রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ট্রাভেল এজেন্সির নামে প্রতারণার ফাঁদ পেতেছে একটি চক্র। তারা নামে-বেনামে অস্থায়ী অফিস খুলে বসে। যেকোনো দেশের ভ্রমণ ও ওয়ার্কিং ভিসা প্রসেস এবং টিকিট কেটে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে প্রচারণা চালায়। ইনডিভিজুয়াল অথবা সাব-এজেন্টের কাছে মধ্যেপাচ্য, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকার দেশগুলোর যাত্রীদের কাছে টিকিট আগাম বিক্রি করে। নির্দিষ্ট ভাড়া দেওয়ার পরে তারা যাত্রীদের ই-টিকিটের একটি কপি দেয়।
যেখানে যাত্রীর নাম, জন্মতারিখ, পাসপোর্ট নম্বর, ট্রানজিটসহ সবকিছু উল্লেখ থাকে। যাত্রী তখন ই-টিকিট নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে। ভ্রমণের নির্ধারিত তারিখে যাত্রী পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ব্যাগ, লাগেজসহ বিমানবন্দরে হাজির হয়। কিন্তু বোডিং পাসে গিয়ে ধরা খায়। সংশ্লিষ্ট বিমানের কর্মকর্তারা টিকিট চেক করে জানিয়ে দেন, টিকিটের বুকিং ঠিক ছিল। কিন্তু বুকিং দেওয়ার পরে টিকিটের টাকা রিফান্ড করে নেওয়া হয়েছে। ওই টিকিটের আর কোনো বৈধতা নেই। এ কথা শোনার পর যাত্রীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কারণ ওই যাত্রীদের কেউ চিকিৎসার জন্য যাবে, কেউ তার ব্যবসা বা চাকরি সামলাতে যাবে। কেউবা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডমিশন বা ক্লাসে যোগ দেবে। উপায়ন্তর না পেয়ে ওই এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন এজেন্সি বিভিন্নভাবে ওই যাত্রীকে বুঝ দিয়ে ফের টিকিট কেটে দেওয়ার আশ্বাস দেয়। এজন্য আবার ৫০ থেকে ১৫০ ডলার পর্যন্ত ফি নেওয়া হয়। টাকা নেওয়ার পরও দ্বিতীয়বার যে টিকিট দেওয়া হয় যাত্রীরা বিমানবন্দরে যাওয়ার পর সেটিও ভুয়া টিকিট বলে প্রমাণিত হয়। যাত্রীরা তখন আরো হতাশার মধ্যে পড়ে যান। তখন যাত্রীদের চাপে পড়ে একটা পর্যায়ে এজেন্সির লোকরা মোবাইল ও অফিস বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে যায়। এরকম বেশ কয়েকটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশ। ইতোমধ্যে এ চক্রের কয়েক সদস্যকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া আরো বেশ কয়েকটি ভুয়া এজেন্সিকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে ডিবি সূত্রে জানা গেছে।
ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্টরা জানান, বিদেশগামী যাত্রীদের বিমানের আগাম টিকিট কেটে দুদিন পর রিফান্ড করে উধাও হয়ে যাওয়া বেশকিছু প্রতারক ট্রাভেল এজেন্সির সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশ। এসব এজেন্সি বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণা চালায়, সব দেশের যেকোনো এয়ারলাইন্সের নিশ্চিত টিকিট পাইয়ে দেওয়ার। যাত্রীরা তাদের নির্ধারিত তারিখে গন্তব্য নিশ্চিত করার জন্য দ্বারস্থ হয় এসব এজেন্সির। কখনো যাত্রীরা সরাসরি আবার কখনো সাব-এজেন্টের মাধ্যমে টিকিট ক্রয় করে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যাত্রার তারিখে।
যাত্রীরা বিমানবন্দরে গিয়ে জানতে পারেন, তাদের টিকিটটি ভুয়া। টিকিটের টাকা আগেই রিফান্ড করে নেওয়া হয়েছে। অভিযোগের ভিত্তিতে এসব এজেন্সিগুলো ওই যাত্রীদের আবার নতুন করে টিকিট দেয়। কিন্তু সেই টিকিটে যাত্রীরা গন্তব্য যেতে পারে না। বেশকিছু যাত্রী ও এজেন্টের অভিযোগের ভিত্তিতে ডিবি তদন্ত শুরু করেছে। ইতোমধ্যে টিকিট প্রতারণার সঙ্গে জড়িত বেশকিছু এজেন্সিকে শনাক্ত করেছে। কিছু কিছু ভুক্তভোগী থানায় মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শিগগিরই এসব প্রতারক এজেন্সির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে একটি এজেন্সির প্রতারণার শিকার হয়েছেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের গ্রাউন্ড সার্ভিস সুপারভাইজর মো. সাইদুর রহমান। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এক অভিযোগে বলেছেন, এম আদ্যক্ষরের একটি প্রতিষ্ঠানের সিইও পরিচয়দানকারী কর্মকর্তার সঙ্গে তার কয়েক মাস আগে পরিচয় হয়।
