দশ বছরের দাম্পত্য জীবন জিন্নাত আরার। স্বামী-স্ত্রী দুইজনেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। দিনের কাজ শেষে নিজেদের মতো করে সময় কাটান দুজনে। কিন্তু এই দশ বছরে জিন্নাত আরা একবারও সন্তান নিতে চাননি। কিন্তু কেন?
‘একটা বাচ্চা জন্মের পর থেকে যতদিন না ঐ বাচ্চা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত আমার টেনশন, আমার বাচ্চার টেনশন- এসব কিছু নিয়ে আমাকে চলতে হবে। আমার সন্তান প্রতিষ্ঠিত হলেই হবে না, আমৃত্যু আমাকে ঐ বাচ্চার চিন্তা করে জীবনের ৮০ শতাংশ ব্যয় করতে হবে- যেটা আমি করতে চাই না,’ বলছিলেন জিন্নাত আরা।
‘আমি আমাকে ভালোবাসি অনেক বেশি। আমার নিজের শান্তি-অশান্তি, আরাম-আয়েশ- এই বিষয়গুলোর প্রতি আমি বেশি গুরুত্ব দিই। আমি নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে পছন্দ করি।’
তার এই সিদ্ধান্তে প্রথম দিকে তার স্বামী আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তিনি এই সিদ্ধান্তে একমত পোষণ করেছেন। তবে জিন্নাত আরার পিছু ছাড়েননি তার স্বামী এবং বাবার বাড়ির লোক। তারা মোটেই খুশি নন।
আর এইরকম স্বামী, বাপের বাড়ি এবং আত্মীয়-স্বজনের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে আরেকটি দম্পতি সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই নারী বলছেন, চার বছরের সংসার জীবন তাদের। কিন্তু তারা প্রথম থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সন্তান নেবেন না।
‘একটা সন্তান পালন করার জন্য যে মানসিকতা দরকার সেটা আমার নেই। আমার স্বামী আমার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। যদিও আমার বাবা এবং স্বামীর বাড়ির অনেকেই আপত্তি জানিয়েছে। কিন্তু আমরা চিন্তা করেছি দিন শেষে যেহেতু আমরা দুইজনেই একসঙ্গে থাকব, আর আমরা দুজনেই যেহেতু সিদ্ধান্তে অটল, তাই আর কেউ সামনা সামনি আমাদের ঘাটায় না।’
শারীরিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণেও মানুষ সন্তান নিতে চান না। আবার অনেকে নিজেদের ইচ্ছায় সন্তান নিচ্ছেন না।
একজন নারী বলছেন, উত্তরাধিকারের চিন্তা এবং শেষ বয়সে ছেলেমেয়েরা দেখবে- এমন চিন্তা থেকেই অনেকে সন্তান নিতে চান। কিন্তু এক্ষেত্রে তার চিন্তা কিছুটা ভিন্ন।
এই নারী বলেন, ‘আমার পরিবার থেকেই বলে- তোর এত টাকা-পয়সা, তুই মারা গেলে কে খাবে? আমি তাদের বলি- যখন আমি মারা যাব তখন আমার আর কোনো দায়িত্ব থাকবে না কোনো কিছুর উপর। তাই সেটা নিয়ে ভাবি না।
‘যতদিন বেঁচে আছি আমার খরচ বা শেষ বয়সে আমার চিকিৎসার জন্য যে খরচ সেসব কাজে আমার টাকা লাগবে। সেজন্য সন্তান জন্ম দিতে হবে কেন? আর এখন তো আমরা দেখছি, একজনের পাঁচটা সন্তান থাকলেও বৃদ্ধ বয়সে বাবা-মাকে একাই থাকতে হচ্ছে।’
সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিয়ের সঙ্গে সন্তান জন্ম দেওয়াটাকে একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়। সেখানে স্বামী বা পরিবারেরও একটা চাপ থাকে। নারী সেটা চাইছে কি চাইছে না সেটার কোনো গুরুত্ব থাকে না।
কিন্তু সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, নারীরা তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে।
ফলে সন্তান না নেওয়ার প্রবণতাও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন ব্যাখ্যা করছিলেন কী কী কারণে দম্পতিরা সন্তান নিতে অনাগ্রহী হচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পরিবর্তন হচ্ছে। তারা নিজেদের নিয়ে ভাবছে। তারা জীবনের ব্যস্ততা নিয়ে ভাবছে, পেশাজীবন নিয়ে ভাবছে। তার চেয়ে বড় কথা তারা সম্পর্কগুলো বোঝার চেষ্টা করছে।’
সন্তানের সঙ্গে দায়িত্বের বিষয় আছে, আর্থিক সক্ষমতার বিষয় আছে, সামাজিক নানা ধরনের নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। তো এই এতগুলো বিষয় সে নিতে পারবে কিনা সেই প্রশ্ন তার মনে আসছে। আর মাতৃত্বই-বিয়ের মতো একটা গন্তব্য না- নারীরা সেটাকেও একটা রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের জায়গায় নিয়ে গেছে,‘ বলছেন জোবাইদা নাসরিন।
সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেড়ে যাওয়া, সম্পর্কের টানাপড়েন থেকে বিষণ্ণতা- এই সব কিছুই নারীদের সন্তান নেওয়ার ব্যাপারে চিন্তা করার একটা ক্ষেত্র তৈরি করছে এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এনে দিচ্ছে।
বিবিসি