logo
আপডেট : ৯ মে, ২০২২ ১২:০১
তৃতীয় নয়ন
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন
নিজস্ব প্রতিবেদক

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন

জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি প্রায় শূন্যের পর্যায়ে নামিয়ে না আনতে পারলে এক সময় বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান তথা খাদ্য ও বাসস্থান সংস্থানে সংকট দেখা দেবে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সুতরাং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উচিত এখনই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যার নাম জনসংখ্যা সমস্যা। ছোট্ট ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির এ দেশে বিপুল জনসংখ্যা অনেক সমস্যাকে উস্কে দিচ্ছে। ফলে এক বিরূপ ও প্রতিকূল সময়ের মধ্য দিয়ে আমাদের আগামীর দিকে অগ্রসর হতে হচ্ছে।


অনেকে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের উদাহরণ টেনে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে আশীর্বাদ হিসেবে দেখলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ঠিক মানানসই হচ্ছে না। কেননা, দেশের বিপুল জনসংখ্যা তখনই আশীর্বাদ হিসেবে পরিগণিত হয়, যখন জনসংখ্যাকে সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা যায়। কিন্তু সরকারের আন্তরিকতার কারণে আমাদের দেশে শিক্ষার হার বাড়লেও শিক্ষিত লোকদের মধ্যে অধিকাংশই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা পর্যাপ্ত পরিমাণ না থাকায় পুঁঁথিগত বিদ্যার ওপর এখানে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। ফলে কর্মমূখী শিক্ষার সুযোগ কম হওয়াতে বেকার সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।


অপরদিকে, তার একটা বড় অংশ বিভিন্ন অপরাধসহ মাদক কেনা-বেচা ও ব্যবহারে জড়িত হয়ে দেশে বিভিন্ন অঘটনের জন্ম দিচ্ছে। বাংলাদেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনেক কারণের মধ্যে মূল কয়েকটি কারণ হলো- গ্রীষ্মম-লে অবস্থিত এ দেশের আবহাওয়া মানুষকে দ্রুত প্রজননক্ষম করে তোলে। কুসংস্কার ও ধর্মীয়ভাবে গোঁড়া জনগণ জন্মনিয়ন্ত্রণকে ধর্মবিরোধী বলে মনে করে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে পুত্রসন্তান কামনায় এবং পারিবারিক ও গোষ্ঠীগত শক্তির বৃদ্ধি কামনায় অধিক সন্তান জন্ম দেয়। নি¤œমানের জীবনযাত্রা, দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহও এজন্য দায়ী। তাছাড়া, আমাদের দেশে এখনো ৬৬ শতাংশ নারীর বিয়ে হয় কিশোরী বয়সে। এসব ব্যাপারে আমরা উদাসীন। ফলে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ জনপদে পরিণত হয়েছে। আয়তনে বাংলাদেশ বিশ্বের ৯০তম রাষ্ট্র হলেও জনসংখ্যার দিক দিয়ে বিশ্বে সপ্তম এবং এশিয়ায় পঞ্চমতম দেশ।


প্রখ্যাত ইংরেজ অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস তাঁর বিখ্যাত জনসংখ্যা তত্ত্বে প্রচার করেন, যেকোনো দেশের মানুষের মারাত্মক ভিড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনে। ম্যালথাস তাঁর জনসংখ্যা তত্ত্বে বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে, অর্থাৎ ১, ২, ৪, ৬, ৮...। আর খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে, অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৫...। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে খাদ্যোৎপাদন তাল মিলাতে পারে না। ফলে বর্ধিত জনসংখ্যা নিয়ে পৃথিবীর বুকে বিপত্তির সৃষ্টি হবে। তিনি আরো মত প্রকাশ করেন যে, পৃথিবীতে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সম্পদ সে হারে বাড়ছে না এবং জনসংখ্যার মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে প্রকৃতিই বিরূপ হয়ে তা হ্রাস করার পদক্ষেপ নেবে।

 

বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যাকে তাত্ত্বিক বিবেচনায় আশীর্বাদ হিসেবে অভিহিত করা গেলেও কর্মক্ষমতাসম্পন্ন জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ জাতীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাচ্ছে না, যাদের অধিকাংশই নারী। সুতরাং জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি প্রায় শূন্যের পর্যায়ে নামিয়ে না আনতে পারলে এক সময় বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান তথা খাদ্য ও বাসস্থান সংস্থানে সংকট দেখা দেবে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সুতরাং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উচিত এখনই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া


মূলত বাংলাদেশে ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের কার্যকারিতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদিও সমুদ্রসীমা বিজয়ের ফলে আমাদের দেশের আয়তন সামান্য বেড়েছে এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে খাদ্য উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি, কয়েক বছর ধরে সরকার চালও রপ্তানি করে আসছে। তারপরও দরকার জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ। এখনই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারে লাগাম টেনে না ধরলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে খাদ্য সংকট ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। কারণ, সমুদ্রসীমা বেড়ে আয়তন বাড়লেও দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে নতুন নতুন বাড়িঘর নির্মাণ ও শিল্প-কারখানা নির্মাণে কৃষিজমি এবং স্থলভূমি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে যারা কাজ করেন, তারা আদৌ তৃণমূল পর্যায়ে যায় না বিধায় দেশের কিছু মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণ মেনে চললেও বস্তি এলাকার লোকজন এবং প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকার মানুষ জন্মনিয়ন্ত্রণে রাজি নয়। ফলে তাদের এক পরিবারে ৬-৭টা করে বাচ্চা জন্ম হচ্ছে এবং রাষ্ট্রের জনগণের এক বড় অংশের অসচেতনতার কারণে দেশ ভরে যাচ্ছে মানুষে। আবার রোহিঙ্গা সমস্যা আরেক ‘বিষ ফোঁড়া’ হিসেবে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের জন্য। এদের জন্য বাসস্থানের যোগান দিতে হাজার হাজার একর বনভূমি বিরানভূমিতে পরিণত হয়েছে।


সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকা মারফত জানা যায়, প্রতি ১৩ সেকেন্ডে দেশে একজন শিশুর জন্ম হচ্ছে এবং প্রতি ১৪৪ সেকেন্ডে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। গড় হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতি ২মিনিট ২৪ সেকেন্ডে মোট জনসংখ্যার ১১ জন বৃদ্ধির বিপরীতে একজনের মৃত্যু হওয়ায় ওই সময়ে জনসংখ্যায় ১০ জন যুক্ত হচ্ছে। এক দিনে যুক্ত হচ্ছে প্রায় ৬ হাজার মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, ১৯৭৪ সালে জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১৪ লাখের মতো। ১৯৯১ সালে ১০ কোটি ৬৩ লাখ এবং ২০১১ সালে দাঁড়ায় ১৪ কোটি ২৩ লাখ। জনসংখ্যাবিদদের হিসাবমতে, জানুয়ারি-২০১৮তে মোট জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এমএসভিএবি (৩য়) প্রকল্পের প্রতিবেদনে ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক ২০২০’ প্রকাশনার তথ্য মতে, ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৯১ লাখ ১ হাজার, যা ২০২০ সালে ছিল ১৬ কোটি ৮২ লাখ ২ হাজার। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৩০।


বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যাকে তাত্ত্বিক বিবেচনায় আশীর্বাদ হিসেবে অভিহিত করা গেলেও কর্মক্ষমতাসম্পন্ন জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ জাতীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাচ্ছে না, যাদের অধিকাংশই নারী। সুতরাং জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি প্রায় শূন্যের পর্যায়ে নামিয়ে না আনতে পারলে এক সময় বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান তথা খাদ্য ও বাসস্থান সংস্থানে সংকট দেখা দেবে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। সুতরাং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উচিত এখনই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেওয়া।

লেখক: শিক্ষক ও কলাম লেখক