মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া ও জীবন নির্বাহের খরচ বেড়ে যাওয়ায় জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমেছে। সুদ হার কমিয়ে দেওয়াও সঞ্চয়পত্র বিক্রি হ্রাস অন্যতম কারণ। মার্চ মাসের সঞ্চয়পত্র বিক্রির তথ্য বিশ্লেষণে এমন আভাস দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।
জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ ৯ মাসে ১৬ হাজার ৫০৪ কোটি ১৩ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ হাজারের ৬৯৮ কোটি ৫২ লাখ কম। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩৩ হাজার ২০২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
জীবন নির্বাহের খরচ বেশি, আয় কম এবং সুদ হার কমিয়ে দেওয়ার কারণে সঞ্চয়পত্রে মানুষ বিনিয়োগ কমিয়ে দিচ্ছেন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তারা মনে করছেন, দুই বছর ধরে করোনা মহামারীর মধ্যেও নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা নাগালের মধ্যে ছিল। পাশাপাশি মানুষ খরচও কমিয়ে দিয়েছিল, অতিজরুরি খরচ ছাড়া পারত পক্ষে মানুষ কেনাকাটা করেনি। এতে মানুষের হাত থেকে টাকা বের হয়ে যায়নি। করোনার কমে আসার পেক্ষাপটে অথনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতি যেমন বেড়েছে, তেমনি রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক যে মূল্যস্ফীতির আঘাত লেগেছে তার বড় আঘাত বাংলাদেশে লেগেছে। এতে আরও একবার খরচ বেড়েছে মানুষের। এতে মানুষ সঞ্চয় কমিয়ে দিয়েছে। সঞ্চয়পত্রের বিক্রিতে এমন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়া ও সঞ্চয়পত্রে সুদ কমানোর কারণে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমেছে। কড়াকড়ি আরোপ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হ্রাস অন্যতম কারণ।
তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, সঞ্চয়পত্র কেনার পূর্বশর্ত এনআইডি ও টিআইএন প্রদর্শন এবং ব্যক্তির সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে পরিমাণ বেধে দেওয়ার কারণে একজন ইচ্ছামত সঞ্চয়পত্র কয় করতে পারছে না। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমার এটাও অন্যতম প্রধান কারণ। তবে রাশিয়া ইউক্রেইন যুদ্ধের সরাসরি অভিঘাত সঞ্চয়পত্রে পড়ছে না বলে মনে করেন এই জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ।
তথ্য অনুযায়ী, সবশেষ মার্চ মাসে ১ হাজার ৮১৪ কোটি ৭২ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৫২২ কোটি টাকা; তারও আগে জানুয়ারি মাসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল ২ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।
অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে। মানুষের জীবনযাত্রা ব্যয় বৃদ্ধি ও সঞ্চয় কমে আসার প্রেক্ষাপটে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে এই ভাটা পড়েছে। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে যে টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল, তার চেয়ে ৪৩৬ কোটি টাকা বেশি খরচ হয়েছে সুদ-আসল পরিশোধে।
অর্থাৎ ডিসেম্বর মাসে সরকার তার কোষাগার থেকে আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের সুদ-আসল বাবদ ৪৩৬ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।
বিক্রির চাপ কমাতে ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) বাধ্যতামূলক করা হয়।
সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে কড়াকড়ির কারণে মানুষের অঘোষিত টাকা সঞ্চয়পত্রে আসা কমেছে। এর ফলে প্রদর্শিত টাকাই বিনিয়োগ হচ্ছে বলে মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন।
উল্লেখ যে, অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা সরকারের কাছে বিনিয়োগ করে সুবিধা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে। শুরুতে না থাকলেও ক্রমান্বয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক সহ কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। তারপরও বাড়তে থাকে বিক্রি। সর্বশেষ সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমাতে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বরে থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের সুদ হার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। তারপর থেকেই বিক্রিতে ভাটা পড়ে।