জুনেই খুলছে বহুল কাক্সিক্ষত পদ্মা সেতু। ইতোমধ্যে উদ্বোধনের তারিখ ঠিক করতে সেতু কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠিয়েছে। আলোচনা আছে, আগামী ২৩ বা ২৫ জুন উদ্বোধন হতে পারে দেশীয় অর্থায়নে নির্মিত এই সেতু। এই সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত সহজ হবে, সময়ও কমবে। তবে দেশের সবচেয়ে দীর্ঘতম এই সেতু পার হতে কত টোল হবে? এ নিয়ে এখন আলোচনা বিস্তর।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মিত এই সেতু পারাপারে লাগবে বড় অঙ্কের টোল। সেতু বিভাগের নির্ধারণ করা টোলের হার অনুসারে, বর্তমানে ফেরিতে পদ্মা নদী পার হতে যে টাকা লাগে, সেতু পার হতে এর চেয়ে গড়ে দেড় গুণ বেশি টাকা লাগবে। আর দ্বিতীয় দীর্ঘতম বঙ্গবন্ধু সেতুর টোলের সঙ্গে তুলনা করলে তা হবে প্রায় দ্বিগুণ। পদ্মা সেতুতে প্রস্তাবিত টোলহার কার্যকর হলে বড় বাসে ২ হাজার ৪০০ টাকা এবং মাঝারি ট্রাকে লাগবে ২ হাজার ৮০০ টাকা।
তবে সবকিছু এখনও চূড়ান্ত হয়নি। টোলের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইতোমধ্যে পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদনের পরই টোলের হার চূড়ান্ত হবে। এদিকে প্রস্তাবিত টোল বেশি বলছেন, পরিবহন মালিক সমিতি ও শ্রমিক নেতারা।
তারা বলছেন, রাজধানীতে সেনা কল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে হলুদ টেক্সিক্যাব চালুর সময় বাড়তি ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনস্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়ে টেক্সির ভাড়া কম নির্ধারণ করে দেন। সেই আলোকে পদ্মা সেতু যেন সবাই সহজেই ব্যবহার করতে পারে সেজন্য টোলের হার কমানোর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন পরিবহণ সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে পদ্মা নদী পার হতে ফেরিতে যানবাহনভেদে ভাড়া দিতে হয় ৭০ থেকে ৩ হাজার ৯৪০ টাকা। প্রস্তাব অনুসারে পদ্মা সেতুতে যানবাহনভেদে টোল দিতে হবে ১০০ থেকে ৬ হাজার টাকার বেশি। এর মধ্যে কার ও জিপের টোল ৭৫০ টাকা (ফেরিতে ৫০০ টাকা), বড় বাসে ২ হাজার ৪০০ টাকা (ফেরিতে ১ হাজার ৫৮০ টাকা), মাঝারি ট্রাক (৮-১১ টন) ২ হাজার ৮০০ টাকা (ফেরিতে ১ হাজার ৮৫০ টাকা)।
এর বাইরে মোটরসাইকেল ১০০ টাকা, পিক আপ এক হাজার ২০০ টাকা, মাইক্রো ১৩০০, ছোট বাস এক হাজার ৪০০, মাঝারি বাস দুই হাজার, ছোট ট্রাক পাঁচ টন এক হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (৫-৮ টন) ২১০০ টাকা, ট্রাক তিন এক্সেল পর্যন্ত পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা টোল নির্ধারণ করা হয়েছে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী ৩০ জুনের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করার কথা ঠিকাদারের। এর মধ্যে সেতু চালু হবে ধরে নিয়ে টোল আদায়কারী ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকাদার নিয়োগ করেছে সেতু বিভাগ।
এই কাজ পেয়েছে কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশন (কেইসি) ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)। এর মধ্যে এমবিইসি বর্তমানে মূল সেতু নির্মাণকাজ এবং কেইসি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে।
আগামী পাঁচ বছরের জন্য এই দুটি প্রতিষ্ঠান টোল আদায়, সেতু ও সেতুর দুই প্রান্তে যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাপনায় আধুনিক পদ্ধতি চালু এবং সেতু ও নদী শাসনের কাজ রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এর জন্য পাঁচ বছরে তাদের দিতে হবে ৬৯৩ কোটি টাকা।
টোল নির্ধারণে সেতু বিভাগের চিঠি :
সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, টোল আদায়ের প্রস্তুতি নিতে এ মাসের শুরুর দিকে কেইসি ও এমবিইসিকে চিঠি দিয়েছে সেতু বিভাগ।
সরকারি সংস্থাটি বলেছে, ৩০ জুনের মধ্যে পদ্মা সেতু চালু করার সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। উদ্বোধনের দিন থেকেই টোল আদায় শুরু হতে পারে। সেভাবেই তাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। এই চিঠি পেয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টোল আদায়সংক্রান্ত সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার কিনতে দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন কোম্পানিকে ইতোমধ্যে নির্দেশ দিয়েছে।
সেতু বিভাগের যুগ্ম সচিব রাহিমা আক্তার বলেন, পদ্মা সেতুর টোলহার নিয়ে একটা প্রস্তাব তারা তৈরি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, পদ্মা সেতুর জন্য টোলহারের প্রস্তাব তৈরি করেছে সেতু বিভাগের একটি কমিটি। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই প্রজ্ঞাপন দেবে সেতু বিভাগ। খসড়া যে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কমানোর সম্ভাবনা কম।
প্রস্তাবিত টোল হার ১৫ বছরের জন্য :
পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। ভায়াডাক্ট (দুই প্রান্তের উড়ালপথ) ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় ৫ কিলোমিটার। বঙ্গবন্ধু সেতুতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালুর সময় টোলের হার ছিল বেশ কম। ২০১১ সালে এবং সর্বশেষ গত বছর টোল বাড়ানো হয়েছে।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত টোলহার সেতু চালুর ১৫ বছরের জন্য প্রযোজ্য হবে। প্রতি ১৫ বছর পরপর টোলের হার ১০ শতাংশ করে বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। পদ্মা সেতু দিয়ে কত যানবাহন চলাচল করবে, এর পূর্বাভাস আগেই ঠিক করা হয়েছে। ওই পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২১ সালে সেতু চালুর হিসেবে দিনে প্রায় ৮ হাজার যানবাহন চলাচল করার কথা ছিল। ৩৫ বছর পর যানবাহনের সংখ্যা দিনে ৭১ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
আয় থেকে ঋণের টাকা পরিশোধ :
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হলেও এর ব্যয়ের টাকা ঋণ হিসেবে সেতু কর্তৃপক্ষকে দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। পদ্মা সেতুর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সেতু কর্তৃপক্ষ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ নিজেদের আয়ে চলবে প্রতিষ্ঠানটি। পদ্মা সেতুর জন্য নেওয়া ঋণ ১ শতাংশ সুদসহ ৩৫ বছরে ফেরত দিতে হবে সেতু কর্তৃপক্ষকে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করার উল্লেখ রয়েছে।
এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান সরকারের ঋণ মওকুফ তহবিলের অর্থ ৩০০ কোটি টাকা। এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। ফলে প্রায় ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়কে ফেরত দিতে হবে। এর সঙ্গে বাড়তি ১ শতাংশ হারে সুদ ধরলে মোট পরিশোধ করতে হবে ৩৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের টাকায় সেতুতে রেল চলাচলের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেতুর পাশে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন বসানোর জন্য যে ভিত্তি তৈরি হয়েছে, তাও পদ্মা সেতু প্রকল্পের টাকায়। রেল চলাচলের জন্য বছরে টোল ধার্য করা হবে। তবে এখনো টোলের পরিমাণ ঠিক হয়নি। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইনের জন্য কত টোল পাওয়া যাবে, তাও চূড়ান্ত হয়নি।
সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, চুক্তি অনুসারে প্রথম বছরই সেতু বিভাগকে ৬০০ কোটি টাকা কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। এই সময়ে টোল থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। আয় থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। টোল আদায়ের জন্য ঠিকাদারের পেছনে বছরে ব্যয় হবে ১০০ কোটি টাকার বেশি। ফলে শুরুতে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হবে।
গত ৭ এপ্রিল সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের বলেছিলেন, পদ্মা সেতু থেকে পূর্ণমাত্রায় টোল আদায় করা হবে। শুধু টোল আদায় হবে না, এ সেতু থেকে মুনাফাও হবে। এ প্রকল্পের জন্য যে পরিমাণ খরচ হয়েছে, তার চেয়ে বেশি অর্জন করা হবে। সারা বিশ্ব তাই করে।
তবে টোলের পরিমাণ এখনো নির্ধারিত হয়নি বলে জানান অর্থমন্ত্রী। বলেন, ‘আমরা একটা কথা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই যে সারা বিশ্বে এ ধরনের প্রকল্প টোলভিত্তিকই করা হয়। টোল আদায় না হলে এগোনো যাবে না। কারণ, সেতু সংরক্ষণ করতে হবে। আবার একটা প্রকল্প থেকে আরেকটা প্রকল্প করতে হবে। একটা সেতু থেকে আরেকটা সেতু করতে হবে। এ জন্য রাজস্বের দরকার হবে।’
সড়কেও টোল লাগবে :
পদ্মা সেতুর বাইরে ঢাকার পোস্তগোলা বা বাবুবাজার থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে (ছয় লেনের দ্রুতগতির সড়ক) ব্যবহারের জন্যও টোল দিতে হবে। আগামী জুলাই থেকে টোল চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই সড়কের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর।
পরিকল্পনা অনুযায়ী এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারের জন্য একটি বাসে প্রতি কিলোমিটারে ৯ টাকা হারে টোল দিতে হবে। মাঝারি একটি ট্রাকের টোল হবে প্রতি কিলোমিটারে ১০ টাকা। বর্তমানে এই পথে তিনটি সেতুর জন্য একটি বড় বাসে গড়ে ২০০ টাকা টোল দিতে হয়।
সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিদেশি অর্থায়নে সেতু নির্মাণ করা হলে কত টাকা টোল ধার্য করা উচিত, সে বিষয়ে দাতাদের শর্ত বা পরামর্শ থাকে। কিন্তু দেশীয় অর্থায়নে নির্মিত সেতুর ক্ষেত্রে এ রকম কোনো নীতিমালা নেই। সাধারণত সেতু হওয়ার আগে ফেরিতে যে হারে টোল নেওয়া হয়, সেতুতেও সেই হারে টোল নির্ধারণ করে থাকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।
বঙ্গবন্ধু সেতুর চেয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণে খরচ বেশি। আবার এর দৈর্ঘ্যও বেশি। এ কারণে পদ্মা সেতুতে টোল বেশি হবে। পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। বঙ্গবন্ধু সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় ৫ কিলোমিটার। বঙ্গবন্ধু সেতুতে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। আর পদ্মা সেতু তৈরিতে সর্বশেষ হিসাব পর্যন্ত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হয়। এখন সেতুটি পারাপারে বড় বাসকে ৯০০, ছোট বাসকে ৬৫০, বড় ট্রাককে ১ হাজার ৪০০, মাঝারি ট্রাককে ১ হাজার ১০০ এবং ছোট ট্রাককে ৮৫০ টাকা হারে টোল দিতে হয়। প্রাইভেট কারের টোল ৫০০ টাকা।
পদ্মা সেতুর প্রস্তাবিত টোলহার চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হয়েছে। সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত বৃহস্পতিবার সেতু ভবনে গিয়ে প্রস্তাবিত টোলহারের সারসংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠান। অনুমোদন হলে, তা প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হবে।
সড়ক পরিবহণ সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, পদ্মা সেতুর জন্য প্রস্তাবিত টোলের হার আমাদের কাছে অনেক বেশি মনে হয়েছে। সেতু ও সড়ক ব্যবহারে পৃথক পৃথক টোল দিতে হলে যানবাহনের ভাড়া বাড়বে। এতে যাত্রী ভোগান্তি হবে। টোল যদি কম হয় তাহলে বেশি যানবাহন চলাচল করবে, আয়ও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।