বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি) এলাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে এক কথায় অপরূপ। চারদিকে পাহাড়ঘেরা আর সবুজ গাছপালা মিলে যেন এক সবুজ অরণ্য।
শতবর্ষী গাছের ছায়ায় কনক্রিট ও যান্ত্রিক জীবন থেকে বেরিয়ে এসে এখানে বুকভরা শ্বাস নেন চট্টগ্রাম নগরবাসী। তাই সিআরবির সাত রাস্তা মোড় এলাকাকে চট্টগ্রামের ‘ফুসফুস বলা হয়।
চট্টগ্রামের এই ‘ফুসফুস’ খ্যাত সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করে দীর্ঘ ১০ মাসেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন করে আসছেন সচেতন নাগরিক সমাজ। এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মিসহ চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষজনও।
তাদের এই লাগাতার আন্দোলনের মুখে অবশেষে প্রস্তাবিত হাসপাতালটি সিআরবি থেকে সীতাকুণ্ডের কুমিরায় স্থানান্তর করা হচ্ছে!
অবশ্য এখনও সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত হয়নি। গত ১০ মে প্রস্তাবিত হাসপাতালটির বিকল্প স্থান নিয়ে আলোচনা হয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে।
যদি হাসপাতাল সিআরবিতে না হয়, সেক্ষেত্রে কোথায় হতে পারে তা নিয়ে কথা হয়েছে ওই বৈঠকে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরায় রেলওয়ের বন্ধ হয়ে যাওয়া যক্ষা হাসপাতাল এলাকায় প্রস্তাবিত হাসপাতালটি হতে পারে বলে মতামত এসেছে।
সংসদীয় কমিটিতে এই আলোচনাকে ‘ইতিবাচক’ হিসেবে দেখছেন সিআরবি রক্ষার আন্দোলনকারীরা।
ঢাকায় গত ১০ মে অনুষ্ঠিত সংসদীয় কমিটির সভায় সিআরবিতে প্রস্তাবিত হাসপাতালের বিকল্প স্থান নিয়ে আলোচনায় তুলেন রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও চট্টগ্রামের রাউজান সংসদীয় আসনের সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সিআরবিতে হাসপাতাল প্রকল্প হচ্ছে পিপিপির আওতায়। এটিসহ বিভিন্ন প্রকল্প কেন হচ্ছে না, তা নিয়ে সংসদীয় কমিটির সভায় জানতে চাওয়া হয়েছিল।
এটি আলাদা কোনো এজেন্ডা হিসেবে আলোচনা হয়নি। চট্টগ্রামের জন্য হাসপাতাল দরকার। এটি যদি চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় না হয়, তাহলে অন্য কোনো জায়গায় হতে পারে।
চট্টগ্রামের স্বার্থে এটি হতে হবে। সেই কারণে কুমিরা এলাকায় রেলের জমিতে করার কথা তুলেছি।’
পিপিপির আওতায় হাসপাতাল প্রকল্পটির গুরুত্ব তুলে ধরে ফজলে করিম চৌধুরী বলেন, ‘এখানে ৫০০ শয্যার হাসপাতালের পাশাপাশি মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট হবে। সুতরাং চট্টগ্রামবাসীর জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।
সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা করেছি, সভায় রেকর্ড হয়েছে।’
এ ব্যাপারে পূর্ব রেলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, কুমিরা রেল স্টেশনের কাছে যক্ষা হাসপাতালটি প্রায় ৩০ বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।
সিআরবি’র বদলে সেখানেই রেলের প্রায় ১৩ একর জমিতে পিপিপির আওতায় হাসপাতাল হতে পারে বলে এখন আলোচনা হচ্ছে। তিনি আরো জানান, বিকল্প প্রস্তাব যদি আসেও, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে।
এতদিন তো রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম নগরীর সিআরবি এলাকাতেই হাসপাতাল করার সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। এখন অন্তত বিকল্পের আলোচনা এসেছে। এটা ভালো দিক।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম নগরীর ‘ফুসফুস’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ঐতিহ্যবাহী সিআরবিতে পিপিপি প্রকল্পের আওতায় ৫০০ শয্যার হাসপাতাল ও ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য ইউনাইটেড গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করে রেলওয়ে।
গত বছরের জুলাই মাসে প্রকল্প এলাকার জমি হাসপাতাল নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বুঝিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলে প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু হয়।
গত ১০ মাস ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহরে এখন কোনো উন্মুক্ত স্থান নেই বললেই চলে।
ঢাকায় অনেক উদ্যান আছে, চট্টগ্রামে তাও নেই। একমাত্র বড় উন্মুক্ত স্থান এখন এই সিআরবি। তাছাড়া বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ও শতবর্ষী দুর্লভ বৃক্ষশোভিত সিআরবি।
এই সিআরবি রক্ষায় পরিবেশ বান্ধব প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছি। বিশ্বের পরিবেশ নিয়ে বিশেষ করে জলবায়ু নিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সক্রিয় ভূমিকা রেখে জাতিসংঘসহ অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন।
সেই পরিবেশ বান্ধব প্রধানমন্ত্রী সিআরবির শতবর্ষী গাছগুলো কেটে নিশ্চয়ই হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত দেবেন না। সিআরবির পরিবেশ রক্ষার্থে অবশ্যই তিনি প্রস্তাবিত হাসপাতালটি অন্য জায়গায় সরিয়ে নেবেন বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’
তিনি বলেন, ‘সিআরবি রক্ষার আন্দোলন মানে চট্টগ্রাম এর ‘ফুসফুস’ রক্ষা করার আন্দোলন। কারণ সিআরবি চট্টগ্রামের একটি মাত্র অঞ্চল যেখানে রয়েছে অসংখ বা হাজার খানিক ছোট বড় গাছ ও শতবর্ষী গাছসহ শতাধিক প্রজাতির গাছ। যেখানে ৬০টি বিরল প্রজাতির গাছও রয়েছে, যেগুলো বিলুপ্তির পথে। এটি একটি অসাধারণ সুন্দর অঞ্চল।
তাই সিআরবি রক্ষার আন্দোলন মানে শেখ হাসিনার দেশ ও পরিবেশ রক্ষার জন্য বা প্রকৃতির জন্য যে চিন্তা, তার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করার একটি অংশ।’
সংসদীয় কমিটিতে বিকল্প নিয়ে আলোচনার খবরকে স্বাগত জানিয়ে অনুপম সেন বলেন, ‘কুমিরায় রেলের পরিত্যক্ত হাসপাতালের জমিতে প্রস্তাবিত হাসপাতাল প্রকল্প হলে ‘ভালোই হবে।’
নাগরিক সমাজ চট্টগ্রামের সদস্য সচিব ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল বলেন, ‘এটাও এক ধরনের অগ্রগতি। সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হওয়ায় আমরা আশাবাদী, সিআরবি রক্ষা পাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জনস্বার্থ বিবেচনায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন।’
প্রসঙ্গত চট্টগ্রামের ‘ফুসফুস’ খ্যাত অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকা সিআরবিতে পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুনসহ নানা ঐতিহ্যগত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই নয়, ঐতিহাসিক কারণেও গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত এই সিআরবি। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে এখানে শহীদ হয়েছেন চাকসু জিএস আব্দুর রবসহ বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
এসব কারণে চট্টগ্রাম ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (সিডিএ) এর ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে (ড্যাপ) সিআরবি এলাকাকে হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়েছে। হেরিটেজ হিসেবে একটি গেজেটও প্রকাশ করা হয়েছে।
সিআরবিকে হেরিটেজ ঘোষণা করায় এখানে নতুন কোনো স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে আইনগত বাধা রয়েছে।
তারপরও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সকল আইনকে অগ্রাহ্য করে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) এর আওতায় ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডকে সঙ্গে নিয়ে ৫০০ শয্যার হাসপাতাল নির্মাণ করছে।
সিআরবির ছয় একর জায়গার ওপর নির্মিতব্য এই হাসপাতালের পাশাপাশি ১০০ আসন বিশিষ্ট মেডিকেল কলেজ নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রায় ৪০০ কোটি টাকার এই হাসপাতাল
প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অতি উৎসাহী রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কারণ এই হাসপাতালটি ৫০ বছর পর ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে পুরো মালিকানা পেয়ে যাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
তাছাড়া সিআরবিতে হাসপাতালের জন্য ছয় একর জায়গা লিজ দিয়ে এককালীন পাঁচ কোটি টাকা পাওয়ার পাশাপাশি হাসপাতালটি নির্মাণকালীন প্রথম তিন বছর পর থেকে লিজ বাবদ হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে বাৎসরিক ফি পাবে রেলওয়ে।
উভয়পক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির চতুর্থ ও পঞ্চম বছর ৭৫ লাখ টাকা করে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে পাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এরপর প্রতিবছর দেড় কোটি টাকা করে পাবে রেলওয়ে।
তিন বছর পর পর ১০ শতাংশ হারে লিজের ফি বাবদ বাড়তি টাকা পাবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
এসব কারণে এই হাসপাতাল নির্মাণ করতে বদ্ধপরিকর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সিআরবির প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে এখানে কোনোভাবেই হাসপাতাল করতে দেবে না চট্টগ্রাম নগরীর পরিবেশ ও ইতিহাস সচেতন মানুষ।
তাই সিআরবিকে রক্ষার আন্দোলনে নেমেছে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ। আন্দোলনকারীদের দাবি, সিআরবির মতো এমন এই সবুজ অরণ্য গড়ে উঠতে সময় লাগে শতবছর।
আর ৫০০ শয্যার একটি আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না।
তাই সিআরবির এই সবুজ অরণ্য ধ্বংস না করে রেলওয়ের অন্য কোনো জায়গায় ইউনাইটেডের ওই হাসপাতালটি নির্মাণ করা হোক।