মার্চ ২০১৯ সালে শুরু হওয়া করোনা সংক্রমণ ২০২২ সালের মের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসেও সংক্রমণ ও মৃত্যু বন্ধ হয়নি। সারা বিশ্বে তো বটেই, আমাদের দেশেও পুনঃসংক্রমণ বা সংক্রমণের হার বেড়ে যাবার কথা শোনা যাচ্ছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্যানুযায়ী- মে ১১, ২০২২ তারিখে ইউরোপে করোনায় মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশী পরিলক্ষিত হয়েছে। এদিন জার্মানীতে ১৯৪ জন, ইটালীতে ১১৫ জন, রাশিয়ায় ৯৮ জন, হাঙ্গেরীতে ৭৭ ও কানাডায় ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া একই দিনে থাইল্যান্ডে ৫৬ জন ও জাপানে ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে। অর্থাৎ, সারা পৃথিবীতে করোনায় মৃত্যু থেমে নেই। চীনে করোনা ঠেকানোর নতুন কৌশল ব্যর্থ হয়েছে বলে ডাব্লিউএইচও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। আমাদের দেশে ১১ মে ক্রিকেটের অলরাউন্ড তারকা সাকিব আল-হাসান করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
হার্ড ইমিউনিটির ধারণা নিভিয়ে দিয়েছে বর্ধিত স্পাইক সমৃদ্ধ এর নিত্যনতুন ধরণের আবির্ভাব। টিকা আবিষ্কারের ফলে স্বস্তি ফিরে এলেও শুধু টিকা নিলেই মুক্তি কোথায়? টিকা এক, দুই বার করে নেবার পর এর মেয়াদ কতদিন তা কেউই ঠিকমত জানাতে না পারায় বুষ্টার অর্থাৎ তৃতীয় ডোজ নেয়া সম্পন্ন করেছেন অনেকেই। অনেকটা আশাবাদী হয়ে বুষ্টার নেবার মাত্র এক মাসের মাথায় দ্বিতীয়বার করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট দ্বারা পুনরায় সংক্রমিত হবার ঘটনায় জনমনে নতুন ভীতির সঞ্চার হয়েছে।
এতদিন বিষয়টি খবরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে গুজব বলে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে যখন ঢাকায় বসবাসরত আমার নিকটাত্মীয়রা বুষ্টার ডোজ নিয়ে নির্ভয়ে চলাফেরা শুরু করেছেন তখনই শোনা গেল তাদের ঘন ঘন সর্দি-জ্বর হচ্ছে। সবাই ভেবেছে এটা সিজেনাল সর্দি-জ্বর। দুদিন বাদেই ছেড়ে যাবে। কিন্তু না, এক সপ্তাহের বেশী সময় ধরে যখন আরো অন্যান্য উপসর্গ হাজির করতে শুরু করলো তখন সন্দেহবাতিক হয়ে রাজধানীর একটি খ্যাতনামা পরীক্ষাগারে গিয়ে পরীক্ষা করে জানা গেল দ্বিতীয়বার তাদের করোনায় আক্রান্ত হবার ঘটনা। আমাদের একজন সিনিয়র কলিগও বুষ্টার ডোজ নেয়ার পর গতমাসে একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন । এর অর্থ বুষ্টার ডোজ নিয়েও নিস্তার নেই, নেই শতভাগ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। বোঝা গেল মানুষের গণ অবহেলা ও অবাধ চলাচলের মাধ্যমে হার্ড-ইমিউনিটি তৈরীর প্রবণতার ধারণা ভ্রান্ত।
কারণ, করোনা যক্ষ¥া বা হামের মত একমুখী গতির ভাইরাস নয়। যক্ষা বা হামের টিকার কার্যকারীতার মেয়াদ আজীবন বা অনন্তকাল বলে প্রতীয়মান হলেও করোনার ক্ষেত্রে তা হচ্ছে না। করোনা সেগুলোর চেয়ে ভিন্ন এক জিনিষ যার চরিত্র বহুমূখী ও গতি নিরন্তর। করোনা ঘুরে ঘুরে আসে। নতুন ধরণের করোনা মানে না বুষ্টার টিকা, মানে না কোন বাধা। অবাধ এর চলনভঙ্গি, অজানা এর স্থানান্তর প্রক্রিয়া। তাই বিশ্বব্যাপী এর সংক্রমণ থেমে