logo
আপডেট : ৮ মে, ২০২২ ১১:৪০
সুশাসন
দুর্নীতি রোধে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা দরকার
নিজস্ব প্রতিবেদক

দুর্নীতি রোধে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা দরকার

যৌক্তিক কারণেই প্রিয় বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে অভিনব উদ্যোগ নিতে হবে এখনই

ক্যানসারের চেয়েও ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি হলো দুর্নীতি। করোনাকালে ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কঠোর শাস্তির কথা ঘোষণা করার পরও তেল, চাল আর নগদ টাকা বিতরণে যে দুর্নীতির খবর বেরিয়ে এসেছিল। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে যথার্থই বলা হয়েছিল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি ত্রাণ হিসেবে কাফনের কাপড়ও দিতে যান তাহলে কতিপয় লোক এই কাফনের কাপড় চুরি করে পাঞ্জাবি বানাবে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু দুঃখ করেই অকপটে বলেছিলেন, কৃষক, শ্রমিক দুর্নীতিবাজ না; আমরা শিক্ষিত সমাজের মানুষগুলোই দুর্নীতিবাজ। অর্থাৎ দুর্নীতির বীজ জাতির অস্থিমজ্জায় ঢুকে গেছে অনেক আগেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, দেশ স্বাধীন হলে সবাই পায় সোনার খনি। আমি পেলাম চুরের খনি। অথচ এই চুরি প্রবৃত্তির জাতিকে নিয়েই তিনি স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।


দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতি একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সময়ে বড় দুর্নীতির খবর-ওয়াসার সমিতির তহবিল লোপাট। ১৭৬ কোটি টাকা, গাড়ি এবং ব্যাংকের আরো লাখ পঞ্চাশ টাকার হদিস মিলছে না! কি ভয়ানক দুর্নীতির চিত্র! সমাজ থেকে দুর্নীতি নামক ব্যাধিকে হটাতে হলে প্রয়োজন সামাজিক গণজাগরণ। সামাজিক আন্দোলন ছাড়া এই ব্যাধি হটানো যাবে না। সবার আন্তরিক প্রতিরোধেই কেবল দুর্নীতি কমানো সম্ভব। তবে এটাও ঠিক, দুর্নীতি একেবারে হটানো সম্ভব নয়। সেজন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। নাগরিক সচেতনতা দরকার। নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষা দরকার। সততার মূল্যায়নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা দরকার। আইনের শাসন বাস্তবায়ন করা দরকার। তার মানে, দুর্নীতি নির্মূল করা একটা সামগ্রিক কার্যক্রম বটে। একাকী সরকার এ কাজ করতে পারবে না। মনে রাখতে হবে, দুর্নীতি হলো একধরনের প্রবণতা। এই প্রবণতা আগে দূর করা দরকার। যেমন আইন না মানাও এক ধরনের প্রবণতা। একটা উদাহরণ দিয়েই বলিÑ জাপান সরকার তাদের জনগণের জন্য মাঝে মাঝে কিছু নির্দেশনা দেয়। যেমন- পাওয়ার সেভ করার জন্য সোম আর বৃহস্পতিবার দেশের জনগণ লিফট ব্যবহার করবে না। দেখা গেছে, জাপানিরা সরকারের পরবর্তী নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত সোম ও বৃহষ্পতিবারে লিফট ব্যবহার করছে না। তারা সবাই সিঁড়ি দিয়ে উঠানামা করছে। আবার সরকার যখন বলবে অফিস কিংবা বাসায় এয়ারকুলারের তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে স্থির রাখতে হবে। জাপানের জনগণ ঠিক তাই করবে। নিয়মানুবর্তিতা বা সরকারের নির্দেশনা মানার এমন প্রবণতা দেখে সে দেশে অবস্থানকারী একজন বাঙালি এক জাপানির কাছে জানতে চাইলÑ ‘আচ্ছা তোমরা নিয়ম ভাঙো না কেন?’ তার প্রশ্ন শুনে জাপানি ভদ্রলোক বিস্ময়ে তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললÑ ‘কি বলছ, কিছু বুঝতে পারছি না। নিয়ম ভাঙব কেন? নিয়ম তো তৈরিই করা হয় মানার জন্য।’ এই হলো বাঙালি আর জাপানিদের প্রবণতার ব্যবধান। আমরা বাঙালিরা নিয়ম ভাঙতেই বেশি পছন্দ করি। দশ হাত দূরত্বের মধ্যে একটি ফুটওভারব্রিজ আর একটি আন্ডারপাস থাকা সত্ত্বেও বাঙালিরা দৌড় দিয়ে রাস্তা পারাপার হয়। আমরা আইনের কথা বলি- কিন্তু নিজেরা আইন মানি না। আইনের কঠোর শাসনের কথা বলি। দেখা গেছে, করোনাকালে পাবলিক অযথা ঘর থেকে বের হওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দুয়েকজনকে কানধরে উঠবস করিয়েছে বা লাঠিপেটা করেছে। আর ফেসবুকে এ নিয়ে তুলকালাম প্রতিবাদে সোচ্চার নিয়ম ভঙ্গকারী বাঙালিরা।


সমাজ থেকে দুর্নীতি নামক ব্যাধিকে হটাতে হলে প্রয়োজন সামাজিক গণজাগরণ। সামাজিক আন্দোলন ছাড়া এই ব্যাধি হটানো যাবে না। সবার আন্তরিক প্রতিরোধেই কেবল দুর্নীতি কমানো সম্ভব। তবে এটাও ঠিক, দুর্নীতি একেবারে হটানো সম্ভব নয়। সেজন্য প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। নাগরিক সচেতনতা দরকার। নৈতিক ও মূল্যবোধের শিক্ষা দরকার। সততার মূল্যায়নে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা দরকার। আইনের শাসন বাস্তবায়ন করা দরকার। তার মানে, দুর্নীতি নির্মূল করা একটা সামগ্রিক কার্যক্রম বটে


২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা অভিনব আন্দোলনের ডাক দিয়ে রাজপথে নেমেছিল। অনেক বাহ্বা কুড়িয়েছে সে আন্দোলন। তাদেরকে সমর্থন দিয়েছি আমরা, পাশে দাঁড়িয়েছি আমরা। তারা ক্ষণিকের জন্য হলেও আমাদেরকে নিয়ম মানতে বাধ্য করেছিল। ভালো-মন্দ লেখা অনেক প্লে­কার্ড নিয়ে তারা সর্বস্তরের নাগরিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। তারমধ্যে অন্যতম একটি প্লে­কার্ডে লেখা ছিলÑ ‘বাবা তোমার আয়োর উৎস কি?’ আমি মনে করি, এটাই হতে পারে দুর্নীতি হটানোর মোক্ষম হাতিয়ার। ঘর থেকেই শুরু করতে হবে দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলন। আমরা রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশের কথা বলি। রাজাকারের সন্তানদের তাচ্ছিল্য করি। কিন্তু দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, ঘুষখোরদের সমাজ থেকে হটাবার কথা বলি না। এরা তো এ সমাজেরই মানুষ। তাহলে কি দুর্নীতিবাজের সন্তান, স্ত্রী, ভাই, বোন, বাবা, স্বামী হিসেবে আমরা গর্বিত বোধ করি। সন্তান হিসেবে পিতার, পিতা হিসেবে সন্তানের, স্ত্রী হিসেবে স্বামীর, স্বামী হিসেবে স্ত্রীর আয়ের উৎস জানা দরকার। এভাবে সবাই যদি সচেতন হই, তাহলে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজ থেকে দুর্নীতি হটাতে পারি।


সত্যিই তরুণ-তরুণীরা দুর্নীতি প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলনকে চাঙ্গা করতে পারে। পাড়ায়, মহল্লায় তরুণরা দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক ফোরামের মাধ্যমে নিজ এলাকার দুর্নীতিবাজদের চেহারা উন্মোচন করে দিতে পারে। মনে রাখতে হবে, দেশের জাতীয় সমস্যা দুর্নীতি প্রতিরোধ করা। শুধু দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দিয়ে সম্ভব নয়, এ জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা, দেশপ্রেম এবং তরুণ সমাজের অঙ্গীকার। তরুণ ও যুবকদেরই দুর্নীতি প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে।


আমাদের কাছে সুন্দর যুক্তি আছে- বাবাই সন্তানের কাছে সেরা বাবা। ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজরাও ভালো বাবা। কিন্তু এমন কিছু বাবার কারণে বাকিরা চিকিৎসা পায় না, গরিবরা চাকরি পায় না, রাস্তায় পানি জমে থাকে, গরিব মানুষ ত্রাণের টাকা পায় না। প্রশ্ন হলোÑ এ রকম বাবা ও তার সন্তানদের সংখ্যা যদি ক্রমশ বাড়তে থাকে তাহলে দেশ কোথায় যাবেÑ ভেবে দেখা দরকার। প্রশ্ন হলো, সন্তান কিংবা স্ত্রী, পিতা কিংবা স্বামী কি একে অপরের আয়ের বৈধতা জানার চেষ্টা করেন। তারা কি অনুসন্ধান করেন যে, কোন পদে চাকরির বেতন স্কেল কত। আয় কত হওয়ার কথা। তাদের জীবনযাপনের ব্যয়ের সাথে, সম্পদের সাথে সেই আয়ের সামঞ্জস্য আছে কি। ভেবেছেন কি কখনো, আপনার স্বজনের দুর্নীতির কারণে কত শত, হাজার জন অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। তাহলে কোন মুখে নিজেরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন। আশ্চর্যজনকভাবে দেখছি, ফেসবুকে ঘুষখোর মানুষটিও যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্ট্যাটাস দেয় তখন তার বিবেক কি কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে? তাহলে কীভাবে দুর্নীতি নির্মূল হবে?


বাবা দিবসে নিজ নিজ বাবাদের ভালো কথায় ফেসবুক সয়লাব হয়ে ওঠে। আচ্ছা, সবার বাবাই যদি এত সৎ, নির্লোভ, আপসহীন, মানবিক, গভীর জীবনবোধসম্পন্ন হন তাহলে দেশটা যে এত এত দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, অমানবিক লোকে গিজগিজ করছে তারা কারা? তারা কি নিঃসন্তান! তাহলে বাবাদের আরেকটা গুণের কথা কিন্তু বলতেই হবে, তারা খুব চমৎকারভাবে তাদের দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, অমানবিক সত্তাকে স্ত্রী-সন্তানদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পারে। আর আপনারাই বা কেমন সন্তান, এত এত ডিটেকটিভ সিরিজ দেখে, এতদিন ধরে এক ছাদের নিচে বসবাস করে বাবাদের এই অন্ধকার দিকগুলোকে আবিষ্কার করতে পারলেন না। আসুন, ঘর থেকেই শুরু হোক দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। খোঁজ নিন আপনার বাবার বা স্বামীর আয়ের উৎস কি। তিনি কোন পদে চাকরি করেন, কত টাকা বেতন পান। আর আপনাদের বিলাসী জীবন কি এই টাকায় চলে? নিজের ঘুষখোর বাবার জন্য লজ্জিত হোন, বিব্রত হোন, সংশোধন করুন আর অবৈধভাবে অর্জিত টাকা বিপন্ন অসহায়দের পেছনে ব্যয় করুন।


দুর্নীতি ঠেকাতে পৃথিবীর নানা দেশেই হরেকরকম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, কঠোর আইন কিংবা বিচার এর মধ্যে অন্যতম। পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর নজরদারিও গুরুত্বপূর্ণ। দুর্নীতি ঠেকাতে অভিনব এক প্রচেষ্টা নিয়েছে মস্কোর নগর সরকার। এজন্য তারা ব্যবহার করছে এক ধরনের কৌতুকের বই। বইটির নাম ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই।’ ঘুষ নেয়াকে নিরুৎসাহিত করতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এই বই পড়ানো হচ্ছে। বইটিতে অনেক ছবি ব্যবহার করা হয়েছে যার মূল কথা ঘুষ কিংবা দুর্নীতির বিরুদ্ধে। ব্যবহার করা হয়েছে ছোট ছোট গল্প এবং উক্তি। মস্কো সিটি ইউনিভার্সিটি এই ছবিগুলো তৈরি করেছে।


দুর্নীতি প্রতিরোধে কিছু ঘটনা আসুন জেনে নিই। ২০০৪ সালে রিপাবলিক অফ জর্জিয়ায় প্রায় ৩০ হাজার ট্রাফিক পুলিশ সদস্যকে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত করা হয়। বলতে গেলে দেশটির গোটা ট্রাফিক পুলিশ বাহিনীকেই চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল! সে বছরই পুলিশ বাহিনীতে স্বচ্ছতা আনতে দেশটির সরকার প্রতীকী হিসেবে কাচের তৈরি পুলিশ স্টেশন তৈরি করে। এরপর থেকেই জর্জিয়ায় অপরাধ প্রবণতার হার লক্ষণীয়ভাবে কমতে থাকে এবং পুলিশের প্রতি জনগণের হারানো আস্থা ফিরে আসতে থাকে। আবার সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি রুখতে চীনে সব সরকারি কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত ভিত্তিতে জেলখানা ভ্রমণ করানো হয়! এ কাজের উদ্দেশ্য হলো- দুর্নীতি করলে কপালে কী লেখা আছে তা সচক্ষে দেখিয়ে আনা। পাশাপাশি পূর্বের যত সরকারি কর্মকর্তা দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে কারাবাস করছেন তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং সাক্ষাতে কারাবাসী সরকারি কর্মকর্তারা তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। যৌক্তিক কারণেই প্রিয় বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে অভিনব উদ্যোগ নিতে হবে এখনই।


লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক এবং উন্নয়ন গবেষক