আড়াই বছরেরও বেশি দিন কারাভোগের পর বুধবার (১১ মে) বিকেলে কারা মুক্ত হলেন ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট। আর এই মুক্তির মধ্য দিয়ে ফের আলোচনায় সম্রাট।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সম্রাটের মতো এক নেতাকে দলের প্রয়োজন। শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা টিপু হত্যাকাণ্ডের পর অনেকটা শক্তিহীন হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। ফলে এ সময় দলে সম্রাটের বিকল্প কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। তবে মুক্তির পর তিনি কি রাজধানীর অপরাধ জগতের মুকুট আবার ফিরে পাচ্ছেন এটা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। আর সম্রাটের গ্রেপ্তারের পর যারা খুশি হয়েছিলেন, জামিনে মুক্তির পর তাদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে বলেও জানা গেছে।
* দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
* পাহারায় থাকা কারারক্ষী সরিয়ে নেওয়া হলেও হাসপাতালের ছাড়পত্র মেলেনি
* রাজধানীর অপরাধজগতের মুকুট কী ফিরে পাচ্ছেন?
রাজধানীতে ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে ঢাকা থেকে গা-ঢাকা দেন সম্রাট। তবে ওই বছরের ৬ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে সহযোগী এনামুল হক আরমানসহ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হতে থাকে।
অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে ১৯৫ কোটি টাকা পাচার, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও অস্ত্র আইনে মামলা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসব মামলা করে। এছাড়াও বন্য প্রাণীর চামড়া রাখায় দায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত সম্রাটকে ছয় মাসের কারাদ- দেন। তবে সবগুলো মামলাতেই (চারটি) সম্রাট জামিন পান। সর্বশেষ অবৈধভাবে ২ কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার ৮৭ টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলায় গতকাল বুধবার মামলায় জামিন পান সম্রাট।
ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬-এর বিচারক আল আসাদ মো. আসিফুজ্জামান জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। আদালতের অনুমতি ছাড়া দেশের বাইরে যাওয়া যাবে না এবং তার পাসপোর্ট আদালতে জমা রাখতে হবে-এই শর্তে আগামী ৯ জুন পর্যন্ত তাকে জামিন দেওয়া হয়। এর পরপরই আদেশের কপি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছানো হয়। এর পর তা পাঠানো হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে। ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে সেখানে কারারক্ষী পাহারায় চিকিৎসাধীন ছিলেন সম্রাট। কারা কর্তৃপক্ষের সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার পর গতকাল বিকেলেই তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
তার পাহারায় থাকা কারারক্ষী সরিয়ে নেওয়ার মধ্য দিয়ে এই মুক্তি মেলে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের (কেরানীগঞ্জ) জেলার মাহবুবুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তবে কারামুক্তি মিললেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে ছাড়পত্র না দেওয়ায় হাসপাতাল ছাড়েননি সম্রাট।
এদিকে বিএসএমএমইউ’র পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. নজরুল ইসলাম খান জানিয়েছেন, সম্রাটের জামিন হলেও তার শারীরিক অবস্থার কারণে চিকিৎসকরা বুধবার তাকে ছাড়পত্র দিচ্ছেন না। জামিনের পর ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট সাধারণ রোগী হিসেবে বিএসএমএমইউ ডি-ব্লকের সিসিইউতে চিকিৎসা নেবেন।
যদি চিকিৎসকরা মনে করেন তার ছাড়পত্র দেওয়া যেতে পারে, সেটা তাদের ব্যাপার। তবে জামিনের পর হাসপাতালে সাধারণ রোগী হিসেবেই চিকিৎসা নেবেন সম্রাট। এ সময় তাকে বন্দি রোগী হিসেবে বিবেচনা করা হবে না।
দুদক আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, শারীরিক অসুস্থতার কথা বিবেচনায় নিয়ে মানবিক কারণে আগামী ৯ জুন পর্যন্ত সম্রাটের জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত।
আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সম্রাটের বিরুদ্ধে মোট চারটি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে গত ১১ এপ্রিল রমনা থানায় দায়ের করা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় জামিন পান সম্রাট। ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত সেদিন তার জামিন মঞ্জুর করেন। গত ১০ এপ্রিল অর্থ পাচার ও অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় ঢাকার পৃথক দুটি আদালত থেকে জামিন পান সম্রাট। সর্বশেষ বুধবার জামিন পান অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের মামলায়।
সম্রাট সম্পর্কে তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, গ্রেপ্তারের আগে রাজধানীর কাকরাইলে ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টার দখল করে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছিলেন সম্রাট। ‘গডফাদারদের’ পক্ষে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি-তদবির করলেও পরে রাজনৈতিক পর্যায়ে ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা থেকে মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন তিনি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচন করার ইচ্ছা ছিল তার।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রেপ্তার হওয়ার আগে প্রতি রাতে রাজধানীর ১৫টি ক্যাসিনো থেকে ৪০ লাখ টাকা চাঁদা তুলতেন ইসমাইল হোসেন সম্রাট। অভিযোগ আছে, বহিষ্কৃত যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও ঠিকাদার জিকে শামীমের সব অবৈধ আয়ের ভাগ দিতে হতো সম্রাটকে। এছাড়া মতিঝিল, ফকিরাপুল, পল্টন, কাকরাইল, বাড্ডা এলাকায় অপরাধ জগতে একক আধিপত্য বিস্তার করে চাঁদাবাজি করতেন তিনি। অন্যদিকে ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদের সঙ্গে মিলে ঢাকার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলেও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিআইডি ও দুদক কর্মকর্তারা বলেন, যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বিপুল অর্থ পাচার করার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সম্রাট ক্যাসিনো পরিচালনা, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করে এসব অর্থ জমিয়েছিলেন। ওই সূত্র আরো জানায়, হুন্ডির মাধ্যমে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় পাচার করা টাকার বড় অংশই সম্রাট সিঙ্গাপুরে জুয়ার আসর ‘মেরিনা বে-স্যান্ডস’ ক্যাসিনোতে খরচ করেছেন। ক্যাসিনো পরিচালনা, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করে অবৈধ এসব অর্থ জমিয়েছিলেন তিনি। ২০১১ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত সম্রাট শুধু সিঙ্গাপুরেই গেছেন ৩৫ বার।