‘কৃষকদের একের পর এক দুর্ভোগ লেগেই আছে। গেল মৌসুমে মসুর লাগিয়ে ছিলাম দেড় বিঘা। বৃষ্টিতে তলিয়ে সব নষ্ট হয়ে গেছে। এবার তিন বিঘা জমিতে ধান চাষ করলাম। বৃষ্টির কারণে সব ধান বাড়ি আনা সম্ভব হয়নি। শুকনা ধান তলিয়ে পচে যাচ্ছে। ধান, বিচলি সবই শেষ এবার। এখন সার-সেচ-চাষের টাকা কীভাবে শোধ করব। সব মিলে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ক্ষতি। দুই চোখে এখন খালি অন্ধকার দেখি।’
গত শুক্রবার সকালে যশোর শহরতলির পুলেরহাট মাঠে অশনির প্রভাবে টানা কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়া জমি থেকে মুঠোবাঁধা ধান ডাঙায় আনার সময় কৃষক নজরুল শেখ আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত এই কৃষকের বাড়ি সদর উপজেলার আরবপুর ইউনিয়নের মালঞ্চী গ্রামে।
নজরুল শেখ বলেন, ধান ভালো হয়েছিল। পাকা ধান প্রায় এক সপ্তাহ আগে কেটে ক্ষেতেই রোদে শুকাতে দিয়েছিলাম। কিন্তু ঝড়-বাদল শুরু হওয়ায় কাটা ধান আর বাড়ি আনা সম্ভব হয়নি। এখন ক্ষেতে হাঁটুপানি জমেছে। ভাসছে কাটা ধান। ধানগাছ পচে যাচ্ছে। অনেক ধানে অঙ্কুর গজিয়েছে। ধান নিয়ে খুবই বিপদে আছি।
শুধু নজরুল শেখ নন, এমন বিপদে আছেন যশোরের আট উপজেলার আরো অনেক কৃষক।
কয়েকজন কৃষক জানান, যশোরে ঈদের দিন থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। এরপর টানা দুদিন কড়া দাবদাহের পর গেল পাঁচদিন ধরে থেমে থেমে মাঝারি বৃষ্টি হচ্ছে। সঙ্গে ঝড় বইছে। বৃষ্টিপাত ও ঝড়ো বাতাসে জেলার বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির মুখে পড়েছেন জেলার কৃষকরা।
যশোর বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, গত পাঁচ দিনে যশোরে ১০২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে বুধ ও বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এতে ফসলের মাঠগুলোতে পানি জমে পাকা কাটা ধান নষ্ট হচ্ছে।
কৃষকদের অভিযোগ, ফসল রক্ষায় অতিরিক্ত অর্থ খরচ করেও বৃষ্টিতে শ্রমিক মিলছে না। এতে ক্ষেতেই পচে যাচ্ছে ধান। পানিতে ডুবে যাচ্ছে তাদের স্বপ্ন। মণিরামপুর, চৌগাছা, শার্শা ও সদর উপজেলায় বৃষ্টিতে বেশির ভাগই ধান পানিতে তলিয়ে গেছে।
মণিরামপুর উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের কৃষক আমির হোসেন এবার সাড়ে আট বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছেন। তার ক্ষেতের সব ধান পেকে গেছে। তিনি সাড়ে চার বিঘা জমির ধান কেটে ক্ষেতে শুকাতে দিয়েছিলেন। তিন দিনের বৃষ্টিতে তার ক্ষেতে প্রায় এক হাত পানি জমে গেছে।
তিনি বলেন, ক্ষেতে কোথাও এক হাত, আবার কোথাও প্রায় হাঁটু পানি। ক্ষেতে বিছানো ধানগাছ পচে গেছে। ধানের গাছ থেকে শিষ ভেঙে পড়ছে। পানিতে ভিজে ধানের অঙ্কুরোদগম বের হতে শুরু করেছে। বেশি টাকা দিয়েও কোনো শ্রমিক পাচ্ছি না। খুব ক্ষতির মুখে পড়েছি।
ঝিকরগাছা উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন জানান, চার বিঘা ধানের মধ্যে ১০ কাঠা জমির ধান বাড়িতে এনেছি। বাকি ধান মাঠে ভিজছে। বিচালি হবে না, আঁটি কেটে বাড়ি আনতে হবে।
একই গ্রামের সেকেন্দার আলীর মাঠে এক বিঘা জমির ধান কাটা ছিল। সেগুলো বাড়ি আনার জন্য স্ত্রীসহ তাকে মাঠে কাজ করতে দেখা গেছে। রাস্তার ওপরে শুকিয়ে তারপর ধান বাড়িতে আনতে হবে বলে তারা জানান।
ইজ্জেত আলী ও জিয়াউর রহমানকে ধানের আঁটি কাটতে দেখা যায়। তারা জানান, জমিতে পানি জমে আছে। আবার ধান পেকে গেছে। যদি পানি শুকানোর জন্য অপেক্ষা করি, তা হলে ধান ঝরে যাবে। এভাবে বৃষ্টি হতে থাকলে কৃষক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গবাদিপশুর খাদ্য সংকটসহ কৃষক চরম লোকসানের মধ্যে পড়বে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের যশোর কার্যালয়ের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) দীপঙ্কর দাশ বলেন, চলতি মৌসুমে জেলায় ১ লাখ ৫৮ হাজার ৫০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৪৫৯ মেট্রিক টন। বুধবার পর্যন্ত ৯৫ হাজার ১০৩ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। অর্থাৎ ৬০ শতাংশ জমির ধান কাটা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ জমির ধান কৃষকের ঘরে উঠে গেছে। বৃষ্টিতে ক্ষেতে কেটে রাখা ধানের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে।
ভিজে যাওয়া ধানের গাছ থেকে শিষ ভেঙে পড়ছে। ধানের অঙ্কুরোদগম বের হতে শুরু করেছে। ভিজে যাওয়া ধানের দাম কম হবে। তবে আর বৃষ্টিপাতের শঙ্কা নেই বলে জানান এই কৃষি কর্মকর্তা।