আমরা বরং- প্রিয় বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার গল্প শুনি। তলাবিহীন ঝুড়ির সেই গল্পকে জাদুঘরে পাঠিয়ে এশিয়ার অর্থনীতিতে নতুন বাঘ বা ‘এশিয়ান টাইগারস’ হিসেবে যেসব দেশের নাম উচ্চারিত হচ্ছে তারমধ্যে অন্যতম দেশটির নাম বাংলাদেশ। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি। গত এক দশক ধরে এশিয়ায় যে কয়েকটি দেশের অর্থনীতি সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কোনো নিজস্ব বা দেশীয় বিশ্লেষণ নয়, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার-এর সহযোগিতায় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘দেয়ার কুড বি অ্যা নিউ ‘‘এশিয়ান টাইগার’’, হেয়ারস হোয়াই’ শীর্ষক নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছে এশিয়ার অর্থনীতির নতুন বাঘ হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাবের সম্ভাবনার কথা। তাছাড়া বিভিন্ন বিশ্লেষণ ও সূচকে দেখা গেছে, বিশ্বের দ্রুত উন্নতি লাভ করা ভারত, চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামসহ দক্ষিণ এশিয়ার ১৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। আমরা দেখতে পাচ্ছি চলতি দশকে উন্নয়নের সব সূচকেই দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। প্রতিবেশী ভারতের চেয়েও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত চার দশকে অর্থনীতিসহ উন্নতির সব সূচকে পৃথিবীর পাঁচটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে- একথা এখন সারাবিশ্ব জানে এবং মানে। বাংলাদেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও উৎপানশীলতা বেড়েছে। নারী পুরুষ সমানতালে কাজ করে দেশের উন্নয়নে ভুমিকা রাখছে। উন্নয়নের প্রতিফলন দিবালোকের মতোই দৃশ্যমান। আমরা একবাক্যে বলতে পারি উন্নয়নে বিশ্বের মানদন্ডে বাংলাদেশের অবস্থান আশাব্যঞ্জক। এসব খবর যে কাউকে দেশ সম্পর্কে আশাবাদী করবে। যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নারী উন্নয়ন, বৈদেশিক আয়, প্রযুক্তির বিপ্লব ও উন্নয়ন সূচকের প্রায় সব দিকেই অভুতপূর্ব অগ্রগতি সারাবিশ্বকে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুনভাবে ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করেছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্প বিকাশ নীতিকে অগ্রাধিকারের মানসিকতায় নিয়ে আসার বিকল্প নেই। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুটির শিল্পগলোকে বিকশিত হবার সুযোগ দিলে দেশের মানুষ বহুমুখী কর্মযজ্ঞে সচল রাখবে দেশের অর্থনীতির চাকা। গ্রামের জিনিস শহরে আসবে- যাবে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে। সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়- ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সিঙ্গাপুরের চেয়ে বাংলাদেশের ধনী দেশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে
গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারসের তত্ত্বাবধানে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউটের (আইআরআই) জরিপে বলা হয়েছে, অর্থনীতির উন্নয়নের কারণে দেশ সঠিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে বলে দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে। আইআরআই বলছে, ৮০ শতাংশের বেশি মানুষ বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী। জাপানের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করলে দেখা যাবে গত পঞ্চাশ বছর আগে জাপানও অতি দরিদ্র অর্থনৈতিক অবস্থানে ছিল। জাপানিরা পৃথিবীর অনেক মানুষের কাছে ‘অতি পরিশ্রমী’ হিসেবে বিদ্রƒপ শুনেছে। কিন্তু দরিদ্র অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে পরিশ্রম করেছে। চল্লিশ বছরের মাথায় অর্থনীতিবিদের মূল্যায়নÑ ‘প্রতিকূলতাই জাপানীদের জন্য আর্শীবাদ’। বাঁচার তাগিদে প্রচন্ড রকমের কর্মপ্রেরণা ও প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিলো তাদের মধ্যে। কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ না থাকাটা ছিলো দ্বিতীয় আর্শীবাদ। ফলে জাপান স্বাধীনভাবে সারা পৃথিবীর অঢেল সম্পদ আহরণে সচেষ্ট হয়েছিলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সব শিল্প কারখানা ধ্বংস হয়ে যাওয়া ছিলো তৃতীয় আর্শীবাদ। নতুন ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তারা শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছিল। অতি পরিশ্রমী জাতি হিসেবে জাপানীদের দুর্নাম জাতীয় উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে তামাম বিশ্বকে প্রমাণ করে দেখাল যে সব সম্ভব।
সম্ভাবনার বাংলাদেশ নিয়ে আমরা কি ভাবছি। বাস্তবিক পক্ষে আমাদের দেশের অর্থনীতিতে যে পরিমাণ অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় হয়, বিনিয়োগের পরিমাণ সে হার কেউ ছুঁতে পারেনি। দেশের মানুষের সাধারণ সঞ্চয়কে আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারছি না। সাধারণ মানুষের সঞ্চয় বিনিয়োগের অন্যতম মাধ্যম এখনো সামাজিক উদ্যোগ। এইসব সামাজিক উদ্যোগগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দিলে পাল্টে যাবে দেশের চেহারা। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শিল্প উদ্যোগ একটি সামাজিক, ব্যক্তিক, রাষ্ট্রীয় ও মনস্তাত্বিক বোধ পরিবর্তনের আন্দোলন। শুধু কৃষি নির্ভর দেশ পৃথিবীতে অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া অসম্ভব। কাজেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্প বিকাশ নীতিকে অগ্রাধিকারের মানসিকতায় নিয়ে আসার বিকল্প নেই।
বিশ্বের অর্থনীতি বিশারদরাও বলছেন বাংলাদেশ পরবর্তী ভারত বা চায়না হতে পারে। চীন তার বাজার উš§ুক্ত করে দেয় বিদেশি পুঁজি ও টেকনোলজির জন্য। বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বিশেষ কিছু শিল্প এলাকা তৈরি করে দিলে লাখ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। যা চীনকে একটি কৃষি নির্ভর রাষ্ট্র থেকে শিল্প নির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করে। কম দাম, গ্রহণযোগ্য মান, প্যাকিং ও পণ্যের বৈচিত্র্যে চীন এখন একচেটিয়া ব্যবসায়িক প্রাধান্য বিস্তার করেছে। বলা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে চীন বিশ্বের ৩০ শতাংশ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করবে। যদিও বিশ্বের পণ্য বাজারে চীনের বিস্তৃতি এখন- ‘ফুটওয়্যার থেকে আন্ডারওয়্যার এবং হার্ডওয়্যার থেকে সফটওয়্যার পর্যন্ত’। তাই বিপুল বেগে বিকাশমান অর্থনীতির বিশালতায় চীনকে প্রায়ই দৈত্যের সাথে তুলনা করা হয়। উৎপাদন নীতির থিওরি হচ্ছে- দারিদ্র্য দূর করার উপায় হলো ভাল জিনিস সস্তায় উৎপাদন করে বিক্রয় করা। চায়নারা সেটা করে দেখাতে পেরেছে। অথচ আমরা ঢাকার কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরাকে শিল্প এলাকা হিসেবে গড়ে তুলতে পারছিনা। জিঞ্জিরা দুই নম্বর বা নকল জিনিস তৈরির এলাকা হিসেবে পরিচিত। ভাবতে অবাক লাগে যারা নিজেদের চেষ্টায় বিদেশি ব্র্যান্ডের নকল পণ্য তৈরি করতে পারছে তাদেরকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে কেন উন্নমানের দেশীয় পণ্য তৈরির কাজে লাগানো যাচ্ছে না? ধোলাই খালের অশিক্ষিত শ্রমিকেরা যদি বিদেশি গাড়ির মেশিনারিজ পার্টস তৈরি করতে পারে তাহলে তাদেরকে কেন প্রশিক্ষিত করে ধোলাই খালকে শিল্প এলাকায় পরিণত করা যাচ্ছেনা? সরকার প্রণোদনা দিলে এসব ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোক্তারাও এগিয়ে আসবেন। তাছাড়াও দেশের অনেক ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শিল্প পৃষ্টপোষকতার অভাবে ধ্বংস হতে যাচ্ছে।
দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুটির শিল্পগলোকে বিকশিত হবার সুযোগ দিলে দেশের মানুষ বহুমুখী কর্মযজ্ঞে সচল রাখবে দেশের অর্থনীতির চাকা। গ্রামের জিনিস শহরে আসবে- যাবে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে। সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশের অর্থনীতি। বিভিন্ন বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়- ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সিঙ্গাপুরের চেয়ে বাংলাদেশের ধনী দেশ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আশেপাশের দেশগুলোকে তাদের যোগাযোগ রক্ষা করতে হলে বাংলাদেশকে মাধ্যম হিসেবে নেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নাই। অথচ আমরা জানি মাত্র ৫০ বছর আগেও সিঙ্গাপুর ছিলো একটি হতদরিদ্র দেশ। সেসময় সিঙ্গাপুরকে ‘কলোনি অব কুলিজ’ বলে উপহাস করতো। সিঙ্গাপুরের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান নিজের লেখা বইতে বলেছেন- মালয়েশিয়া যখন সিঙ্গাপুরকে পৃথক করে দিলো, তখন মনে হলোÑ ‘ইট বিকাম এ হার্ট উইদাউট বডি’। কিন্তু সেই অনিশ্চিত সিঙ্গাপুর দরিদ্র অবস্থান থেকে কতোটা উপরে উঠে এসেছে তা রীতিমত অভাবনীয়। এখন দুনিয়াতে ‘সিটি স্টেট’ বলতে সিঙ্গাপুরকেই বোঝায়। সিঙ্গাপুরের এমন ঈর্ষণীয় সাফল্যের মূলে রয়েছে ব্যবসাকেন্দ্র, যার দুনিয়াজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি। বলা যায়, সিঙ্গাপুরের সমৃদ্ধির নেপথ্য মূলত বন্দরকে কেন্দ্র করেই। আমাদের বাংলাদেশেরও সমুদ্র বন্দর আছে। আমরা চাইলে এই বন্দরগুলোকে বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। আর সত্যিই যদি তা পারা যায় তাহলে সিঙ্গাপুরের চেয়ে বাংলাদেশের ধনী রাষ্ট্র হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
ব্রিটেন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান নিউ ইকোনমিকস ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক গবেষণায় প্রতিষ্ঠানটির হ্যাপি প্ল্যানেট সূচকে সারা বিশ্বে ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অষ্টম সুখী দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সীমিত সম্পদের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্জন অনেক। বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস রিপোর্টে ১৯০টি দেশ নিয়ে সহজে ব্যবসা পরিচালনার তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ব্যবসার সক্ষমতা বেড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে ১০০ পয়েন্টের মধ্যে বাংলাদেশের অর্জন ৮১ দশমিক ৭৪ পয়েন্ট। সব মিলে এ সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২২তম। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অবকাঠামো খাতে উন্নতি হওয়ায় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১০৬। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) তৈরি প্রতিবেদনে বলা হয়, খর্বকায় শিশুর হার হ্র্র্রাসের ক্ষেত্রে যে ৬টি দেশে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। অষ্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর ইকনোমিকস অ্যান্ড পিসের ‘বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার সূচক’ অনুযায়ী ১৬২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৮তম। যা ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চেয়ে ভালো যদিও পিছিয়ে আছে নেপাল ও ভুটানের চেয়ে।
মোটকথা, বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা ঘরে-বাইরে, নারী-পুরুষে, শহরে-গ্রামে, কৃষকে-বণিকে প্রায় সবখানে সর্বক্ষেত্রে জনগণের মনে বিশেষত তরুণ সমাজের মাঝে বাংলাদেশকে নিয়ে আরো সামনে এগিয়ে যাবার নতুন আশার প্রভাব আলোড়িত করছে। এখন গ্রামে গ্রামে ঘুরে দেখলেও সবাক হৃদয় অবাক হবে চারপাশের পরিবর্তন দেখে। রাস্তা-ঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রযুক্তির প্রভাবে গ্রাম শহরের সেই দূরত্ব এখন আর নেই। গ্রামে অভাব ও অভাবী মানুষের সংখ্যা কমে গেছে। বিদ্যুতের আলোর ঝলক কিংবা সৌরবিদ্যুতের আলোয় আলোকিত গ্রামবাংলার ঘরবাড়ি, রাস্তার দোকানপাট। ঘরে ঘরে টেলিভিশন, ফ্রিজ, ডাইনিং টেবিল, সোফাসেটসহ শহুরে আধুনিক সৌখিনতার সব কিছুই এখন কমবেশি গ্রামে আছে। এখন আর কেউ বলতে পারবেনা যে, ‘বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে’।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, উন্নয়ন গবেষক এবং কলাম লেখক