logo
আপডেট : ১২ মে, ২০২২ ১০:৪০
অপরাধীদের নিত্যনতুন কৌশল
রুদ্র মিজান

অপরাধীদের নিত্যনতুন কৌশল

প্রতীকী ছবি

ঢাকা থেকে যানজট ঠেলে যেতে সময় লেগেছে দেড় ঘণ্টার বেশি। প্রায় ২৯ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে অপরাধী চক্রের কাছাকাছি পৌঁছে গোয়েন্দা পুলিশ। গাজীপুর থেকে টাঙ্গাইলগামী একজন অপরাধীকে ধরতে অনুসরণ করছিল গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল। দলটির তদারকির দায়িত্বে থাকা ডিবি পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার ঢাকায় বসে নির্দেশনা দেন। জানিয়ে দিচ্ছেন অপরাধীর অবস্থান। তারপরও পেরে উঠছেন না অভিযানকারীরা। কারণ একটাই অপরাধী অত্যন্ত সচেতন। প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তৎপরতা থেকে নিজেদের আড়ালে রাখতে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েই ফিরে যেতে হয় গোয়েন্দা পুলিশদের। এ রকম ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। প্রযুক্তি, প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট দক্ষ জনবল সংকট ও অপরাধীদের নিত্যনতুন কৌশলের কাছে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের।
বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে

# ফিল্মি কায়দায় ঘটছে হত্যাকান্ড

# মুভি, সিরিজ থেকে কৌশল আয়ত্ত


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার জানান, অপরাধী চক্রটি শাহবাগ থেকে একটি গাড়ি চুরি করেছিল। পরবর্তী সময়ে গাড়ির মালিককে ফোন দিয়ে টাকা দাবি করে। ওই নম্বরের সূত্রধরে ডিবির একটি টিম পাঠানো হয়। ফোন নম্বর ব্যবহারকারী দ্রুত একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাচ্ছিল। কোথাও স্থির হচ্ছিল না। রাতে ফোনটি বন্ধ থাকে। এসব কারণে কোনোভাবেই তার অবস্থান নির্ণয় করা যাচ্ছিল না। সিমটির ছিল ভুয়া নিবন্ধন। এভাবেই প্রযুক্তি সম্পর্কে দক্ষ অপরাধীদের ধরতে বেগ পেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতীয় বিভিন্ন ওয়েব সিরিজ দেখে দেখে নিত্যনতুন কৌশল শিখছে অপরাধীরা। দেশের অনেক চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ক্লু উদ্ঘাটন করতে গিয়ে তদন্তকারীরা বিস্মিত হয়েছেন। প্রায় হত্যাকাণ্ড-ই ঘটেছে অভিনব কায়দায়। একই কায়দায় ঘটছে ডাকাতি ও ছিনতাই।

গত ২৪ মার্চ শাহজাহানপুর এলাকায় হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে, যানজটের মধ্যে হত্যা করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে। একজন অস্ত্রধারী টিপুর গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে ১২টি গুলি করে। সামনে সিটে থাকা টিপুকে এভাবেই হত্যা করা হয়। এমনকি ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময়ও ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে পালিয়ে যায় কিলার। এ সময় পথচারী প্রীতি নামে এক কলেজছাত্রী নিহত হন। পরে ২৬ মার্চ রাতে বগুড়া থেকে মাসুম আহমেদ আকাশ নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। রিমান্ডে এই আকাশ জানিয়েছে, হিন্দি মুভি দেখে দেখে কৌশল রপ্ত করেছে। সেইসঙ্গে ইউটিউব দেখে অস্ত্র ব্যবহারের শিক্ষা নেয়। এভাবেই অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছে এই যুবক।
একইভাবে হিন্দি সিনেমা ‘ধুম-৩’ দেখে ব্যাংক ডাকাতির চেষ্টা করে বগুড়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এক কিশোর। শতাধিকবার ওই ফিল্ম দেখে ব্যাংক ডাকাতির চেষ্টা করেছিল সে। ব্যবহার করেছিল ‘রুফটপ গ্লাভস’। তালা কাঁটতে ব্যবহার করে বিশেষ কাটার। মুখোশ পরা এই কিশোরের ছোড়া দাহ্য পদার্থ ও ছুরিকাঘাতে দুই আনসার সদস্য আহত হন। ওই সিনেমা দেখেই ডাকাতির এই কৌশল রপ্ত করেছিল ১৬ বছরের ওই কিশোর। বিশেজ্ঞদের মতে, সিনেমা-সিরিজ ও ক্রাইম পেট্রোলের মতো অনুষ্ঠান দেখে এবং ফ্যান্টাসি থেকে কিশোররা অপরাধে জড়াচ্ছে। গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং।

