এ লেখার শিরোনামটিতে ব্যবহৃত ‘তোমারে’ অর্থ তোমাকে নয়। ‘তোমারে’ একটি জাপানি শব্দ। যার অর্থ ‘স্টপ’ বা দাঁড়াও। এ শব্দটি জাপানের প্রায় সব রাস্তার ইলেকট্রিক ট্রাফিক সিগন্যালের পূর্বে মাটিতে সাদা অথবা হলুদ রঙে এবং কখনো রাস্তার পার্শ্বে সাদা গোল প্লেটে লাল অক্ষরে (জাপানিজ অক্ষর হিরাগানা, কাঞ্জি বা অবস্থাভেদে ইংরেজিতে) লেখা থাকে। ট্রাফিক সিগন্যাল লাল হলে ‘তোমারে’ লেখা শব্দটি পার হয়ে কোনো গাড়ি বা মানুষ সামনে যায় না। বড়জোর ‘তোমারে’ লেখাটির উপরে সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায়। লেন ব্রেক করে উল্টোপাল্টা দাঁড়ালে এবং কারো গায়ে বা গাড়িতে লেগে কোনো সমস্যা হলে যার কারণে সমস্যাটি হবে সে তার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য। সিগন্যালে কোনো ট্রাফিক পুলিশ থাকে না বরং সেন্সর ও ক্যামেরা বসানো থাকে যার মাধ্যমে নিকটস্থ কোনো অফিসে বসে ট্রাফিক পুলিশ সেটা পর্যবেক্ষণ করেন। রাস্তায় বড় দুর্ঘটনা হলে সঙ্গে সঙ্গেই তার সংবাদ পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেডের কাছে পৌঁছে যায়। এছাড়া বড় বড় রাস্তায় টহল পুলিশ থাকেন, তারা দ্রুত নিকটস্থ দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে যেতে পারেন।
কেউ ইচ্ছাপূর্বক বারবার ট্রাফিক আইন অমান্য করলে ভিডিও দেখে তার ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হয়। অপরাধীর অফিসের মাসিক বেতন থেকে জরিমানা কেটে নিয়ে একটি মেসেজ অথবা বাসায় একটি চিঠি পাঠিয়ে দেয়া হয়। যিনি ভিকটিম তিনি দ্রুত ক্ষতিপূরণ পেয়ে যান। শুধু জরিমানার ভয়ে মানুষ এ ধরনের অপরাধ করে না, তা নয়। প্রতিটি মানুষ সেখানে অপরের মর্যাদা ও কল্যাণের প্রতি সচেতন, সবার জন্য সহানুভূতিশীল। আইনের বাধ্যবাধকতা, প্রশাসনিক বিধিনিষেধ এবং সামাজিক, নৈতিক ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ মিলে সেখানে এক অনবদ্য দৈনন্দিন জীবনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
নির্ধারিত গতিসীমার উর্ধ্বে ধাবমান যেকোনো গাড়িকে টহল পুলিশ যেকোনো সময় সাইরেন বাজিয়ে অথবা গাড়ির মাইকে ‘তোমারে’ বা দাঁড়াও বলে আটকিয়ে দেন। যখন কোনো বিলাসী ধনী দুলালদের সামুরাই, নিনজা-জাতীয় বাইকগুলো বিকট শব্দ করে সবার কানে তালা লাগিয়ে এঁকে-বেঁকে দ্রুত গতিতে রাজপথে আইন অমান্য করে ছুটে চলে তখন টহল পুলিশ তাদেরকে থামানোর জন্য পিছু নেয় ও এক সময় ‘তোমারে’ বলে ঘিরে ধরে। কোনো উৎসবের সময় বা গভীর রাতে রাস্তায় এ সমস্যাটা বেশি দেখা যায়। তবে সাধারণত ওদের দেশে রাস্তায় চলতে গিয়ে কখনোই সময়ের অপচয় হয় না। এ ব্যাপারে প্রতিটি মানুষ যেন ‘সদা সতর্ক’। ‘তোমারে’ বা দাঁড়াও বলে সবাইকে প্রয়োজনে আটকিয়ে দেয়া যায়।
আমাদের দেশে ব্যাপারটা উল্টো। এ দেশের রাস্তায় ট্রাফিক সিগন্যাল লাল-সবুজ যাই পড়–ক না কেন, পথচারী বা যানবাহন উভয়কে আটকানোতেই ভীষণ বেগ পেতে হয়। বলা বাহুল্য, এ দেশে সমাজ জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে মানুষ নিয়ম না মানার যে ‘বদঅভ্যাস’ রপ্ত করেছে তাতে সিগন্যাল না মানাটাই যেন বাহাদুরী!
