logo
আপডেট : ১৪ মে, ২০২২ ১১:৫৭
নিত্যপণ্যের বাজার: ‘আর তো পারছি না’
রাজন ভট্টাচার্য ও ইফ্ফাত শরীফ

নিত্যপণ্যের বাজার: ‘আর তো পারছি না’

রাজধানীর পেঁয়াজের প্রধান পাইকারী আড়ত শ্যামবাজার

* ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে কেজিতে বাড়ল ২০ টাকা * রসুন বেড়েছে ৪০ টাকা * ডজনপ্রতি ডিমের দাম বেড়েছে ২০ টাকা * প্রতি কেজি আলুতে বেড়েছে ৫ টাকা * মাংস ও সবজিতে স্বস্তি নেই * বাড়তি দামের আশায় গুদামে বন্দি চাল!

সয়াবিন তেলের উত্তাপের মধ্যেই ফের বেসামাল পেঁয়াজ ও রসুনের বাজার। ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম বেড়ে ৩০ টাকার স্থলে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

প্রতি কেজি আলুতে দাম বেড়েছে ৫ টাকা, বসুনের প্রতি কেজিতে বেড়েছে ৪০ টাকা! ডজনপ্রতি ডিমে বেড়েছে ২০ টাকা। এর বাইরে সবজির বাজারও বেশ গরম। সুখবর নেই মাংসের বাজারে।

সব মিলিয়ে বাজার বেসামাল। স্বস্তির কোনো সুবাতাস নেই। সংসার চালাতে নাভিশ্বাস উঠেছে সব মানুষের। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের কষ্টের যেন শেষ নেই।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে হটাত করেই পেঁয়াজের দাম বাড়ায় ক্রেতারা ক্ষোভ জানিয়েছেন।

এদিকে বৈশাখ প্রায় শেষ। সারা দেশে বোরো ফসল কাটা শেষ পর্যায়ে। কিন্তু চালের বাজারে কোনো সুখবর নেই।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে নতুন চাল এসেছে, তবে তা খুচরা পর্যায়ে এখনো ওঠেনি। বাড়তি দামের আশায় বড় বড় আড়তদাররা নতুন চাল গুদামে মজুত করে রেখেছেন।

ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, নতুন চাল বাজারে এলে অন্তত কেজিতে ৫ থেকে ৭ টাকা বাড়বে। আর এ অপেক্ষাতেই আছেন তারা। দাম বাড়লে তারপর খুচরা পর্যায়ে নতুন চালের সরবরাহ হতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে।

বাজার ও সরকারি তথ্যে জানা গেছে, খোলা ময়দা ও আটা, খোলা ও বোতলজাত সয়াবিন, পামঅয়েল, মসুর ডাল, দেশি ও আমদানি পেঁয়াজ, ছোলা, দেশি শুকনা মরিচ, মুরগি ব্রয়লার, আলু, দেশি ও আমদানিকৃত রসুন, গরুর মাংস, ডিম, আমদানিকৃত হলুদ এবং জিরার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।

এদিকে শুকনো বাজারের মধ্যে একলাফে রসুনের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৪০ টাকা। বাজারে মূলত দুই ধরনের রসুন দেখা গেছে- দেশি রসুন কেজিপ্রতি ১০০ টাকা। চায়না রসুন কেজিপ্রতি ১৩০ টাকা।

কয়েকদিন আগেও দেশি রসুনের দাম ছিল ৬০ টাকা কেজি। চায়না রসুনের দাম ছিল ৯০ থেকে ১০০ টাকা কেজি। দেশি আদা বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৪০ টাকায়।

আমদানিকৃত আদা বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ১২০ টাকায়। প্রতি কেজি জিরা বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়। প্রতি কেজি ধনিয়া বিক্রি হচ্ছে ১২০ থেকে ১৭০ টাকায়।

অন্যদিকে সবজির বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেগুনের কেজি বিক্রি করছেন ৫০ থেকে ৭০ টাকা। শসার বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়। লাউয়ের পিস বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা। বরবটিও আগের মতো ৬০ থেকে ৭০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।

তবে সবজির বাজারে মূল্য বাড়ার তালিকার মধ্যে আছে টমেটো, কাঁচকলা, পেঁপে, গাজর এবং আলু। ঈদের আগে ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া টমেটো এখন ৫০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

৩০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া কাঁচা পেঁপে এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। আর ৩০ টাকার কাঁচকলার হালি ৪০ টাকা। আলু ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি। গাজর বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়।

অন্যদিকে পটোল, ঢ্যাঁড়স, ঝিঙে, চিচিঙ্গার দাম কিছুটা কমেছে। পটোলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা, যা আগে ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা। ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া ঢ্যাঁড়সের দাম কমে ৩০ থেকে ৪০ টাকা হয়েছে।

ঝিঙে ও চিচিঙ্গার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা, যা আগে ছিল ৪০ থেকে ৫০ টাকা।

এদিকে রাজধানীর বাজারগুলোর সবজি বিক্রেতারা জানান, বাজারে যেসব সবজির সরবরাহ বাড়ছে, সেগুলোর দাম কমেছে। আর যেসব সবজির সরবরাহ কম, সেগুলোর দাম এখন বাড়তি।

সরবরাহ বাড়লে যেসব সবজির দাম বেড়েছে, সেগুলো আগের অবস্থানে ফরে যাবে। গত সপ্তাহে ডজনপ্রতি ডিমের দাম ছিল ১০০ টাকা। বৃহস্পতিবার থেকে বিক্রি হচ্ছে ১১৫ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডিমের চাহিদা বেশি, সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে।

অন্যদিকে ঈদের আগে যে গরুর মাংসের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ৭০০ টাকা হয়েছে। এর মূল্য কমা তো দূরের কথা, বরং কুরবানি আসার আগে গরুর মাংসের কেজি ৮০০ টাকা হতে পারে বলে জানান মাংস বিক্রেতারা।

তবে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০ টাকা কমে বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায়। অন্যদিকে পাকিস্তানি কক এবং সোনালি মুরগির মূল্য ১০ টাকা বৃদ্ধি হয়ে বিক্রি হচ্ছে ৩১০ থেকে ৩৩০ টাকা কেজিতে।

বাজারে মাছের দামে তেমন পরিবর্তন আসেনি। আকারভেদে রুই মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৮০ থেকে ৪০০ টাকা। ১ কেজি ওজনের ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ১৩০০ থেকে ১৬০০ টাকায়।

তেলাপিয়া ও পাঙ্গাস মাছ বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকায়। শিং মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪৬০ টাকা কেজিতে। শোল মাছ বিক্রি হচ্ছে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকায় এবং থাই কৈ মাছ পাওয়া যাচ্ছে ২০০ থেকে ২৩০ টাকা কেজি।

পাবদা মাছের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। এছাড়া শুক্রবার সকালে খুচরা দোকানগুলোয় ১ লিটারের বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহ বেড়েছে। ফ্রেশসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বোতলজাত ১ লিটার সয়াবিন ১৯৮ টাকা গায়ের দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

বাসাবো বাজারে ক্রেতা রূপন জানান, তেলেল গায়ে তো আগুন। তাই অল্প করে কিনেছি। ১ লিটার ১৯৮ টাকায় কিনতে হয়েছে বলে জানান তিনি।

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এভাবে আর কতদিন চলবে। দিন যাচ্ছে আর পণ্যের দাম বাড়ছে। অথচ মানুষের আয় তো বাড়ছে না। আহাম্মদবাগের ভাই ভাই স্টোরের ব্যবসায়ী কাদির বলেন, শুক্রবার সব পণ্যের চাহিদা বাড়ে।

সকাল থেকে ক্রেতারা এসে বিভিন্ন পণ্যের বাড়তি দামের কথা শুনে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কেউ নিচ্ছেন, কেউবা খালি হাতে বাসায় ফিরেছেন। মুগদা বাজারের ক্রেতা সুমন বলেন, ‘সবকিছুর দাম বাড়ে, কমে না।

আয় বাড়ে না। তাই দিন দিন সংবারের খরচ কমাতে হচ্ছে। কত কমাব? সবদিক থেকে কাটছাঁট করলে তো আর জীবন চলবে না। আর তো পারছি না। জানি না কতদিনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।’

সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী পান্নু বলেন, ‘বিভিন্ন দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি নাকি বন্ধ ঘোষণা করছে। তাই দাম বাড়ছে। একই কারণে রসুনের দামও বাড়ছে।’

অপর ব্যবসায়ী দিদার বলেন, ‘আমরা যদি কম টাকায় পণ্য কিনতে পারি, তাহলে ভোক্তা পর্যায়ে সহনীয় দামে বিক্রি করতে পারি।

আমাদের কাছে সকাল থেকে যত কোম্পানি মাল দিতে আসে, সবাই বাড়তি দামে পণ্য দিচ্ছে। আমরা কম কীভাবে রাখব?’

এদিকে গত মাসে ইন্দোনেশিয়া পামঅয়েল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে ভোজ্যতেলের দাম। ঈদের আগেই খুচরায় সয়াবিন তেলের কেজি ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।

সেইসঙ্গে বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ প্রায় নেই হয়ে যায়। পরবর্তীতে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায়, এতে বাজারে সয়াবিন তেল আসতে শুরু করে।

দাম বাড়ানোর পর দেশের বিভিন্নস্থানে চলে অভিযান। এতে মজুত থাকা বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তেল উদ্ধার করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এতে বাজারে এখন ভোজ্যতেলের সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। তবে দাম কমেনি।

খুচরা পর্যায়ে খোলা সয়াবিন তেলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। পামঅয়েলের কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৯৫ থেকে ২০০ টাকা।

আর বোতলের ৫ লিটার সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ৯৮০ থেকে ৯৮৫ টাকা। শুক্রবার বোতলজাত তেল লিটারপ্রতি ১৯৮ টাকা বিক্রি হতে দেখা গেছে।

সাধারণ ব্যবসায়ীরা জানান, আস্তে আস্তে পরিস্থিতি হয়তো স্বাভাবিক হবে। তবে তেলের সরবরাহ আগে চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। মানুষ তো বলছে ‘আর তো পারছি না’।