logo
আপডেট : ৬ মে, ২০২২ ১১:৪৪
অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের মামলায় ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত
হাজি সেলিমের বিদেশ যাত্রা নিয়ে প্রশ্ন
এম বদি-উজ-জামান

হাজি সেলিমের বিদেশ যাত্রা নিয়ে প্রশ্ন

হাজি মোহাম্মদ সেলিম (ফাইল ফটো)

অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে বিদেশ ঘুরে আসলেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য হাজি মো. সেলিম। আর এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে গত বছর ২৭ সেপ্টেম্বর দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগের দেওয়া ৯ দফা গাইডলাইন অনুসরণ করা হয়েছে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

-আইন মেনেই বিদেশ গিয়েছিলেন হাজি সেলিম-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

- আদালতের অনুমতি ছাড়া এভাবে বিদেশ যেতে পারেন না-দুদক আইনজীবী

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, আইন মেনেই বিদেশ গিয়েছিলেন ও দেশে ফিরেছেন হাজি সেলিম। তবে দুদক আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান বলছেন, একজন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি আদালতের অনুমতি ছাড়া এভাবে বিদেশ যেতে পারেন না। এক্ষেত্রে আপিল বিভাগের গাইডলাইন লঙ্ঘন করা হয়েছে। আর হাজি মো. সেলিমের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা বলেছেন, হাজি সেলিমের বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। অসুস্থতার কারণে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তিনি বিদেশ গিয়েছিলেন।

অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা জরিমানা বহাল রেখে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের কপি গত ২৫ এপ্রিল বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। রায়ে হাজি সেলিমের জামিননামা বাতিল করতে নিম্ন আদালতকে নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে রায়ের শর্তানুযায়ী আগামী ৩০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ২৫ মের মধ্যে হাজি সেলিমকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

আইন অনুযায়ী, হাজি সেলিমকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করতে হলে ২৫ মের মধ্যে তার নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া বিকল্প নেই। আর আপিল করা ছাড়া দেশের কোনো আদালতে জামিন আবেদন করারও সুযোগ নেই তার। এ কারণেই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হাজী সেলিম নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন বলে জানা গেছে। হাজি সেলিম নিজেও যেকোনো সময়ই আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত আছেন। এই মুহূর্তে তিনি আত্মসমর্পণ করলে তাকে বেশ কয়েকদিন কারাগারে কাটাতে হবে। কারণ আগামী ১৫ মে পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ। ফলে ১৫ মের আগে হাইকোর্টে আপিল করা বা জামিন আবেদন করার কোনো সুযোগ নেই হাজি সেলিমের। এ কারণেই আইনজীবীর পরামর্শ অনুযায়ী আগামী ১৬ মের পর যেকোনো দিন তিনি নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করবেন বলে জানা গেছে।

পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে সরকারি ছুটি, সুপ্রিম কোর্টের নিজস্ব ছুটি ও সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে সুপ্রিম কোর্টে টানা ১৭ দিনের ছুটি চলছে। গত ২৯ এপ্রিল থেকে এই ছুটি শুরু হয়েছে। আগামী ১৫ মে পর্যন্ত ছুটি থাকবে সুপ্রিম কোর্টে। ১৬ মে সুপ্রিম কোর্ট নিয়মিতভাবে বসবে। নিয়মিত আদালত খোলার পর হাজি সেলিম জামিন আবেদন করার সুযোগ পাবেন। যেহেতু হাইকোর্ট বিভাগের রায় অনুযায়ী তার হাতে ২৫ মে পর্যন্ত সময় রয়েছে। এ কারণে ২৫ মের আগে যেকোনো দিন আত্মসমর্পণ করবেন হাজী সেলিম।

তবে আত্মসমর্পণের আগেই গত ৩০ এপ্রিল থাইল্যান্ড সফরে যান হাজি সেলিম। সেখান থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে দেশে ফিরেছেন তিনি। ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজি মো. সেলিমের একান্ত সচিব মহিউদ্দিন মাহমুদ বেলাল সাংবাদিকদের জানান, থাইল্যান্ডে চিকিৎসা শেষে গতকাল (বৃহস্পতিবার) দুপুর সোয়া ১২টায় থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে দেশে ফিরেছেন সংসদ সদস্য হাজি সেলিম। এখন তিনি সুস্থ আছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে একটা জানাজায় অংশ নিয়েছেন।