সেদিন সকালে খুব গরম পড়েছিল। পরীক্ষার হলে সন্তানকে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নিয়েছি। বৃষ্টিতে রাস্তা কিছুটা পিচ্ছিল হওয়ার কারণে কম গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। সবার বেশ তাগাদা। সবাই ছুটছেন নিজ নিজ গন্তব্যে। রাজপথে নানা যানবাহন-এমনকি ঘোড়ার গাড়িও পাশে দৌড়াচ্ছে। কেউ কাউকে সমীহ-পরোয়াও করছে। সবার উদ্দেশ্য আগে সামনে যাবে।
আমাদের জাতীয় মহাসড়কের সংখ্যা কম এবং একটি রাস্তা কোনো কারণে বন্ধ হলে বিকল্প পথ খোলা নেই। এসব রাস্তা লোভী ঠিকাদার ও প্রকৌশলী দ্বারা অতি নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে নির্মাণ করা হয়। রাস্তার পাটাতন নিম্নমানের হওয়ায় গাড়ি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, দুর্ঘটনা বেশি হয় এবং কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই বিকল্প পথ না থাকায় সময় নষ্ট হয় ও ভোগান্তি বাড়ে। এক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা ও কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা কে করবে? যদি দলীয়, অনভিজ্ঞ, অতি মুনাফালোভী, স্বজনদেরকে অবৈধভাবে ঠিকাদার বানিয়ে রাস্তা নির্মাণের কর্মাদেশ দেয়া হয় তাহলে দেশের মানুষের যানজট ভোগান্তি কেয়ামত পর্যন্ত চলতেই থাকবে বৈকি?
বড় রাস্তার চৌমাথায় এসে ঘটল বিপত্তি। চতুর্দিকে গাড়ির জটলা! ট্রাফিক সিগন্যালের ইলেকট্রিক আলো জ্বলে না। ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারা ও হুইসেলকে কেউ তোয়াক্কা করছেন না। একসময় সবাই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। লেগে গেল মহাজট! সবাই বেহুঁশের মতো হর্ণ বাজাচ্ছে। রিকশাওয়ালারা গালাগালি এমনকি একজন মারামারি শুরু করে দিয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ চুপ করে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। বেচারার আসলেই কিছুই করার নেই! আমাদেরও নেই। ভাবলাম কেন এমন হলো? কেন এমন হয়? একদিন দুদিন নয় হরহামেশা- প্রতিদিনই তো কোথাও না কোথাও এমনটা হয়ে থাকে! টোকিওর কথা মনে পড়ল। পৃথিবীর সবচেয়ে গাড়িবহুল শহরেও তো এমন জট চোখে পড়ে না! সবচেয়ে গাড়িবহুল, জনবহুল এ শহর পৃথিবীর সবচেয়ে পরিষ্কার শহরও বটে। যাহোক, সেদিনের বিশ্রী অভিজ্ঞতার কথা আর না-ই বা বাড়াই।
আমাদের শহরগুলোর যানজটের প্রধান কারণ- মানুষের অনিয়ম। ড্রাইভার, যাত্রী, ট্রাফিক পুলিশ, পথচারী সবাই অনিয়ম করছি। রাস্তা তো ফুটবল মাঠ নয় যে, যেদিকে খুশি বল নিয়ে দৌড়ানো যাবে। কিন্তু রাস্তায় নামলেই আমরা সবাই খুব বেপরোয়া হয়ে উঠি। সবার মধ্যে যেভাবেই হোক সামনে যাওয়ার অসম প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ফলে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে রাস্তার পরিবেশ।
এ দেশে শহরগুলোতে প্রতিটি রাস্তায় বাণিজ্যিকভাবে দোকানপাট গড়ে উঠেছে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা নানা নামের বেসরকারি স্কুুল, কোচিং সেন্টার ও বাহারি সব বিদেশি নামধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনের পাশে মার্কেট এবং সেসব মার্কেটের ছাদে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। ক্ষতিকর ও মানহীন এসব ‘ব্যবসায়িক’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের সার্টফিকেট সর্বস্ব শিক্ষার বিকাশ আমাদেরকে মেধাহীন জাতি ও অনৈতিক মানুষ হিসেবে গড়ে তুলছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের ‘তোমারে’ কর্মসূচি কার্যকর করা জরুরি হয়ে পড়েছে; এদেরকে ছোট ছোট জেলা শহর বা উপজেলায় পাঠিয়ে দেয়া সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। তাহলে সরকারি বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভালো শিক্ষক পাবেন। তা না হলে বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরা শিক্ষকগণ নিজ প্রতিষ্ঠানে পড়ানো, কাজ ও গবেষণা বাদ রেখে রাতে-দিনে ওইসব বাহারি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স কনট্রাক্টর হিসেবে নিয়োজিত হতেই থাকবেন। দুঃখের বিষয়, সরকার এটা তো বন্ধ করতেই পারছে না অধিকন্তু সম্প্রতি আরো অনেক নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি দিয়েছে। ঢাকায় একটি নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অর্থ- আরো বেশি মানুষ, আরো বেশি গাড়ি, আরো বেশি যানজট, আরো বাড়তি জনভোগান্তি। এটা জাতির জন্য বড়ই দুর্ভাগ্য ও হতাশার কথা। এখন সরকারি নীতি-নির্ধারক ও ইউজিসির জন্যও ‘তোমারে’ বা থামুন কর্মসূচি কার্যকর করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
মহাসড়কগুলোতে যানজটের প্রধান কারণ মানুষের ‘অতি লাভ করার লোভ’। যা অবৈধ নীতিদ্বারা পরিচালিত হয়। আমাদের রাস্তাগুলো পৃথিবীর অনেক দেশের রাস্তার তুলনায় প্রশস্ত; তবে লেন বাড়ানো হলেও কোন লেনে কত স্পিডে গাড়ি চালাতে হয় তা লেখা নেই, কেউ মেনেও চলে না। ফাস্ট লেনে হাই স্পিডের গাড়ি না ওঠে রিকশা-ঠেলাগাড়ি ওঠে যায়। সিগন্যাল দিয়ে লেন পরিবর্তন করার আইন থাকলেও ড্রাইভাররা সেটা বোঝেন না বুঝতে চান না। অধুনা হাজারো অনভিজ্ঞ অটোরিকশা চালক ডানে সিগন্যাল দিয়ে বামে চলে যান! তাই জরুরি ভিত্তিতে লাখ লাখ অটোরিকশা চালকদের ‘তোমারে’ কার্যকর করবার জন্য মটিভেশনাল কর্মসূচি নেয়া দরকার।
এছাড়া আমাদের জাতীয় মহাসড়কের সংখ্যা কম এবং একটি রাস্তা কোনো কারণে বন্ধ হলে বিকল্প পথ খোলা নেই। এসব রাস্তা লোভী ঠিকাদার ও প্রকৌশলী দ্বারা অতি নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে নির্মাণ করা হয়। রাস্তার পাটাতন নিম্নমানের হওয়ায় গাড়ি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, দুর্ঘটনা বেশি হয় এবং কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই বিকল্প পথ না থাকায় সময় নষ্ট হয় ও ভোগান্তি বাড়ে। এক্ষেত্রে ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা ও কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা কে করবে? যদি দলীয়, অনভিজ্ঞ, অতি মুনাফালোভী, স্বজনদেরকে অবৈধভাবে ঠিকাদার বানিয়ে রাস্তা নির্মাণের কর্মাদেশ দেয়া হয় তাহলে দেশের মানুষের যানজট ভোগান্তি কেয়ামত পর্যন্ত চলতেই থাকবে বৈকি?
ভুল পরিকল্পনায় অনিয়ন্ত্রিত রাস্তাঘাটে জনজীবন আর কতদিন স্থবির হয়ে থাকবে তার কোনো সুরাহা আপাতত নেই। শুধু রাজধানী নয়, সব বড় শহর এমনকি হাইওয়ে, ফেরিঘাট সব জায়গায় মাইলের পর মাইল লম্বা গাড়ির সারি। ঢাকার রাজপথে ঈদের ছুটি ছাড়া সারা বছর গাড়ির চাকা থাকে অচল, স্থবির। কিন্তু ঘুষ-দুর্নীতির চাকা পুরোদমে সচল। রমজানের আত্মশুদ্ধি করার কথা থাকলেও প্রতারণা, লোভ-লালসার কোনো কমতি থাকে না। বরং এ সময় দ্রব্যমূল্য বাড়ানোসহ অন্যায় ও গর্হিত কাজের গতি বেড়ে যায় আরো বহুগুণ। এজন্য রাস্তার সিগন্যালে গাড়িকে দাঁড়াতে বলার প্রয়োজন হচ্ছে না, গাড়ি এমনিতেই অচল হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এ সময় আমাদের দেশে গাড়ির চেয়ে নিয়মকে অনিয়ম বানানো দুর্নীতিবাজ মানুষগুলোকে ‘তোমারে’ তথা থামতে বলা বেশি জরুরি। তাহলে রাস্তায় গাড়ির চাকা এমনিতেই সচল হতে পারে। কারণ গাড়ি তো নিজে থামে না, থামায় মানুষ।
তাই সবাই নিজ নিজ জীবনের সব কাজে ও দায়িত্বে সুনির্দিষ্ট নিয়ম শৃঙ্খলায় ফিরে আসুন, লোভ করা ভুলে যান, অতিলাভ বা অতি মুনাফা কমান, ঘুষ লেনদেন চিরতরে হারাম ষোষণা করুন। অবৈধভাবে নেব-দেব ও ‘একাই খাবো’ নীতি পরিহার করুন। আমাদের জাতীয় জীবনে শৃঙ্খলা ফিরে এলেই সামাজিক শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার হবে। তোমাকেই বলছি- ‘তোমারে’, ‘স্টপ’ বা দাঁড়ান! থামুন, একটু ভাবুন। বাহ্যিক ও নৈতিক উভয় শৃঙ্খলা আজ খুবই জরুরি। আগেরজনকে আগে যেতে দিন। মনুষ্যত্বকে শ্রদ্ধা ও সমীহ করুন। সবাইকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা না করে শুধু একা একা বাঁচার মধ্যে সার্থকতা কোনো কূলে বা কোনো কষ্মিণ কালেও ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকতে পারে না।
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিকবিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন