো ব্যক্তি এ উপধারা লঙ্ঘন করলে ওই লঙ্ঘন হবে একটি অপরাধ এবং তার জন্য তিনি ৩ বছর কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা অর্থ দণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং ওই অপরাধ অব্যাহত থাকলে প্রত্যেকবার তার পুনরাবৃত্তির জন্য অন্যূন ৫০ হাজার টাকা অর্থ দণ্ডের অতিরিক্ত হিসেবে দণ্ডনীয় হবেন।
বিএমডিসি সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, ভুয়া ডিগ্রি ব্যবহারকারী ও ভুয়া চিকিৎসকদের বিচ্ছিন্ন খবর বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে পেয়েছি। বিএমডিসিতে এমন বেশকিছু অভিযোগে এসেছে। বিদ্যমান আইনের মাধ্যমে আমরা সেগুলোর সুরাহা দিয়ে থাকি। তবে সরকারি অভিযান ও ডিজিটালাইজেশনের কারণে এমন অপতৎপরতা অনেক কমেছে।
এ দিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের সর্বত্র চলছে বিএমডিসি আইনের লঙ্ঘন। স্বীকৃত চিকিৎসা থেকে ডাক্তার হয়েও অনেকে ভুয়া ডিগ্রি ব্যবহার করে থাকেন। নামের আগে ভুয়া ডিগ্রি লাগিয়ে রোগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই এ ধরনের চিকিৎসকদের মূল উদ্দেশ্য।
রোগীদের ভালোমন্দ বিবেচনায় রাখেন না তারা। মহান পেশা চিকিৎসাসেবা তাদের কাছে হয়ে উঠে ‘রোগী মেরে টাকা উপার্জনের সেন্টার’। স্বীকৃত চিকিৎসকদের পাশাপাশি অস্বীকৃত কোয়াক চিকিৎসকদের সংখ্যাও কম নয়। তারা চিকিৎসা সেক্টরের জন্য বেশ হুমকিস্বরূপ।
দেশে রয়েছে প্রায় আড়াই লাখ ‘কোয়াক চিকিৎসক’। এ ধরনের চিকিৎসকদের থাকে না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি ও অভিজ্ঞতা। কোনো চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বা অভিজ্ঞ ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে তারা কিছু চিকিৎসা জ্ঞান অর্জন করে। সেই সীমিত জ্ঞান দিয়ে তারা নিজেদের মতো করে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যায়। এতে অনেক রোগী ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সরকারি অনুমোদন না থাকলেও এ ধরনের চিকিৎসকরা দেশের আনাচে-কানাচে চিকিৎসা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্বাস্থ্যসংক্রান্ত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মনিটরিং ব্যবস্থা জোরালো করার দাবি জানিয়েছেন ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সভাপতি, বিএমএ’র সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদী-ই-মাহবুব। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, স্বাস্থ্য সেক্টরে দুর্বল মনিটরিংয়ের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দায়ী। কেউ কারো দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করে না। দেশে ভুয়া ডিগ্রির অভাব নেই, টাকা দিলেই পাওয়া যাচ্ছে। এতে অদক্ষ চিকিৎসক সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।