রেলমন্ত্রীর ‘আত্মীয় পরিচয়’ দিয়ে বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করায় গত শুক্রবার রাতে ঈশ্বরদী থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেস’-এর তিন যাত্রীকে জরিমানা করেছিলেন রেলের ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরিদর্শক (টিটিই) শফিকুল। এই অপরাধে রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর নির্দেশে পরদিন টিটিইকে সাময়িক বরখাস্ত করে রেল কর্তৃপক্ষ।
এ ঘটনায় চার দিন ধরে দেশজুড়ে রীতিমতো তোলপাড় চলছে। ক্ষণে ক্ষণে ঘটনা নতুন নতুন রূপ পাচ্ছে। একই প্রসঙ্গে বারবার ভোল পাল্টাচ্ছেন রেলমন্ত্রী। এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের চিনেন না, রেল মন্ত্রীর এমন বক্তব্যে ছিল আগুনে ঘি ঢালার মতো। আবার শফিকুল যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছিলেন মন্ত্রী। এমনকি তাকে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত বলেও দাবি করেন রেল কর্তারা।
রেলমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরিস্থিতি বদলে যায়। রাতারাতি সমালোচনার মুখে মন্ত্রী নিজের অবস্থান পরিবর্তন করে বলেন, টিকিট না কাটা ব্যক্তিরা তার আত্মীয়। স্ত্রীর নির্দেশেই শফিকুলকে বরখাস্ত করা হয়! তাই শফিকুলকে পদোন্নতি দেওয়াসহ পুরস্কৃত করার চিন্তা করছে মন্ত্রণালয়।
গতকাল রোববার শফিকুলের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। তড়িঘড়ি করে বরখাস্তের আদেশ দেওয়ায় রেলের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (পাকশীর ডিসিও) নাসির উদ্দিনকে নোটিশ দিয়ে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, যার নির্দেশে ডিসিও এ কাজটি করেছেন তার কী হবে? কিংবা তাকে কোন অপরাধে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে এ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে রীতিমতো ট্রল চলছে। কারণ টিটিইকে বরখাস্ত করার নির্দেশদাতা হলেন খোদ মন্ত্রীর স্ত্রী! অনেকেই বলছেন, রেলমন্ত্রী নিজেই পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করেছেন। তিনি শান্ত থেকে সাধারণ ঘটনাটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। শনিবার এই ইস্যুতে গণমাধ্যমের সঙ্গে তার কথা বলা উচিত হয়নি বলেও অনেকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
টিটিইকে বরখাস্ত করার ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় হওয়ায় সরকারও বিব্রত। গতকাল রোববার তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর কথায় ট্রেনের ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) শফিকুল ইসলামকে বরখাস্ত করা ঠিক হয়নি। তথ্যমন্ত্রী বলেন, কথিত আত্মীয়দের রেলমন্ত্রীর না চেনার তথ্য সঠিক, একই সঙ্গে মন্ত্রীর স্ত্রীর কথায় (টিটিইকে) সাময়িক বরখাস্ত সমীচীন নয়।
এদিকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের খবরে স্বস্তি প্রকাশ করে ধন্যবাদ জানালেন রেলওয়ের ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) শফিকুল ইসলাম। গতকাল পাবনার পাকশীতে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের বিভাগীয় কার্যালয়ের সামনে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। যেহেতু আমি রেলওয়ের জন্য কাজ করি, দেশের জন্য কাজ করি, আমাকে আবার কাজে যোগদানের সুযোগ দিয়েছে, তাতে আমি খুশি।’
রেলমন্ত্রীর ‘আত্মীয় পরিচয়’ দিয়ে বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করায় গত ৪ মে রাতে ঈশ্বরদী থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর ‘সুন্দরবন এক্সপ্রেস’-এর তিন যাত্রীকে জরিমানা করেছিলেন টিটিই শফিকুল। কিন্তু রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতে পরদিন তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে রেল কর্তৃপক্ষ।
বিষয়টি প্রকাশ্যে এলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় সমালোচনা। টিআইবি এবং যাত্রী কল্যাণ সমিতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ওই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে শফিকুলকে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
এরপর রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন শনিবার সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেন, আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করা তিন যাত্রীর সঙ্গে তার ‘কোনো সম্পর্ক নেই’। তার ‘নাম ভাঙিয়ে’ কেউ হয়তো সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। যাত্রীদের সঙ্গে ‘খারাপ আচরণ করায়’ শফিকুলকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে তিনি কর্মকর্তাদের কাছে শুনেছেন।