উত্তরার দক্ষিণখানে একের পর এক হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটছিল। হামলা ও হত্যার শিকার হচ্ছিলেন মধ্য বয়সি নারীরা। তারা প্রত্যেকেই বাড়ির মালিক। বাসাভাড়া নেওয়ার অজুহাতে এক যুবক ওই এলাকায় গিয়ে একের পর এক হামলা করছিল। প্রায় পাঁচ বছর আগের এই ঘটনা। বেশ কয়েকটি হত্যাকা- ঘটলেও ওই সিরিয়াল কিলারকে আজ পর্যন্ত খুঁজে পায়নি পুলিশ। সিসি ক্যামেরার অস্পষ্ট ফুটেজের ছবি দিয়ে এলাকায় পোস্টারিং করেছিল পুলিশ। সচেতনতার জন্য ও কিলারকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মাইকিং করা হয়। তবু আজ পর্যন্ত সিরিয়াল কিলারকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, অত্যন্ত সচেতনভাবে হত্যাকা-গুলো ঘটিয়েছে কিলার। বাসাভাড়া নিতে গেলেও কোথাও ফোনে যোগাযোগ করে যায়নি। এমনভাবে ঘটনা ঘটিয়েছে সিসি ক্যামেরায় তাকে স্পষ্ট চেনার মতো কোনো ফুটেজ পাওয়া যায়নি। কিলার তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন হওয়ায় তাকে ধরা সম্ভব হয়নি।

পুলিশে প্রযুক্তিতে দক্ষ সদস্যের যেমন অভাব তেমনি অভাব রয়েছে প্রযুক্তি সহায়তারও। মোবাইল ফোন উদ্ধার করতেও বেগ পেতে হয় থানা পুলিশকে। হাতিরঝিল থানার ওসি আবদুর রশিদ জানান, ফোন হারানোর জিডি হওয়ার পর একজনকে অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি সেটি ডিবিতে পাঠিয়ে দেন। আইএমই নম্বর অনুসারে প্রযুক্তির মাধ্যমে টেলিকম কোম্পানির সহযোগিতায় ফোন উদ্ধারের চেষ্টা করা হয়। প্রযুক্তির সহায়তায় সরাসরি থানা পুলিশের কাছে নেই বলে জানান তিনি।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রযুক্তিতে দক্ষ জনবল আগের চেয়ে বেশি হলেও পর্যাপ্ত না। তবে প্রায়ই এ বিষয়ে কর্মশালার আয়োজন করা হয়। তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষ করতে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সাইবার অপরাধ দমনে স্বতন্ত্র সাইবার ইউনিট প্রতিষ্ঠা, পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ডিএনএ পরীক্ষা, রাসায়নিক পরীক্ষা, ব্যক্তির বায়োমেট্রিক তথ্যপ্রযুুক্তি এখন অপরাধীর গতিপথ শনাক্ত করতে সহায়তা করছে।

প্রযুক্তিতে দক্ষ জনবল সম্পর্কে কোনো পরিসংখ্যান জানাতে পারেনি পুলিশ সদর দপ্তর। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, প্রযুক্তিগত আইনি সহায়তার জন্যই সাইবার পুলিশ, সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম বিভাগ, ডিবি পুলিশের সিরিয়াস ক্রাইম ও সাইবার ক্রাইম ইউনিট, সাইবার ইনভেস্টিগেশন ও সাইবার সাপোর্ট সেন্টার গঠন করা হয়েছে। বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য এতে কর্মরত। তবে জেলা পর্যায়ে পাঁচ-ছয়জনের বেশি প্রযুক্তিতে দক্ষ জনবল নেই বলে জানা গেছে।

ডিএমপির উপ কমিশনার (মিডিয়া) ফারুক আহমেদ বলেন, প্রযুক্তিতে পুলিশ আগের চেয়ে এগিয়ে। অপরাধীদের নিত্যনতুন কৌশল যেমন রয়েছে তেমনি পুলিশও তদন্তে অত্যাধুনিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও পুলিশ আন্তরিকভাবে সেবা দিচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, তথ্য, প্রযুক্তি সম্পর্কে পুলিশের অনেক সদস্যই অদক্ষ। সম্প্রতি দক্ষ পুলিশের সংখ্যা বেড়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। দক্ষ পুলিশ সদস্য যেমন প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন প্রযুক্তি সহায়তাও। এজন্য সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেইসঙ্গে সমাজে অপরাধ প্রবণতা সৃষ্টি করে এমন টিভি সিরিয়াল, মুভি দেখা থেকে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের দূরে রাখতে হবে। অপরাধ কমাতে পরিবার থেকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।