নেই। আজ কমে তো কাল আবার বেড়ে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ করেনাকে তুচ্ছজ্ঞানে অবহেলা ও উপেক্ষা করে উদ্দাম গতিতে চলতে চেয়ে এর কাছে ধরাশায়ী হয়েছিল ২০২০ সালেই। টিকা আবিষ্কার করে খুশীতে সবাই অবাধ ভ্রমণ, সমুদ্রের নীল পানিতে সাঁতার কাটা শুরু করেছিল। দু’বছর পর (ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০২২) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনার মৃত্যুসংখ্যা বিশ্বের সকল দেশের চেয়ে বেশী যা ২,০৭০ জন। জার্মানীতে একই দিনে সর্বচ্চো সংক্রমণ ঘটেছে যার মোট সংখ্যা ২ লাখ ৬ হাজার ৩৭ জন। এর অর্থ দাঁড়ায়, এখনো করোনার ভয়াবহ সংক্রমণকে টিকা দিয়ে রুখতে পারেনি উন্নত দেশের মানুষ। চীন বা বিশ্বরে অন্য কোন দেশও সংক্রমণ বন্ধ করতে পারেনি।
কারণ এটা স্থানীয় সংক্রামক রোগ নয়। এটা বৈশ্বিক সংক্রামক রোগ যা গোটা বিশ্ববাসীকে তটস্থ করে রেখেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানব দেহে টিকা নেয়ার পর এর কার্যকারীতার মেয়াদ তিন থেকে ছয় মাস। তাই ছয় মাস পার হলে বুষ্টার ডোজ দেবার কথা বলা হচ্ছে। বুষ্টার ডোজের নেয়ার পর এর মাধ্যমে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ হার্ড ইমিউনিটি তৈরীর সম্ভানার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু উন্নত দেশের মানুষ টিকা নেবার ক্ষেত্রেও উদাসীনতা দেখানোর ফলে তাদের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি তৈরী হওয়া সুদূর পরাহত।
নতুন করোনা ভ্যারিয়েন্ট মানে না কোন বুষ্টার ডোজ। আমাদের দেশে বুষ্টার ডোজ নেবার পর কত মানুষ পুনঃআক্রান্ত হচ্ছে তার পরিসংখ্যান নেই। বুষ্টার ডোজ নিয়ে নির্ভয়ে চলাফেরার কথা বলা হলেও এর কার্যকারীতার মেয়াদ স্পষ্ট করে জানানো হচ্ছে না। এর উপর কোন কার্যকরী গবেষণা রিপোর্টও কেউ প্রকাশ করছেন না। তাই কেউ তা সঠিকভাবে বলতেও পারছেন না। বুষ্টার ডোজ নেবার পর আমার জানা মতে আমাদের দেশে দুজন উর্দ্ধতন সরকারী কর্মকর্তা পুনরায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের পরিবারের সদস্যরাও আক্রান্ত হবার খবর পাওয়া গেছে
অন্যদিকে দরিদ্র বিশ্বের মানুষ এখনও প্রথম ডোজের টিকা পায়নি। যেমন আমাদের দেশে এক কোটি নিম্ন আয়-পেশা ও ভাসমান মানুষ যাদের এনআইডি কার্ড নেই বা যারা রেজিস্ট্রেশন করতে পারেননি বা করতেও জানেন না তাদেরকে বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে প্রথম ডোজের টিকা দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দরিদ্র দেশে এখনও টিকা কেনার অর্থের যোগান করতে না পারায় তারা জাসিংঘের সাহায্যের আশায় দিনাতিপাত করে অপেক্ষার প্রহর গুনে চলেছেন। তারা টিকা পাচ্ছে না কিন্তু ভিসা পাচ্ছে বিদেশ ভ্রমণের। টিকা নেয়া ছাড়া তাদের অবাধ চলাফেরায় বিশ্বে করোনা প্রতিরোধে হার্ড ইমিউনিটি তৈরীর আশা ক্রমশ নিভে যাচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, হার্ড ইমিউনিটি তৈরী করতে হলে বিশ্বের সকল মানুষকে টিকা শুমারীর মাধ্যমে একযোগে টিকা নিতে হবে। কিন্তু সেটা অত্যন্ত কঠিন কাজ। ধনী দেশের মানুষ টিকা নিতে চায় না, এজন্য আন্দোলন করে। গরীব দেশের মানুষ অর্থাভাবে টিকা ক্রয় করতে পারে না। এইতো বর্তমান পরিস্থিতি, এইতো করোনা নিয়ন্ত্রণের সবিশেষ নিয়তি।
নতুন করোনা ভ্যারিয়েন্ট মানে না কোন বুষ্টার ডোজ। আমাদের দেশে বুষ্টার ডোজ নেবার পর কত মানুষ পুনঃআক্রান্ত হচ্ছে তার পরিসংখ্যান নেই। বুষ্টার ডোজ নিয়ে নির্ভয়ে চলাফেরার কথা বলা হলেও এর কার্যকারীতার মেয়াদ স্পষ্ট করে জানানো হচ্ছে না। এর উপর কোন কার্যকরী গবেষণা রিপোর্টও কেউ প্রকাশ করছেন না। তাই কেউ তা সঠিকভাবে বলতেও পারছেন না। বুষ্টার ডোজ নেবার পর আমার জানা মতে আমাদের দেশে দুজন উর্দ্ধতন সরকারী কর্মকর্তা পুনরায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের পরিবারের সদস্যরাও আক্রান্ত হবার খবর পাওয়া গেছে।
নতুন করোনা সংক্রমনের ব্রিডিং পয়েন্ট এখনও বড় শহর, বহুতল ভবনের বদ্ধ লিফট, এসি গাড়ি, এসি ঘর, আবদ্ধ মার্কেট, রেষ্টুরেন্ট ও বিপণি বিতান। যেখানে অল্প জায়গায় বেশী মানুষ এবং প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের ব্যবস্থা নেই সেখানে করোনা লেগেই আছে। বুষ্টার ডোজ দেয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জার্মানীতে এ বছর ফেব্রুয়ারীর ৩য় সপ্তাহে তৃতীয়বারের মতো অতি বেশী সংক্রমণ ও মৃত্যু শুরু হওয়াটা সারা বিশ্বের জন্য অশনি সংকেত।
গত ২২ ফেব্রুয়ারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা নেবার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু একটি ক্লাসে আশি-নব্বই জন শিক্ষার্থীর জন্য নতুন করে দূরত্ব বজায় রেখে বসার ব্যবস্থা তো কোথাও করা হয়নি। আলাদা শিফটের ব্যবস্থাও করা হয়নি। তাদেরকে আগের মতো গায়ে গা ঘেঁষেই বসতে হবে। এজন্য পরিস্থিতি হঠাৎ আরো বেশী খারাপ হয়ে গেলে কি করতে হবে সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
মে-১১ জানা গেছে ক্রিকেট তারকা সাকিব আল-হাসান করোনা পজিটিভ হওয়ায় তিনি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আসন্ন টেষ্ট ক্রিকেট সিরিজ খেলতে পারবেন না। ক’দিন আগে তিনি আমেরিকা ভ্রমণ করে এসেছেন। সেদেশে এখনও করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর ভয়াবহতা দেখা যাচ্ছে। এছাড়া প্রতিদিন কত সংখ্যক মানুষ বিদেশ থেকে দেশে প্রবেশ করছেন তাদের উপর স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় শৈথিল্য দেখানো হচ্ছে। প্রতিবেশী ভারতেও আবার নতুন করে করোনা সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে।তাহলে কি করেনার চতুর্থ ঢেউ শুরু হয়ে গেছে? এ বিষয়ে আমাদের দ্রুত সাবধান হওয়া উচিত।
অন্যদিকে দেশের ভিতরেও মানুষ মানছে না কোন নিয়ম। হচ্ছে না কোন সুরক্ষা। করোনার সুরক্ষার নিয়ম-কানুন শোনালেই এক শ্রেণির মানুষের মেজাজ দিন দিন মানুষ বিগড়ে যাচ্ছে। করোনা এখন একটি মনোঃসামাজিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। অন্যদিকে বুষ্টার ডোজেও অনন্তকাল বা আজীবন করোনামুক্তির আশা ক্ষীণ। তাই চিন্তার বিষয় হলো- হার্ড ইমিউনিটি তৈরীর ধারণা কি শুধু ‘মিথ’ বা রূপকথা হয়ে বাতাসে ভেসে বেড়াবে? অবশেষে এ অদৃশ্য আপদ থেকে বিশ্ববাসীর অচিরেই শতভাগ মুক্তি মিলবে তো?
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন