logo
আপডেট : ১২ মে, ২০২২ ১৫:৩৬
দাম নেই ধানের, হতাশ কৃষক
আমীর হামজা, হবিগঞ্জ

দাম নেই ধানের, হতাশ কৃষক

বছরে মাত্র একবার ধান চাষ করতে পারেন হাওরাঞ্চলের কৃষকরা। প্রতি বছর ধারদেনা করে এক বুক আশা নিয়ে ধান চাষ করেন তারা। তবে প্রায় প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ সেই আশায় আঘাত হানে; যা থেকে বাদ পড়েনি চলতি মৌসুমও।

প্রথমে পানির ঢল, এরপর শ্রমিক সংকট, অবশেষে বৃষ্টির বাগড়া সবকিছুই মাথায় নিয়ে ঘরে ধান তুলেছেন হবিগঞ্জের কৃষকরা। তবে ধানের দাম না পাওয়ায় হতাশ তারা। মাত্র ৬৫০-৭৫০ টাকা মণে ধান বিক্রি করছেন তারা। তাদের দাবি, এই দামে ধান বিক্রি করে তাদের খরচই উঠছে না।

কৃষকরা জানান, ধান লাগানো থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত প্রতি কেরে (২৮ শতাংশ) কৃষকের খরচ হয়েছে ১১-১২ হাজার টাকা। প্রতি কেরে ধান উৎপাদন হয়েছে ১৫-১৭ মণ। এখন প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৬৫০-৭৫০ টাকায়। সেই হিসাবে প্রতি কেরে কৃষককে লোকসান গুনতে হচ্ছে এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। সেই সঙ্গে পরিবারের সবার শ্রম তো আছেই। ধানের দামের এমন অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন হবিগঞ্জের চাষিরা।

জেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর হবিগঞ্জের এক লাখ ২০ হাজার ৫৭০ হেক্টর জমিতে বোরা ধানের চাষ হয়েছে। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ৬২ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। বাকি ধান চলতি মাসের মধ্যে ঘরে তুলতে পারবেন কৃষকেরা।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এবার হবিগঞ্জে প্রতিমণ ১ হাজার ৮০ টাকা করে ১৬ হাজার ২০৬ মেট্রিক টন ধান কিনবে সরকার। ধান ক্রয় উদ্বোধন করা হলেও এখনো পুরোদমে ধান সংগ্রহ শুরু হয়নি। আগামী কিছু দিনের ভেতরে পুরোদমে ধান কেনা শুরু হবে বলে জানিয়েছেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তা। তবে বাড়তি ঝামেলার কারণে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে আগ্রহ নেই সাধারণ কৃষকদের।

তারা বলছেন, সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পুরোপুরি শুকিয়ে গুদামে নিয়ে আসতে হয়। পরে তার যাচাই-বাছাই শেষে ধান ভালো হলে তা কেনে। যদি ধানে কিছুটাও চিটা থাকে, সে ধান আর কেনে না খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এতে উল্টো কৃষকের যাতায়াত ও শ্রমিক খরচ বেড়ে যায়।

লাখাই উপজেলার বুল্লা গ্রামের কৃষক মো. শরিফ উদ্দিন। চলতি মৌসুমে প্রায় ২০ কের জমিতে ধানের চাষ করেছেন তিনি। কিন্তু ধানের দাম নিয়ে চিন্তায় তিনি।

শরিফ উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমানে একজন দিনমজুরের বেতন দিতে হয় প্রতিদিন ৫০০-৬০০ টাকা। আর ধান বিক্রি হচ্ছে ৬৫০-৭৫০ টাকায়। ধানের দাম আর আমাদের খরচের টাকা মিলে কোনোভাবেই পুষিয়ে উঠতে পারছি না। যদি ১০০০-১২০০ টাকা মণে ধান বিক্রি করতে পারি তা হলে কিছুটা লাভ হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করলেও লাভবান হতে পারব না। কারণ সরকার ধান কিনবে এক হাজার ৮০ টাকায়। তাও আবার ধান গুদামে নিজ খরচে দিয়ে আসতে হবে। আর সরকার এই ধান বিভিন্ন পরীক্ষা করে ভালো হলে তারপর রাখে। ধানে অল্প চিটা থাকলে তা তারা রাখেন না। তা হলে সেই ধান আবার বাড়িতে ফেরত নিয়ে আসতে হয়। যার ফলে গুদামে নিতে যে খরচ, সেটাও নিজের ঘাড়েই পড়ে।

‘জমি থেকে মাড়াই দেওয়ার পর যে ধান বের হয় সেটাই পাইকাররা কিনে নেয়। সেখানে চিটা থাকলেও তারা নিয়ে যায়। আমরা গ্রামের মধ্যে যেভাবে ধান শুকাই সেখানে কিছুটা চিটা থাকবেই। যে কারণে আমরা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে চাই না।’

পূর্ব বুল্লা গ্রামের কৃষক জাহির উদ্দিন বলেন, ‘প্রায় ২০ কের জমিতে ধান চাষ করেছি। আগের অনুপাতে আমার ভালো ফসল হয়নি। অন্য বছর থেকে এবার প্রতি কেরে ৫-৭ মণ ধান কম হয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘ব্রি-২৮ জাতের ধান অনেক নষ্ট হয়েছে, যা অকল্পনীয়। এ ছাড়া এবার ধানের দামও কম। প্রতি মণে আমার ৮০০ টাকার বেশি খরচ হয়েছে। প্রতি কেরে আমার প্রায় পাঁচ হাজার টাকা করে লোকসান হবে।’

ধন মিয়া নামের আরেক কৃষক বলেন, ‘আমি ১০ কের জমিতে ধান করেছি। এবার ধানের ফলন ভালো হয়নি। অনেক ধান নষ্ট হয়ে গেছে। যে জমিতে ধান হওয়ার কথা কেরপ্রতি ১৭ মণ, সেখানে হয়েছে ১০ মণ। এর মধ্যে ধানের দামও কম। আমি কিস্তি তুলে জমিতে ধান করেছিলাম। এখন ঋণ কোথা থেকে পরিশোধ করব আর নিজেই কি খাব কিছু বুঝতে পারছি না।’

কিরান দাস নামের আরেক কৃষক বলেন, ‘এবার ২-৩ জাতের ধানে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। তিন-চারবার ওষুধ দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। আর ধানের দাম কম হওয়ায় আমার প্রতি কেরে ৫-৭ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হবে।’

এ বিষয়ে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক অধিদপ্তরের কর্মকর্তা চাই থোয়াই প্রু মার্মা বলেন, ‘ইতোমধ্যে ধান সংগ্রহের উদ্বোধন করা হয়েছে। ঈদের ছুটির কারণে ধান সংগ্রহ করতে বিছুটা বিলম্ব হয়েছে। এখন থেকে আবার পুরোদমে ধান সংগ্রহ শুরু হবে।’