হাজি সেলিমের এই বিদেশ যাওয়া নিয়েই যত প্রশ্ন। দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান ভোরের আকাশকে বলেন, হাইকোর্টের রায় প্রকাশের পর থেকেই তার জামিন বাতিল হয়েছে। কারণ নিম্ন আদালতকে নির্দেশনা দেওয়া আছে হাজি সেলিমের জামিননামা বাতিল করার। ফলে এই রায় প্রকাশের পর আদালতের তথা হাইকোর্টের অনুমতি ছাড়া তার বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই। যেমনটি পারছেন না সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তাকে দেশেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।

এছাড়া আপিল বিভাগের গাইডলাইন অনুযায়ীও আদালতের অনুমতি ছাড়া হাজি সেলিমের বিদেশ যাওয়ার সুযোগ নেই। হাজি সেলিমের বিদেশ যাওয়া নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকেও মুখ খুলতে হয়েছে।

গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে হাজি সেলিম ব্যাংকক গিয়েছিলেন ঠিক, তবে তিনি আবার ফিরেও এসেছেন। উনি (হাজি সেলিম) আইন মেনেই গিয়েছিলেন এবং আইন মেনেই ফেরত চলে এসেছেন। হাজি মো. সেলিম একজন মাননীয় সংসদ সদস্য। তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আইনকে মাথায় রেখেই তিনি গেছেন। আবার চলেও এসেছেন।’

হাজি সেলিমের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ২৫ মের মধ্যে হাজি মো. সেলিমকে নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে। সুতরাং এই সময়ের মধ্যে তিনি (হাজি সেলিম) দেশে থাকবেন নাকি বিদেশ যাবেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।

আইনজীবী বলেন, একজন মানুষ চিকিৎসার জন্য বিদেশ গেছেন। আবার ডাক্তার দেখিয়ে দেশেও ফিরে এসেছেন। তাই তার এই বিদেশ যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলা অবান্তর। দুদক আইনজীবী ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকেই এটা নিয়ে কথা তুলছেন বলেই আমার মনে হয়। তা না হলে হাজি সেলিমের বিদেশ যাওয়ার সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গ টানতেন না।

তিনি বলেন, যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন যে আইন মেনেই হাজি সেলিম বিদেশ গেছেন, সেখানে সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের(দুদক) আইনজীবী কীভাবে বলেন, আইন অমান্য করা হয়েছে? অ্যাডভোকেট সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, ১৬ মের পর হাজি সেলিম আত্মসমর্পণ করবেন।

অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর হাজি সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ মামলায় ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল এক রায়ে দুদকের কাছে সম্পদের তথ্য গোপন করার দায়ে তিন বছর এবং অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের দায়ে ১০ বছর কারাদ- দেওয়া হয়। উভয় সাজা একটির পর একটি কার্যকরের আদেশ থাকায় তার মোট ১৩ বছরের (১০ বছর ও ৩ বছর) কারাদণ্ড হয়। একইসঙ্গে ২০ লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর হাইকোর্টে আপিল করেন হাজি সেলিম।

২০১১ সালের ২ জানুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে হাজি সেলিমের সাজা বাতিল করে তাকে খালাস দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করে দুদক। আপিল বিভাগ ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি এক আদেশে হাইকোর্টের রায় বাতিল করেন এবং পুনরায় হাইকোর্টে শুনানির নির্দেশ দেন।

কিন্তু গত প্রায় ৬ বছরেও কোনো পক্ষই এ আপিলের ওপর শুনানির উদ্যোগ নেয়নি। সম্প্রতি নৌবাহিনীর এক কর্মকর্তাকে মারধর করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাজি সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপরই হাজি সেলিমের মামলার বিষয়ে দুদকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এ অবস্থায় হাজি সেলিমের আপিলের ওপর হাইকোর্টে শুনানির জন্য উদ্যোগ নেয় দুদক। এরই ধারাবাহিকতায় শুনানি শেষে গত বছর ৯ মার্চ রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।

রায়ে শুধুমাত্র অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের দায়ে ১০ বছর কারাদণ্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার আদেশ বহাল রাখা হয়। আর সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয় তাকে। এরও এক বছর পর গত ১০ ফেব্রুয়ারি পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এ অবস্থায় গত ২৫ এপ্রিল রায়ের কপি পাঠানো হয় নিম্ন আদালতে। এ কারণে আগামী ২৫ মে পর্যন্ত আত্মসমর্পণের সময় আছে হাজি সেলিমের হাতে।