ওই ব্যক্তি দাবি করেন, তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের টিকিট ক্রয় করে যাত্রী পাঠান। গত ২৬ মার্চ সাইদুর রহমান ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেন, ৫ জন যাত্রীর জন্য মাস্কট, রিয়াদ, টরন্টোর টিকিট কেটে দিতে হবে। আশ্বাস পেয়ে তিনি ওই দিনই সাইদুরের ঢাকার ভাটারাস্থ অফিসে গিয়ে মাস্কটের যাত্রী মুসাহিদের টিকিটের বাবদ তার কাছে ৭৬ হাজার টাকা দেন। পরে ওই ব্যক্তি মুসাহিদের নামে বুকিং করা একটি টিকিটের কপি পাঠায়। পরের দিন ২৭ মার্চ বিকালে রিয়াদগামী যাত্রী মো. মহসিনের টিকিটের জন্য ৬৭ হাজার এবং টরন্টোর জন্য মো. যুবায়ের হোসেন ও তার পরিবারের দুই সদস্যর জন্য ৩ লাখ ৭০ হাজারসহ মোট ৫ লাখ ১০ টাকা দেন সাইদুর। এর বিপরীতে ওই ব্যক্তি মাস্কট ও রিয়াদের যাত্রীদের দুটি টিকিট সরবরাহ করেন। কিন্তু ২৮ মার্চ রিয়াদের যাত্রী মহসিন বিমানবন্দরে এসে জানতে পারেন, তার টিকিটটি ভুয়া। টিকিটের টাকা রিফান্ড করে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি মহসিন সাইদুরকে জানালে তিনি ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে তিনি আরেকটি টিকিট ইস্যু করে দিলেও সেই টিকিট দিয়ে মহসিন রিয়াদ যেতে পারেননি। তখন সাইদুর এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ দিয়ে টিকিট যাচাই করে প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পারেন।
এছাড়া টরন্টোর তিনটি টিকিটও ওই ব্যক্তি তাকে সরবরাহ করেননি। উল্টো অফিস ও মোবাইল ফোন বন্ধ করে উধাও হয়ে যান। তখন কোনোভাবে ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না। ৩১ মার্চ সাইদুর এজেন্সির ভাটারার অফিসে গিয়ে জানতে পারেন, আরো অনেকের সঙ্গে ওই ব্যক্তি প্রতারণা করেছেন।
অভিযোগে সাইদুর আরো উল্লেখ করেন, ওইদিনই আরেক যাত্রীর টিকিটের টাকা নেওয়ার জন্য ওই ব্যক্তি তেজগাঁও লিংক রোড শান্তা টাওয়ারের সামনে অবস্থান করছে বলে জানতে পারেন। যার কাছ থেকে টাকা নিবেন, তাকে অনুসরণ করে তিনি ওই ব্যক্তির কাছে পৌঁছান। সাইদুরকে দেখে ওই ব্যক্তি হতভম্ব হয়ে যান। তখন পুলিশের সহায়তায় ওই ব্যক্তি সাইদুরকে নগদ ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা এবং একটি অঙ্গীকারনামা প্রদান করেন, বাকি টাকার জামানতস্বরূপ ৫ লাখ ১০ হাজার টাকার একটি চেক প্রদান করবেন। ৩ এপ্রিল বাকি টাকা প্রদান করে তার অঙ্গীকারনামা ও চেক ফেরত নেবে। তখন তিনি তার সহযোগী সজিব আহমেদকে দিয়ে টাকার ব্যবস্থা করে ২ লাখ ৮৫ হাজার টাকা দেন। পরের দিন ওই চেকটি ব্যাংকে জমা দিলে ডিজওনার হয়। ওই ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি সাইদুরকে নানা রকম ভয়ভীতি দেখিয়ে তার চাকরি খেয়ে ফেলার হুমকি দেন।
ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের গুলশান বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, টিকিট প্রতারণা চক্রের বেশ কয়েক সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া প্রতারণার সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি নজরদারিতে রয়েছে। তিনি বিদেশগামী যাত্রীদের টিকিট ক্রয়ের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করার অনুরোধ জানিয়েছেন।