বাজারে ভোজ্যতেলের সংকট সমাধানে গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য সচিবের সঙ্গে সভা করে সয়াবিন এবং পাম তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।
নতুন দামে প্রতি লিটার বোতল সয়াবিন ৩৮ টাকা, ৫ লিটারে ২২৫ টাকা, খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের লিটারে ৪২ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
ফলে ভোক্তাকে এক লিটারে বোতল সয়াবিন তেল ১৯৮ টাকা, ৫ লিটার বোতল ৯৮৫ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ টাকা এবং খোলা পাম তেল প্রতি ১৭২ টাকা দরে কিনতে হচ্ছে।
তথ্য রয়েছে দাম বাড়ানোর পরেও এখনো সংকট কাটছে না। মিল মালিকরা জানিয়েছেন, ঈদের পর কারখানা কার্যক্রম শুরু হলেও মাঠ পর্যায়ে এখনো সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি, যা রোববারের মধ্যে হয়ে যাবে।
আর দাম বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজার বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ভোক্তা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশি দামে চাহিদা মিটলে তা হবে মন্দের ভালো।
শুক্রবার (৬ মে) ঢাকার কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ঈদের আগের মতোই এখনো চাহিদার ভিত্তিতে পণ্যটি পাওয়া যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র এজিএম তাসলিম শাহরিয়ার ভোরের আকাশকে বলেন, রমজানে যে পরিমাণ তেল সরবরাহ করা হয়েছে, তাতে সংকট তৈরি হওয়ার কারণ নেই। মিল থেকে সরকারের তদারকির মাধ্যমে যথাযথভাবে ভোজ্যতেল সরবরাহ করা হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে নতুন দামের সিদ্ধান্ত হয়েছে, যা মূল্য ঘোষণার পর থেকে কার্যকর। তবে ঈদ শেষে কারখানায় শ্রমিক ও টেকনিশিয়ান উপস্থিতি কম থাকায় পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক হয়নি। শনিবার ( ৭ মে ) থেকে বাজারে নতুন পণ্য যাবে এবং রোববার থেকে আশা করছি, ভোজ্যতেল স্বাভাবিকভাবে পাওয়া যাবে।
একই প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব এবং ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ভোরের আকাশকে বলেন, মন্ত্রণালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না। যতটুকু জেনেছি, নতুন দাম ঠিক করা হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজার দর সমন্বয় করা হয়েছে।
জানা গেছে, ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিত্রে গত ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ভোজ্যতেলের দাম ঠিক করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর ১০ বা ১২ দিন পর ব্যবসায়ীরা ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধকে সামনে এনে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়েছে বলে আবার দাম বাড়ানোর জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। সেই সময় সরকার সাফ জানিয়ে দিয়েছিল রোজার আগে তেলের আর দাম বাড়বে না।
সরকার তার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেও বাজারে শুরু হয় ভোজ্যতেলের হাহাকার। খোলা তেলের লিটার ২০০ টাকা উঠে যায়, এতে দোকানিরা বোতল সয়াবিন মুখ খুলে বিক্রি শুরু করে। সেই সময় এফবিসিসিআই ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, আমদানিকারক, সরবরাহকারী, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে বসেন।
ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত অব্যাহতি দেওয়ার প্রস্তাব করে। আর ভোক্তা অধিদপ্তর পর্যায়ক্রমে পাইকারি ও সরবরাহ পর্যায়ে অভিযান চালিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়।
ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট থেকে ১০ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ এবং ভোক্তা পর্যায়ের ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করে। ফলে ফেব্রুয়ারি মাসে নির্ধারিত দাম থেকে বোতল সয়াবিনের দাম লিটারে ৮ টাকা কমে ১৬০ টাকা এবং পাঁচ লিটার ৭৯৫ টাকার পরিবর্তে ৭৬০ টাকা ঠিক করা হয়। খোলা তেল ১৩০ বা ১৩৬ টাকা ঠিক করা হয়।
মূলত ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার উত্তেজনা শুরু হলে তা যুদ্ধে রূপ নেয় ২৪ ফেব্রুয়ারি। এতে জ্বালানি তেলের পাশাপাশি অস্থির হতে শুরু করে ভোজ্যতেলের বাজার। এর মধ্যে মার্চের মাঝামাঝি সময়ে সয়াবিনজাত পণ্য ও তেল রপ্তানি অপ্রত্যাশিতভাবে কমিয়ে দেয় অন্যতম প্রধান রপ্তানিকারক দেশ আর্জেন্টিনা।
আর রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে সানফ্লাওয়ার অয়েল আসা বন্ধ হয়ে যায়। আর গত ২৮ এপ্রিল পামওয়েল রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করে প্রধান রপ্তানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়া। যদিও দেশ দুটির সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা তাদের সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্তে বিরোধিতা করছে।
ফলে বিশ্ববাজারের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সংকট তৈরির সম্ভাবনা দেখা দেয়। এর সমাধানে আমদানি থেকে বাজারজাত পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে তদারকি শুরু করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এতে বাজারে গতি আসলেও মাঝে মধ্যেই অস্থির হয়ে উঠেছে ভোজ্যতেলের বাজার।
ভোজ্যতেলের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ভোরের আকাশকে বলেন, ‘দাম বাড়া সবসময় ভোক্তার জন্য সমস্যা। তবে বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। মূল্য বৃদ্ধির পরেও যদি তেল এখন চাহিদা মাপিক পাওয়া যায়, তা হবে মন্দের ভালো। তবে সরকারের প্রতি অনুরোধ হলো, যখন দাম কমবে, তখন যেন সরকার এভাবে দামটা কমিয়ে আনেন।’