কিন্তু বিনা টিকিটের ওই যাত্রীরা যে রেলমন্ত্রীর স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সে বিষয়টি তুলে ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। এরপর রোববার ফের সংবাদ সম্মেলনে এসে রেলমন্ত্রী বলেন, টিকিট ছাড়া ভ্রমণ করা যাত্রীরা যে তার আত্মীয়, তা তিনি জানতেন না।
মন্ত্রী জানান, টিটিই শফিকুল ইসলামের বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি তড়িঘড়ি করে বরখাস্তের আদেশ দেওয়ায় রেলের বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তা (পাকশীর ডিসিও) নাসির উদ্দিনকে নোটিশ দিয়ে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।
শফিকুল ইসলাম সেদিন তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছেন মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, টিটিইর কাজ হলো রেলে শৃঙ্খলা আনা। তার কাজই তো রেলে যাত্রীদের সহযোগিতা করা, তাকে সাহায্য করা, সঠিক জায়গায় সেবা দেওয়া।
বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়া তিনজনের সঙ্গে সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রী জানান, মাত্র ৯ মাস হলো আমার বিয়ে হয়েছে। নতুন যে স্ত্রীকে আমি গ্রহণ করেছি, সে ঢাকাতেই থাকে। তার মামাবাড়ি ও নানাবাড়ি হলো পাবনা। আমি শুনেছি তারা আমার আত্মীয়। এটা এখন ঠিক, যেটা আমিও এখন শুনেছি। এর আগে পর্যন্ত আমি জানতাম না, এরা কারা এবং আমার জানার কথাও না।’
রেলমন্ত্রী বলেন, আমার স্ত্রী যদি কোনো ধরনের ভুল করে থাকে আমার ইনভলবমেন্ট ছিল না। যেটা বলা হচ্ছে বা টার্গেট করা হচ্ছে, মন্ত্রী এই কারণে এটা ঠিক না। তবে মেসেজটা যেভাবে গেছে এটা সঠিক হয়নি।
তিন যাত্রীকে জরিমানা করায় টিটিই বরখাস্ত হওয়ার ঘটনায় মন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আকতার মনির নির্দেশনা ছিল বলে সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী সুজন বলেন, আমিও বিষয়টি শুনেছি।
সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করার পরও টিটিই বরখাস্তের ঘটনায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না? জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, নেতিবাচক ধারণা তো অবশ্যই হবে। এটা ভুলভ্রান্তি হলে মানুষ সেভাবে দেখবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শফিকুল ইসলামকে পদোন্নতি বা অন্যান্য সুযোগসুবিধা দেওয়া হতে পারে। তাকে পুরস্কৃত করার কথাও ভাববে রেলপথ মন্ত্রণালয়।
টিআইবির বিবৃতি প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, টিআইবি দ্রুত সময়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। এখানে মন্ত্রীর কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কি না তা দেখার আগেই তারা এটা করেছে।
এদিকে মন্ত্রণালয় ও দপ্তরসমূহে মন্ত্রীর স্ত্রীদের বেপরোয়া হস্তক্ষেপ ও বেআইনি নির্দেশনা। তদবির বাণিজ্য বন্ধ করা। টিকিটবিহীন যাত্রী হিসেবে রেল ভ্রমণরত মন্ত্রীর আত্মীয়কে জরিমানাকারী টিটিই শফিকুল ইসলামের বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার করে স্বপদে পুনর্বহাল করা এবং মন্ত্রণালয়ের কাজে স্ত্রীর অনৈতিক নির্দেশনা প্রদানের দায়ে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। গতকাল গণমাধ্যমে প্রেরিত এক বিবৃতিতে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এই দাবি জানান।
তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে যেখানে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছেন, সেখানে কিছু কিছু মন্ত্রীর স্ত্রীদের অবৈধ আদেশ-নির্দেশ পালনের ফলে বিভিন্ন দপ্তরের কাজে অনিয়ম-দুর্নীতি এখন আকাশচুম্বী।
অপরদিকে টিটিইর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেওয়া মো. ইমরুল কায়েস রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মী আক্তারের মামাতো বোন ইয়াসমিন আক্তার নিপার ছেলে। তার ট্রেনযাত্রার সঙ্গী হাসান ও ওমর রেলমন্ত্রীর স্ত্রী শাম্মীর মামাতো ভাই।
মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেওয়া সেই তিন যাত্রীর একজন ইমরুল কায়েস প্রান্তের মা ইয়াসমিন আক্তার নিপা পরে বলেন, রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের স্ত্রী শাম্মী আক্তার মনির ফোনের পরই ট্রেনের ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক (টিটিই) বরখাস্ত হন।
এদিকে শুক্রবারের ঘটনার ব্যাখ্যা জানতে রোববার বিভাগীয় বাণিজ্যিক কর্মকর্তার (ডিসিও) কার্যালয়ে তলব করা হয়েছে শফিকুল ইসলামকে। রেলের পাকশী বিভাগীয় সহকারী পরিবহণ কর্মকর্তা সাজেদুল ইসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটিও গঠন করা হয়েছে। টিটিইকে সাময়িক বরখাস্ত করা ডিসিও নাসির উদ্দিন লিখিত বক্তব্যে দাবি করেছেন, শফিকুল মানসিক বিকারগ্রস্ত। অতীতেও তিনি যাত্রী ও সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছেন।