আপডেট : ১৩ মে, ২০২২ ০৯:২২
বহুমুখী চাপে ব্যাহত হয় নার্সদের সেবা প্রদান
#সংকট কাটছে না
#একজনকে সক্ষমতার বেশি রোগী দেখতে হয়
#সহ্য করতে হয় স্বজনদের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও রূঢ় আচরণ
#রিপোর্ট, রেজিস্টার খাতা আর ফাইল নিয়ে দৌড়াতে হয়
নিখিল মানখিন
ফাইল ফটো
বহুমুখী চাপে ব্যাহত হয় নার্সদের সেবা প্রদান। সারাদেশে রয়েছে নার্স সংকট। একজন নার্সকে দেখাশোনা করতে হয় দশ থেকে বিশজন রোগী। চলে রোগীর স্বজনদের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও রূঢ় আচরণ। রিপোর্ট, রেজিস্টার খাতা আর ফাইল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে নার্সদের পক্ষে শতভাগ সেবা প্রদান করা সম্ভব হয়ে উঠে না। দায়িত্বরত নার্স, নার্স নেতৃবৃন্দ ও চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
অতিরিক্ত রোগীর চাপে যথাযথভাবে স্বাভাবিক দায়িত্ব পালন করতে পারেন না নার্সরা। বর্তমান সরকারের আমলে একাধিকবার নার্স নিয়োগ দেয়া হলেও সহনীয় পর্যায়ে নেই নার্স সংকটের তীব্রতা। দেশের প্রায় সব হাসপাতালেই প্রয়োজনের তুলনায় নার্সের সংখ্যা অপ্রতুল। আন্তর্জাতিকভাবে একজন চিকিৎসকের সঙ্গে তিনজন নার্স থাকাই স্বীকৃত। কিন্তু সে হিসেবে বাংলাদেশে প্রত্যেক চিকিৎসকের বিপরীতে নার্স রয়েছেন ১ দশমিক ৬৬ জন। এছাড়াও প্রতিটি হাসপাতালের মোট শয্যার ১০ শতাংশ স্পেশালাইজড বেড থাকার কথা। আর সেক্ষেত্রে প্রতি চার বেড অনুপাতে একজন নার্স ও প্রতিটি স্পেশালাইজড বেডের বিপরীতে একজন করে নার্স থাকবে। সেখানে পৃথক তিন সিফটে সমপরিমাণ সেবা দেবেন নার্সরা। কিন্তু এক্ষেত্রে দেশের হাসপাতালগুলোতে নার্সের বড় ঘাটতি রয়েছে।
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার আব্দুল লতিফ ভোরের আকাশকে বলেন, ২০১০ থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৩৪ হাজার নার্স ও মিডওয়াইফ নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগে দেশে নার্স ছিল মাত্র ৯ থেকে ১০ হাজার। এখন সেটি কয়েক গুণ বেড়েছে। তবুও অনেক হাসপাতালে নার্স সংকট। এটা ঠিক যে জনবল বাড়লে সেবার গুণগত মানও বাড়ছে। নতুন যে নার্সরা নিয়োগ পাচ্ছেন পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে তাদের আরও যোগ্য ও দক্ষ করে তুলতে হবে। দায়িত্ব পালনে নার্সদের নানামুখী চাপ সামলাতে হয় বলে জানান আব্দুল লতিফ।
রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালের নার্স গীতা চিসিম ভোরের আকাশকে বলেন, রোগীসেবা প্রদানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার কমতি থাকে না। একবার ভর্তি হলে রোগীর বিদায় নিতে বেশ সময় লাগে। শয্যা থাকে না খালি। কিন্তু উন্নত চিকিৎসাসেবা পাওয়ার কারণে এই হাসপাতালে প্রতিনিয়ত রোগীর চাপ লেগেই থাকে। অতিরিক্ত রোগী ও তাদের স্বজনদের ভিড়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম চালানো খুবই কঠিন বলে জানান গীতা চিসিম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন নার্স ভোরের আকাশকে জানান, রোগী ও তাদের স্বজনদের অপ্রয়োজনীয় অভিযোগ ও আবদারের শেষ নেই। একদিন একজন রোগী আমাকে এসে বলল যে, ক্যাপসুল তার শরীরে কোনো কাজ করছে না। আমার উচিত তাকে ইনজেকশন দেওয়া। কেননা ইনজেকশন অনেক শক্তিশালী। আরেক দিন আরেক রোগী আমাকে বলল, কেন তাকে আমি ছোট ট্যাবলেট দিয়েছি। পাশের বেডের রোগীকে তো বড় ট্যাবলেট দেওয়া হয়েছে। এ রকম কথা শুনলে কীভাবে মেজাজ ঠিক রাখতে পারবেন? তিনি আরও জানান, একজন নার্সকে দেখাশোনা করতে হয় দশ থেকে বিশজন রোগী। একেক রোগীর নানা অভিযোগ। একজন নার্সের পক্ষে এত সংখ্যক রোগীকে সামাল দেয়া খুবই কষ্টকর বলে জানান ওই নার্স।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নার্স রেবেকা রোজারিও ভোরের আকাশকে বলেন, রোগীর স্বজনেরা সব ধরনের অনুরোধ নিয়ে আমাদের কাছে আসে। কেউ বলে, স্যালাইনের ড্রিপটা মনে হয় ধীরে পড়ছে, একটু দেখুন না অথবা সিস্টার আমার রোগীর পেটে ভীষণ ব্যথা করছে, এদিকে একটু আসুন না। বেশির ভাগ সময় তারা না বুঝেই এ ধরনের আবদার করে থাকেন। আমি চেষ্টা করি তাদের এড়িয়ে চলতে, কিন্তু যখন বুঝতে পারি তারা তাদের ধৈর্য হারাচ্ছে, তখন আমি সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য রোগীর পাশে যাই। রোগীর কাছে যাওয়ার দরকার হলে আমরা ঠিকই পৌঁছে যাই বলে জানান রেবেকা রোজারিও।
রোগী দেখাশোনা করা ছাড়াও একজন নার্সকে অফিসের নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। স্বাধীনতা নার্সেস পরিষদের সদস্য সচিব মো. আনিসুর রহমান ভোরের আকাশকে জানান, বহুমুখী চাপে শতভাগ সেবা দিতে পারেন না নার্সরা। সারাদেশে রয়েছে নার্সের সংকট। একজন নার্সকে সক্ষমতার বেশি রোগী দেখতে হয়। চলে রোগীর স্বজনদের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও রূঢ় আচরণ। রিপোর্ট, রেজিস্টার খাতা আর ফাইল নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়।
যেসব রেজিস্টার খাতা নিয়ে তারা ব্যস্ত থাকেন সেগুলো হচ্ছে- অ্যাসাইনমেন্ট রেজিস্টার যেখানে ডিউটি নার্সদের প্রতিদিনের অ্যাসাইনমেন্ট খাতায় লেখা থাকে (নার্সিং সুপারভাইজার এই অ্যাসাইনমেন্ট লিখে থাকেন)। রেকর্ড রেজিস্টার যেখানে ওয়ার্ডে ভর্তি ও ওয়ার্ড থেকে ছাড়া পাওয়া রোগীদের নাম-ঠিকানা ও রোগের বিবরণ থাকে। হ্যান্ডওভার রেজিস্টার যেখানে ওয়ার্ডের জিনিসপত্র যেমন: শিট, ম্যাট্রেস এবং অন্যান্য সরঞ্জামের নাম লেখা থাকে। রাউন্ড রেজিস্টার যেখানে ওয়ার্ড রাউন্ড দেওয়ার সময় চিকিৎসকেরা উপদেশ ও নির্দেশ দিয়ে থাকেন। প্যাথলজি রিকুইজিশন রেজিস্টার যেখানে রোগীর কী কী প্যাথলজি পরীক্ষা করা হবে তার তালিকা থাকে। এক্স-রে রিকুইজিশন রেজিস্টার যেখানে যাদের এক্স রে করা প্রয়োজন সেই রোগীদের তালিকা থাকে এখানে। স্পেশাল অ্যাটেনশন রেজিস্টার যেখানে কোনো রোগীকে যদি বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার প্রয়োজন হয়, তাহলে নার্সরা তা এই খাতায় লিখবেন পরবর্তী শিফটের নার্সদের জন্য। রেজিস্টার ফর পুলিশ কেস যেখানে পুলিশ কেস আছে এমন রোগীদের তালিকা থাকে। ডায়েট রেজিস্টার যেখানে বিভিন্ন রোগীর খাবারের তালিকা লেখা থাকে। ড্রাগ রেজিস্টার যেখানে হাসপাতালে পাওয়া যায় এমন ওষুধের তালিকা থাকে। রেজিস্টার ফর অ্যাবসকন্ডিং পেশেন্টস: যেখানে ওয়ার্ড থেকে পালিয়ে গেছেন, এমন রোগীদের তালিকা থাকে। রেফারেল রেজিস্টার যেখানে অন্য হাসপাতালে বা বিভাগে পাঠানোর জন্য রেফার করা হয়েছে, এমন রোগীদের তালিকা থাকে এই খাতায়। আর ডেথ রেজিস্টার যেখানে ওয়ার্ডে মৃত্যু হয়েছে এমন রোগীদের তালিকা থাকে। এভাবে একের পর এক কাজে নার্সদের চরম ব্যস্ত থাকতে হয় বলে জানান মো. আনিসুর রহমান।
রোগী ওয়ার্ডে স্বজনদের অবাধ প্রবেশ ও অবস্থান এবং তাদের সঙ্গে নার্স চিকিৎসকদের কথা-কাটাকাটি ও অপ্রীতিকর ঘটনা প্রায় সময় আলোচনা সমালোচনার ঝড় তুলে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র নার্স স্বপ্ন রিছিল ভোরের আকাশকে বলেন, নার্সদের স্বাভাবিক কাজে বিঘ্ন ঘটান রোগীর স্বজনেরা। একজন রোগীর পেছনে ৫ থেকে ১০ জন স্বজনের ওয়ার্ডে আগমন ঘটে। তাদের অনেকে দীর্ঘদিন সময় ওয়ার্ডে অবস্থান করেন। বাধা দিলে ঘটে বিপত্তি। ওয়ার্ডে অবস্থান করেই তারা ক্ষান্ত হন না। তারা নার্সদের উদ্দেশ্য করে নানা কথা বলতে থাকেন। ঠিকমতো রোগী সেবা না দেয়ার অভিযোগ তুলেন। এভাবে রোগীর স্বজনদের অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপে নার্সদের দায়িত্ব পালন ব্যাহত হয় বলে জানান স্বপ্ন আজিম।