logo
আপডেট : ৭ মে, ২০২২ ১১:৫২
আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলা
১৮ বছরেও বিচার শেষ হলো না
এম বদি-উজ-জামান

১৮ বছরেও বিচার শেষ হলো না

টঙ্গীর জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ ও সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারকে ১৮ বছর আগে ২০০৪ সালের ৭ মে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করা হলেও এই মামলার চূড়ান্ত বিচার আজো সম্পন্ন হয়নি। ওই ঘটনায় করা হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ, বাদীপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল ছয় বছর ধরে বিচারাধীন দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগে। এ মামলার দ্রুতবিচার সম্পন্ন করতে নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো সাড়া নেই বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে নিহতের সন্তান যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ হোসেন রাসেলের বক্তব্য জানা যায়নি।

#৬ বছর বিচার আটকে আছে আপিল বিভাগেই

সুপ্রিম কোর্টে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এস এম মুনির ভোরের আকাশকে বলেন, আগামী ১৬ মে নিয়মিত আদালত খুলবে। তখন এ মামলার বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া যাবে।
হাইকোর্ট বিভাগে মামলাটির বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মোতাহার হোসেন সাজু ভোরের আকাশকে বলেন, অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর এই মামলাটি এখনো বিচারাধীন আপিল বিভাগে। অনেক আগেই এটা নিষ্পত্তি হওয়ার দরকার ছিল। সবারই বিশেষভাবে নজর দেওয়ার দরকার ছিল এই মামলাটিতে, কিন্তু তা হয়নি। এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক।

আপিল বিভাগে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনজীবী ছিলেন সেই সময়কার অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মমতাজউদ্দিন ফকির। তিনি সেসময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মামলার নথি প্রস্তুত হতে কিছুটা সময় গেছে। এরপর আসামিপক্ষ কয়েক দফা সময় নিয়েছে। এছাড়া আরো গুরুত্বপূর্ণ মামলা শুনানির জন্য সময় গেছে। এসব কারণে এই মামলাটির বিচার বিলম্বিত হয়েছে। তবে শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ প্রস্তুত রয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে বর্তমানে আদালতে বন্ধ চলছে। নিয়মিতভাবে আদালত খোলার পর মামলাটি শুনানির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।

জানা যায়, এই মামলাটি শুনানির জন্য ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি আপিল বিভাগের কার্য তালিকায় ছিল। এ দিন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ শুনানি ৮ সপ্তাহ পিছিয়ে দেন। এরপর ৪ মার্চ মামলাটি আবারো কার্য তালিকায় আসে। কিন্তু এ দিন নথি না আসায় শুনানি হয়নি। সেই থেকে বারবার শুনানি পিছিয়েছে।

এরপর অতিমারি করোনোর কারণে সবকিছুর সঙ্গে থমকে পড়ে স্বাভাবিক বিচার কাজও। আইনজীবীরা বলছেন, করোনার প্রভাব পড়ে এই মামলাটির ওপরও। প্রায় দুই বছর স্বাভাবিক বিচার কাজ পরিচালিত না হওয়ায় এ মামলাতেও শুনানি হয়নি।

বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলায় বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকার এবং জাতীয় পার্টির নেতা নুরুল ইসলাম দিপুসহ ছয়জনের মৃত্যুদ- বহাল রেখে ২০১৬ সালের ১৫ জুন হাইকোর্ট রায় দেন। এরপর একই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এরপর খালাস আদেশের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষ এবং খালাস চেয়ে আসামিপক্ষ পৃথকভাবে আপিল বিভাগে আপিল করে। এ আপিল এখন বিচারাধীন।

নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ২২ জনের মধ্যে ছয়জনের মৃত্যুদ- বহাল রাখেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে সাতজনের মৃত্যুদ-ের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ-, ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরো এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন। বিচার চলাকালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজন কারাগারে মারা যাওয়ায় তাদের বিষয়টি নিষ্পত্তি করা হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাকি সাতজনকে খালাস দেওয়া হয়।

এছাড়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ছয়জনের মধ্যে একজনের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। চারজনকে খালাস দেওয়া হয়। আর একজন আসামি আপিল না করায় তার বিষয়ে হাইকোর্ট কোনো আদেশ দেননি। সবমিলে নিম্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ১১ জনকে খালাস দেন হাইকোর্ট। ২০০৫ সালের এপ্রিলে এ মামলায় নিম্ন আদালত থেকে ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনকরণ) পাঠানো হয় হাইকোর্টে। এছাড়া আসামিপক্ষে আপিল করা হয়। উভয় আবেদন একসঙ্গে হাইকোর্টে শুনানি শেষে রায় দেওয়া হয়।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন নুরুল ইসলাম সরকার, নুরুল ইসলাম দিপু, মাহবুবুর রহমান মাহবুব, শহিদুল ইসলাম শিপু, কানা হাফিজ এবং সোহাগ ওরফে সরু। এদের মধ্যে নুরুল ইসলাম দিপু শুরু থেকেই পলাতক। বাকিরা কারাবন্দি ।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি : যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ আহমেদ মজনু, আনোয়ার হোসেন আনু, রতন মিয়া ওরফে বড় মিয়া, আবু সালাম, ছোট জাহাঙ্গীর (পিতা আবুল কাশেম) ও মশিউর রহমান মিশু। এছাড়া যাবজ্জীবন সাজা বহাল রাখা হয় নুরুল আমিনের। এ আটজনের মধ্যে সৈয়দ আহমেদ মজনু, আনোয়ার হোসেন আনু, ছোট জাহাঙ্গীর (পিতা আবুল কাশেম) ও মশিউর রহমান মিশু হাইকোর্টের রায় ঘোষণার সময় পলাতক ছিলেন।
খালাসপ্রাপ্তরা-নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে আমির, বড় জাহাঙ্গীর (পিতা নূর হোসেন), ফয়সল, লোকমান হোসেন বুলু, রণি ফকির, খোকন এবং দুলাল মিয়াকে খালাস দেওয়া হয়। এছাড়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে রাকিব উদ্দিন সরকার ওরফে পাপ্পু সরকার, আয়ুব আলী, জাহাঙ্গীর (পিতা মেহের আলী) ও মনিরকে খালাস দেওয়া হয়।

নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অহিদুল ইসলাম টিপু পলাতক থাকায় তিনি আপিল করেননি। এ কারণে আদালত তার বিষয়ে কোনো আদেশ দেননি। আইনজীবীরা বলছেন, সে আপিল না করায় তার সাজা বহাল রয়েছে।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার আমলে ২০০৪ সালের ৭ মে টঙ্গীর নোয়াগাঁও হাইস্কুল মাঠে এক অনুষ্ঠানে আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সময় সন্ত্রাসীদের গুলিতে ২০০৪ সালে এসএসসি পাস করা ছাত্র ওমর ফারুক রতনও নিহত হয়। এছাড়া যুবলীগ নেতা মাহফুজুর রহমান মহল গুরুতর আহত হন। এ হত্যাকাণ্ডে সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এরপর নিহত আহসানউল্লাহ মাস্টার এমপির ভাই মতিয়ুর রহমান বাদী হয়ে টঙ্গী থানায় মামলা করেন। এ ঘটনায় করা মামলায় মাত্র একবছরের মধ্যে বিচারিক আদালতে বিচার সম্পন্ন হয়।

২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল ঢাকার এক নম্বর দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে এ মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ ২২ জনকে মৃত্যুদ- ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় দুজনকে খালাস দেওয়া হয়। আদালতের রায়ে স্কুলছাত্র রতনকে হত্যা করার দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত সব আসামিকেই আরো একদফা অভিন্ন শাস্তি দেওয়া হয়।