logo
আপডেট : ৯ মে, ২০২২ ১২:০৭
পরিবেশ-প্রতিবেশ
পরিবেশবান্ধব ও বজ্রপাত প্রতিরোধক ‘তালগাছ’
নিজস্ব প্রতিবেদক

পরিবেশবান্ধব ও বজ্রপাত প্রতিরোধক ‘তালগাছ’

বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ বেশ কার্যকর- এটা প্রমাণিত হয়েছে ইতোমধ্যে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটছে। প্রায়ই বজ্রপাতে মৃত্যুর সংবাদ দৃষ্টিগোচর হয়। অকালে ঝরে যায় বহু তাজা প্রাণ। এই ভয়াল প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে আমাদেরকে রক্ষা করতে পারে ‘তালগাছ’। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে সারা দেশে রাস্তার দু’পাশে তালগাছের চারা-আঁটি রোপণের জন্য ২০১৭ সালে নির্দেশ দিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর কাবিখা-টিআর প্রকল্পের আওতায় তালগাছের চারা-আঁটি লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। দেশে সবুজায়ন বৃদ্ধি করতে গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করে আসছে পরিবেশবাদী সংগঠন সবুজ আন্দোলন যার মধ্যে বজ্রপাত নিরোধক তালগাছও রয়েছে।


বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ বেশ কার্যকর- এটা প্রমাণিত হয়েছে ইতোমধ্যে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। কারণ তালগাছের বাঁকলে পুরু কার্বনের স্তর থাকে। তালগাছের উচ্চতা ও গঠনগত দিক থেকেও বজ্রপাত নিরোধে সহায়ক হতে পারে। তালগাছের পাশাপাশি নারিকেল গাছ, সুপারি গাছের মতো উচ্চতাসম্পন্ন গাছ বজ্রপাত নিরোধে বেশ কার্যকর। এ কথা আজ বলতেই হয়- প্রকৃতি দিয়েই প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে প্রকৃতিই বাঁচার উপায়।


শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে বজ্রপাত। এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষের ভাবনার অন্ত নেই। আর তাই বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ কাজে লাগানো দরকার। সরকারি ব্যবস্থাপনায় তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ও এ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এখন সবাই মিলে তালগাছ লাগানোর পাশাপশি নারিকেল গাছ, সুপারি গাছ লাগানোর উদ্যোগকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে।


ঘন সবুজে আবৃত বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, মাঝখানে কর্দমাক্ত মেঠোপথ, তার দু’পাশে মাথা উঁচু তালগাছ আমাদের উপকূল ও গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। এমন সুন্দর ও নৈসর্গিক দৃশ্য এখন খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে পরিবেশবান্ধব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষাকারী পরম বন্ধু তালগাছ। এ কারণে বজ্রপাতের (বিদ্যুৎস্পর্শ) হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না মানুষ, পশু-পাখিসহ জীববৈচিত্র্য। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে/ উঁকি মারে আকাশে...। আবার খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দিনের ‘ঐ দেখা যায় তালগাছ/ ঐ আমাদের গাঁ/ ঐ খানেতে বাস করে কানা বগির ছাঁ...। জনপ্রিয় এসব ছড়া যুগ যুগ ধরে বাঙালিকে তালগাছের কথা স্মরণ করিয়ে আসছে। আশ্রয় হিসেবেও এ গাছ বাবুই পাখিদের প্রিয় জায়গা। বাবুই ছাড়াও অঞ্জন, বাদুরসহ নানা ধরনের প্রাণী আশ্রয় হিসেবে এ গাছটি বেছে নেয়।

 

শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে বজ্রপাত। এই দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য মানুষের ভাবনার অন্ত নেই। আর তাই বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ কাজে লাগানো দরকার। সরকারি ব্যবস্থাপনায় তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ও এ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এখন সবাই মিলে তালগাছ লাগানোর পাশাপশি নারিকেল গাছ, সুপারি গাছ লাগানোর উদ্যোগকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। ঘন সবুজে আবৃত বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, মাঝখানে কর্দমাক্ত মেঠোপথ, তার দু’পাশে মাথা উঁচু তালগাছ আমাদের উপকূল ও গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি


আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০২০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে মৃত্যুবরণ করেছেন ২ হাজার ১৬৪ জন মানুষ। এক্ষেত্রে ২০১১ সালে ১৭৯ জন, ২০১১ সালে ২০১ জন, ২০১৩ সালে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে ১৬৮ জন ও ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেছেন ২৩৬ জন। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২১৬ জনের বেশি মানুষ প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে মৃত্যুবরণ করেছে। আর ২০২১ সালে বজ্রপাতে অন্তত ৩৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিবছর মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
চলতি বছরে ২০২২ সালের ৩ মে পর্যন্ত বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৩৫। বুধবার (০৪ মে) সকালেও কক্সবাজার একজন লবণচাষি ও ফরিদপুরে একজন কৃষক মারা গেছেন। ওই কৃষকের সঙ্গে তার হালের গরুটিও মারা যায়। এমনকি ঈদের দিনও দেশে বজ্রপাতে মারা গেছে অন্তত ৮ জন মানুষ।


সাধারণত একটি তালগাছ ৯০ থেকে ১০০ ফুট উঁচু হয়। উঁচু গাছ হওয়ায় বজ্রপাত সরাসরি এ গাছের মাধ্যমে মাটিতে গিয়ে আমাদের রক্ষা করে। এ ছাড়াও ভূমিক্ষয়, ভূমিধস, ভূগর্ভস্থ পানির মজুদ বৃদ্ধি ও মাটির উর্বরতা রক্ষা করে। তালগাছের আকর্ষণে বাড়ে মেঘের ঘনঘটা; ঘটে বৃষ্টিপাতও। তালগাছের শিকড় মাটির অনেক নিচ পর্যন্ত প্রবেশ করায় ঝড়ে হেলে পড়ে না কিংবা ভেঙে পড়ে না। যেখানে কোনো কিছু চাষ হয় না সেখানেও তালগাছ তার শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে যায়। নতুন রাস্তার ল্যান্ডস্কেপ, বাঁধ ও নদীভাঙন ঠেকাতে তালগাছের রয়েছে সফল প্রয়োগ।


তালগাছ শুধু বজ্রপাতের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে না বরং তালগাছের রয়েছে আরো নানা উপকারিতা। মানুষ বিভিন্নভাবে তালগাছ দ্বারা উপকৃত হয়। যেমন- তালপাতার পাটি, তালপাতার পাখা, তালের রস, তালের গুড়, তালের শাষ দিয়ে সু-স্বাদু খাবার তৈরি করা হয়, তাল দিয়ে ঐতিহ্যবাহী অনেক পিঠা তৈরি করা হয়। তালের গাছ ও পাতা ঘরের কাজে এবং জ্বালানি কাজে ব্যবহার করা হয়। তালগাছ বাবুই পাখির আবাসস্থান। তালের পাতায় সুন্দরভাবে বাসা তৈরি করে সেখানে তারা বসবাস করে। এগুলো আমাদের গ্রাম অ লের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে যুগের পর যুগ। তালগাছ মানুষ ও পাখি উভয়ের জন্যই পরম উপকারি।


তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তার দুই পাশে, পুকুর পাড়ে, বাড়ির আশপাশে, পরিত্যক্ত জায়গায় তালগাছ রোপণ করি। আমরা যদি নিজেরা ও গ্রামের সবাইকে সচেতন করে তাল বীজ বপনে উদ্যোগী করে তুলতে পারি তবে এতে মানুষসহ পশুপাখি বিভিন্নভাবে উপকৃত হবে। আর বজ্রপাত থেকে জীবন রক্ষায় উঁচু তালগাছের তো কোনো বিকল্পই নেই। আজ স্লোগান হোক- ‘বেশি করে তালগাছ লাগাই, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাই’। গ্রামীণ ও উপকূলীয় জনপদে তালগাছের পরিকল্পিত চাষে নান্দনিক সৌন্দর্যরূপ তুলে ধরে তালগাছে প্রকৃতি সাজাই, জীবন বাঁচাই। আসুন, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিদায় ও বরণ অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা সম্মিলিতভাবে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সবাই অন্তত একটি তালবীজ বপন করি। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কিংবা অভিভাবকগণ একটু উদ্যোগ নিলেই বদলে যাবে আমাদের চিরচেনা পরিবেশ ও প্রতিবেশ। এটাই হোক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিদায় ও বরণ অনুষ্ঠানের সেরা উদ্যোগ। সারাদেশে গড়ে উঠুক তালগাছে ঘেরা প্রকৃতির সবুজ বেষ্টনী।

লেখক: জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা এবং ‘সবুজ আন্দোলন’ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক