‘এ রোগীর যা অবস্থা ১ ঘণ্টা বাঁচবে না! দ্রুত প্রাইভেট হাসপাতালে না নিলে পথিমধ্যে রোগী মারা যাবে। এমন অনেক দেখেছি, ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার আগেই মারা গেছেন’, এভাবেই রোগীর স্বজনদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভাররা। এরা মূলত শিনশিন জাপান হাসপাতালের দালাল হিসেবে নিয়োজিত। রোগীপ্রতি কমিশনে কাজ করে থাকেন বলে জানান তারা। এমন অভিযোগ রাজধানীর উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত শিনশিন জাপান হাসপাতালের বিরুদ্ধে। ২৪ দিনে ৯ লাখ টাকা বিল করার অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। সাড়ে ৪ লাখ টাকা দিয়েও মুক্তি মেলেনি।
তারা জানায়, এ অভিযোগ তাদের প্রতিদিনের। রোগী মারা যাওয়ার পরও তারা আইসিইউতে রেখে লাখ লাখ টাকা আদায় করার অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। শিনশিন জাপান হাসপাতালে স্ত্রীকে চিকিৎসা করতে আসা এক ব্যক্তি বলেন, ‘গত দুদিন আগে গলায় ফাঁস দেওয়া এক নারী রোগী আগেই মারা যান। তারপরও হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করে ১ দিন রেখে ১ লাখ টাকা নেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে মরদেহ নিয়ে চলে যান তারা।’
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিনশিন জাপান হাসপাতালে গত ১৩ এপ্রিল গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জের আব্দুল লতিফ (৩৫) নামে এক রোগী সড়ক দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত নিয়ে সেখানে ভর্তি হন। ঢাকা মেডিকেলে না গিয়ে শিনশিন জাপান হাসপাতালে কী করে এলেন, তার বর্ণনা দেন লতিফের মা নাজমা বেগম, ‘গত মাসের ১৩ এপ্রিল সড়ক দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পাওয়ার পর গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থেকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশে রওনা দেন। তিনি বলেন, রোগী নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলাম। টঙ্গী আসার পর অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার বলেন, রোগীর অবস্থা খারাপ ১ ঘণ্টা বাঁচবে না। দ্রুত প্রাইভেট হাসপাতালে না নিলে রোগীকে বাঁচানো যাবে না।’
পরে কৌশলে অল্প খরচে ভালো চিকিৎসার কথা বলে ভর্তি করান শিনশিন জাপান হাসপাতালে। এরপর চলে টাকার জন্য নানা চাপাচাপি।
লতিফের মা বলেন, চিকিৎসা বাবদ এরই মধ্যে ৪ লাখ টাকা পরিশোধ করেন তারা। যার প্রতিটি টাকা মানুষের থেকে সাহায্য তুলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করেন। লতিফের স্ত্রী পারুল কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার স্বামী গার্মেন্টে চাকরি করে ১০ হাজার টাকা বেতন পান, তা দিয়ে আমাদের সংসার চলে। এখন এত টাকা কী করে দেব।
তিনি বলেন, আমাদের অনেক হুমকি-ধমকি দেয় হাসপাতালের লোক। রোগীকেও হুমকি দেয়। আমাদের রোগীর সামনে যেতে দেয় না। চুরি করে গেলে আমার স্বামী বলেন, কথা বল না, তাহলে মেরে ফেলবে আমাকে ইনজেকশন দিয়ে। ওরা বলেছে। তিনি আরো বলেন, আমরা এত টাকা বিল দেখে সাত দিনের মাথায় রোগী নিতে চাইলে তারা আরো ৫ লাখ টাকা দাবি করে। তাদের টাকা দিতে না পারার কারণে আমার স্বামীকে হাত-পা বেঁধে রাখেন বলে অভিযোগ করেন। যেন পালিয়ে না যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ চিত্র শুধু শিনশিন জাপানেই নয়। উত্তরার ৯ নম্বর সেক্টরে অবস্থিত উত্তরা আধুনিক কলেজ হাসপাতালে রোগী এলেই তারা নানা কৌশলে রোগী ভাগিয়ে উত্তরার বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করান; যাতে করে মাসে একটা মোটা অঙ্কের একটি কমিশন পান তারা। অনুসন্ধানে জানা যায়, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি থেকে ওয়ার্ড বয়ের মাধ্যমে প্রাইভেট হাসপাতালে রোগী পাচার করেন। সবসময় চলে গেটের সামনে দালালদের মহড়া। উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে কমিশন ভিত্তিতে নানান কৌশলে ওয়ার্ড বয়দের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা রোগীদের পাচার করেন। উত্তরা প্রাইভেট হাসপাতালগুলোয় অল্প খরচে চিকিৎসার কথা বলে চলে এ প্রতারণা। এরপর চলে পরবর্তীতে চিকিৎসা শেষে গলাকাটা একটা বিল ধরিয়ে দেয় রোগীর স্বজনদের হাতে, বিল দিতে না পারলে অনেক সময় রোগীদের আটকেও রাখা হয়। এ দালাল চক্রে রয়েছেন জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড বয় সাইদুল বাশার, আলামিন, সমির বৈদ্য, শামীম মিয়া, ফারুক নানান কৌশলে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তুলে দেয় হাসপাতালের গেটের বাইরে থাকা বিভিন্ন হাসপাতালের দালাদের হাতে। পরে দালালদের কাছ থেকে প্রতি রোগী অনুযায়ী দেওয়া হয় কমিশন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জরুরি বিভাগ থেকে মূল হোতা ওয়ার্ড বয় সাইদুল বাশার রোগী পাচারের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে এবং জুনিয়র ওয়ার্ড বয়দের দিয়ে এ রোগী পাচারের কাজ করতে বাধ্য করায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, হাসপাতালের কর্মকর্তা ও কর্মচারী সমিতির কিছু সদস্য এ রোগী পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। সমিতির সঙ্গে চুক্তি করেই জরুরি বিভাগের ওয়ার্ড বয় থেকে রোগী নিয়ে যায় উত্তরার আসে পাশের প্রাইভেট হাসপাতালগুলোয় এবং দালালরা মেডিকেলের কর্মকর্তা কর্মচারী সমিতিকে প্রতি মাসে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা দিয়ে হয় বলে দাবি করেন। রোগী পাচারে কেউ বাধা দিলে বা নিষেধ করলে তাদের বিভিন্ন প্রকার হুমকি-ধমকি, মারধর ও হত্যার চেষ্টা করা হয়। এ বিষয়ে সমিতির সদস্যসহ বেশকিছু রোগীর দালালদের নামে রয়েছে মামলা। যেটি বর্তমানে পিবিআই তদন্তাধীন। এদের মধ্যে মূল দালাল লেকভিউ হাসপাতালের রাজু এবং রাজুর ২ ছেলে পলাশ ও সম্রাট। এরা হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় এবং সমিতির সদস্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হাসপাতাল থেকে নানান কৌশলে রোগী নিয়ে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কিছু অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার বলেন, রোগী মারা যাবে এমন আতঙ্ক সৃষ্টি করে অল্প খরচে শিনশিন জাপান হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর কথা বলে ভর্তি করানো হয়। এরপর বেরিয়ে আসে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আসল রূপ। পরে বিষয়টি সাংবাদিকদের জানালে তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পান, উত্তরা পশ্চিম থানার এসআই শামসুল ও শিনশিন জাপান হাসপাতালের জিএম শরিফ ওয়াকিটকি হাতে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ভিকটিমের স্বজনদের সঙ্গে টাকা আদায়ের বিষয়ে খারাপ আচরণ করছেন। সাংবাদিকদের কেন জানানো হলো, এ অপরাধে এসআই শামসুল ভিকটিমের স্বজনদের একজনকে আটক করে পুলিশের গাড়িতে উঠানোর চেষ্টা করেন। পরে সাংবাদিকদের জেরার মুখে তাৎক্ষণিক ছেড়ে দেওয়া হয় ভিকটিমকে।
এ বিষয়ে জানতে শিনশিন জাপান হাসপাতালের ডিরেক্টর বাবুর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। উত্তরা জোনের ডিসি মোর্শেদ আলম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করছেন। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। শিনশিন জাপান হাসপাতালের জিএম শরিফুর রহমান শরিফের কাছে ঘটনা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন এবং হাসপাতালের গেট বন্ধ করতে বলেন দারোয়ানকে।
তিনি বলেন, আমার হাসপাতালে যেটাই হোক, কোনো সাংবাদিক প্রবেশ করতে পারবেন না। যা পারেন করেন আপনারা বলে চলে যান।