logo
আপডেট : ১০ মে, ২০২২ ১২:২৭
কম টাকায় জটিল রোগের উন্নত চিকিৎসা
#রয়েছে দক্ষ জনবল ও উন্নত চিকিৎসা উপকরণ #চিকিৎসা ব্যয়ের আকাশচুম্বী পার্থক্য #চিকিৎসা সুবিধা সম্পর্কে ধারণা নেই অনেকের #দালালদের কারণে চিকিৎসা ব্যয় হয়ে ওঠে ব্যয়বহুল
নিখিল মানখিন

কম টাকায় জটিল রোগের উন্নত চিকিৎসা

ফাইল ফটো

নামমাত্র খরচে জটিল রোগের উন্নত চিকিৎসা মিলছে সরকারি হাসপতালে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর চিকিৎসাব্যয় মানুষের নাগালের বাইরে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে রয়েছে দক্ষ জনবল ও উন্নত চিকিৎসা উপকরণ। কিন্তু সাধারণ মানুষের অনেকেই জানে না সরকারি হাসপাতালে কীভাবে, কি ধরনের চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায়।

এ নিয়ে অনেক সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং রোগী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়, ঘটে যায় অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারি চিকিৎসা সুবিধার বিষয়ে ধারণা না থাকায় প্রাপ্য চিকিৎসাসেবা আদায় করে নিতে পারেন না অনেক রোগী।

এ সুযোগে অনভিজ্ঞ রোগীদের কাছ থেকে বিনা টাকার চিকিৎসার ক্ষেত্রেও অর্থ আদায় করেন হাসপাতালের কিছু সংখ্যক অসাধু চক্র। এতে বিনা টাকার সরকারি চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ, যাতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। অথচ দেশের স্বাস্থ্য সেক্টরের ব্যাপক উন্নয়ন আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। সারাদেশে বিস্তার লাভ করেছে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, নামমাত্র খরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় সরকারি হাসপাতালে। বেশ কিছু পরীক্ষা করাতে স্বল্প ফি নেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও সরকারি ফি বেসরকারি হাসপাতালের ফির তুলনায় অনেক গুণ কম।

সরকারি হাসপাতালে করোনারি এনজিওগ্রাম ২ হাজার টাকা, সিটিস্ক্যানে ২ হাজার টাকা, এমআরআই ৩ হাজার টাকা, ইসিজি ৮০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ২০০ টাকা, এক্সরে ২০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ৩০০ টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ২ হাজার টাকা, ইউরিন ৩০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ১০০ টাকা। সব হাসপাতালে ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়।

বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা খরচ:
দেশের বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসাসেবার খরচ অনেকটা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। প্রতিটি অপারেশনে ১০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা লাগে। প্রতিদিন সিসিইউ সেবা পেতে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা এবং আইসিইউ সেবা পেতে লাগে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা। প্রতি সেশনে ডায়ালাইসিস করাতে খরচ হয় প্রায় ৫ হাজার টাকা। এভাবে করোনারি এনজিওগ্রামে ১৫ হাজার টাকা, সিটিস্ক্যানে ৪ থেকে ৬ হাজার টাকা, এমআরআই ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা, ইসিজি ৩০০ টাকা, ইকোকার্ডিওগ্রাম ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা, এক্সরে ৫০০ টাকা, আল্ট্রাসনোগ্রাম ১ থেকে ৩ হাজার টাকা, কার্ডিয়াক ক্যাথ ১৫ হাজার টাকা, ইউরিন ২০০ টাকা এবং রক্তের হিমোগ্লোবিন, টোটাল কাউন্ট করাতে লাগে মাত্র ৪৫০ টাকা।

হাসপাতাল ভেদে সরকারি চিকিৎসাসেবা:
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সেবা ফ্রি আর কম মূল্যে খোদ সরকারি হাসপাতালেই পাওয়া যায়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ১০ টাকার টিকিট নিয়ে জরুরি এবং বহির্বিভাগের চিকিৎসকের সেবা নিতে পারেন যে কেউ। তবে বহির্বিভাগের ক্ষেত্রে দেওয়া হয় ১০ টাকার টিকিটের সঙ্গে ফ্রি ওষুধ। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে হতদরিদ্রদের সেবা দেওয়া হয় বিনামূল্যে। সরকারি চিকিৎসাসেবা ও ব্যয় বোঝানোর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ এবং সরেজমিন ঘুরে কয়েকটি সরকারি হাসপাতালের চিত্র তুলে ধরা হলো।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল :
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফ্রি চিকিৎসা বিভিন্ন শ্রেণিভেদে হয়ে থাকে। হাসপাতালে অজ্ঞাত কোনো রোগী ভর্তি হলে তারা সিটিস্ক্যানসহ যে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ওষুধ-পথ্য সবই ফ্রিতে পেয়ে থাকেন। এছাড়া হাসপাতালে সব ধরনের ওষুধ সরবরাহ রয়েছে, যা বিনামূল্যে দেওয়া হয়ে থাকে। খুব কম রোগীরই দুই-একটি ওষুধ বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। প্রতি মাসে রেডিওলজি বিভাগে এক্সরের প্রায় ৫০ ভাগই ফ্রি করা হয়। আর সিটিস্ক্যানে ফ্রি হয় ১০ থেকে ২০ ভাগ। তবে হাসপাতালে কিছু অসাধু কর্মচারী রয়েছেন, যারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ফ্রি লিখিয়ে এনে রোগীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়।

ক্যানসার হাসপাতাল:
ক্যানসার নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট অ্যান্ড হসপিটাল। এখানে চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি ক্যানসার বিষয়ে গবেষণা এবং উচ্চপর্যায়ের পাঠদান করা হয়। ৩০০ শয্যার এই হাসপাতালে রোগীদের ক্যানসারের প্রায় সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়া হয়।

ক্যানসারের চিকিৎসা প্রধানত তিন ভাগে করা হয়- সার্জারি, রেডিওথেরাপি ও কেমোথেরাপি। মস্তিষ্ক এবং ফুসফুস ছাড়া সব ধরনের সার্জারি করা হয়। ইনডোর এবং আউটডোর মিলিয়ে প্রায় ৫০০ জন রোগী প্রতিদিন সেবা নিতে পারেন। এ ছাড়া বহির্বিভাগে প্রায় ৪০০ রোগীকে প্রতিদিন রেডিয়েশন দেওয়া হয়। কেমোথেরাপির ক্ষেত্রে ১৫০ জন রোগীকে ডেকেয়ার ভিত্তিতে আউটডোরে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

এ হাসপাতালের চারটি বিভাগ রয়েছে : ইনডোর, আউটডোর, পোস্ট অপারেটিভ ও ইমার্জেন্সি। আউটডোরে সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত চিকিৎসা দেওয়া হয়। রোগী যদি দরিদ্র হন এবং জনপ্রতিনিধির সার্টিফিকেট দেখান, তখন বিশেষ বিবেচনায় যেকোনো চিকিৎসা পুরোপুরি ফ্রি করা হয়। মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের স্ত্রী-সন্তানদের জন্য চারটি বেডসহ ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া সরকারি ও সামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিকিৎসাও ফ্রি।

ক্যানসার হাসপাতালে শুরুতে ১০ টাকা দিয়ে প্রথমে টিকিট কাটতে হয়। শয্যা ভাড়া ২৮৫ টাকা। কেবিন ৭৫০ টাকা। এখানকার ৬০ শতাংশ শয্যা ভাড়া দেওয়া হয়। বাকি ৪০ শতাংশ শয্যা বিনামূল্যে দরিদ্র রোগীদের জন্য রাখা হয়েছে। বিনামূল্যে চিকিৎসা করতে হলে পরিচালকের অনুমতি নিতে হয়। রেডিওথেরাপির মেশিন আছে দুটি।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল:
ব্রেইন স্ট্রোক রোগীদের উন্নত চিকিৎসা দানে দেশের প্রথম অত্যাধুনিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে সরকার। রাজধানীর শেরেবাংলানগরে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল’। নামমাত্র ফি দিয়ে অত্যাধুনিক চিকিৎসা সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায় এই প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে হাসপাতালে চালু আছে ১০০ বেড। বহির্বিভাগে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২.৩০ পর্যন্ত রোগী দেখা হচ্ছে। প্রত্যেক দিন ৩০০ থেকে ৪০০ রোগী সেবা নিচ্ছেন বহির্বিভাগে। এ হাসপাতালে রোগীদের আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে এমআর মেশিন, সিটিস্ক্যান, এনসিভিইএমজি মেশিন, নিউরো-ইনটার ভেনসনসহ আরো আধুনিক যন্ত্রপাতি।

হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. এম এস জহিরুল হক চৌধুরী জানান, ব্রেন এং মেরুদণ্ডের অপারেশনের গাইড লাইন, রোগী হাসপাতালের আসার সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রোকজনিত রোগ নির্ণয় জন্য এমআর মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে রোগী খরচ পড়বে তিন হাজার টাকা। এই এমআর মেশিন উপমহাদেশে আছে মাত্র দুটি। একটা বাংলাদেশে আর একটা ভারতে। অল্প খরচে সিটিস্ক্যান করা হচ্ছে। খরচ পড়বে দুই হাজার টাকা। প্রাইভেট হাসপাতালে খরচ পড়ে সাত হাজার টাকা। নার্ভ এবং মাংসের রোগ নির্ণয় জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে এনসিভিইএমজি মেশিন। যা খরচ পড়ছে ৭০০ টাকা। ব্রেইন স্ট্রোক, ব্রেইন টিউমার, মৃগীরোগ, মাথাব্যথা, মাংস শুকিয়ে যাওয়া, মাথায় আঘাত প্রভৃতি চিকিৎসা হচ্ছে এই হাসপাতালে। এভাবে দেশের জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের সব সরকারি হাসপাতালে নামমাত্র খরচে মিলছে বিভিন্ন জটিল রোগের উন্নত চিকিৎসা।

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান ভোরের আকাশকে জানান, সরকারি হাসপাতালে রয়েছে দক্ষ জনবল ও উন্নত চিকিৎসা উপকরণ। কিন্তু সাধারণ মানুষের অনেকেই জানে না সরকারি হাসপাতালে কীভাবে, কি ধরনের চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায়। এ নিয়ে অনেক সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং রোগী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়, ঘটে যায় অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। সাময়িক দুর্ভোগ সহ্য করে সামনে এগিয়ে গেলে নামমাত্র খরচে উন্নত চিকিৎসা পাওয়া যায় সরকারি হাসপাতালে। দেশের অধিকাংশ মানুষের শেষ ভরসার জায়গা হলো সরকারি হাসপাতাল।

ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদী-ই মাহবুব ভোরের আকাশকে বলেন, দেশের চিকিৎসা সেক্টরের অবকাঠামো অনেক মজবুত। বেসরকারি চিকিৎসাসেবার ফি আকাশচুম্বী হওয়ায় দেশের সাধারণ মানুষের শেষ ভরসা সরকারি হাসপাতালের নামমাত্র খরচের চিকিৎসাসেবা। জবাবদিহি নিশ্চিত বাড়ানো গেলে দেশের অসহায় ও দরিদ্র মানুষেরা আরো বেশি উপকৃত হবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ভোরের আকাশকে বলেন, সরকারি হাসপাতালে আন্তর্জাতিকমানের চিকিৎসাসেবার সুব্যবস্থা ও সক্ষমতা রয়েছে। নামমাত্র খরচে চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় সরকারি হাসপাতালে। তবে বেশকিছু পরীক্ষা করাতে স্বল্প ফি নেওয়া হয়। এক্ষেত্রেও সরকারি ফি বেসরকারি হাসপাতালের ফির তুলনায় অনেক গুণ কম।

তিনি বলেন, কোন কোন ক্ষেত্রে সরকারি চিকিৎসা সুবিধার বিষয়ে ধারণা না থাকায় প্রাপ্য চিকিৎসাসেবা আদায় করে নিতে পারেন না অনেক রোগী। এ সুযোগে অনভিজ্ঞ রোগীদের কাছ থেকে বিনা টাকার চিকিৎসার ক্ষেত্রেও অর্থ আদায় করেন হাসপাতালের কিছু সংখ্যক অসাধু চক্র। এতে বিনা টাকার সরকারি চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ, যা সরকারি ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে।