logo
আপডেট : ১৬ মে, ২০২২ ১১:৩৬
পুঁজিবাজার থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার চলছেই
চার কারণে পুঁজিবাজার ছাড়ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা
মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ

চার কারণে পুঁজিবাজার ছাড়ছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা

পুঁজিবাজারে স্মরণকালের বড় ধস হয় ২০১০ সালে। তখন পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হয় লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। ভালো-মন্দ সব ধরনের কোম্পানির শেয়ারদর তলানিতে নেমে যায়। এরপর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি পুঁজিবাজার। কয়েকবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও তা দীর্ঘমেয়াদি হয়নি। ধসের এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এখনই পরিস্থিতি বদলায়নি। এখনও থেমে থেমে বড় পতন ভাবাচ্ছেন বিনিয়োগকারীদের। ফলে বাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন সব ধরনের বিনিয়োগকারী। বাদ যায়নি বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও। ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন তারা। মূলত চার কারণে তারা বাজার ছেড়ে যাচ্ছেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, নানাবিধ কারণে বিদেশিরা পুঁজিবাজার ছেড়ে যাচ্ছেন। তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ চারটি। প্রথমত দীর্ঘদিন থেকে দেশের পুঁজিবাজারে অস্থিরা চলছে। অর্থাৎ স্থিতিশীলতার অভাব রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এই ধরনের বাজার পরিস্থিতিতে বিদেশিরা সর্তক অবস্থায় থাকেন। পুঁজির নিরাপত্তা রক্ষায় তারা বিনয়োগ তুলে নেন।

দ্বিতীয়ত, সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের পুঁজিবাজারে এখনও ভালোমানের কোম্পানির অভাব রয়েছে। বিদেশিরা সব সময় ভালোমানের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করতে ভালোবাসে। দেশে এ ধরনের কোম্পানির সংখ্যা কম। যেগুলো রয়েছে তার সিংহভাগের লভ্যাংশ দেয়ার হার আগের চেয়ে কমেছে। ফলে এসব কোম্পানি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন বিদেশিরা। অন্য একটি কারণ হচ্ছে পুঁজিবাজার নিয়ে ঘনঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন। ঘন ঘন সিদ্ধান্ত বদল হলে বিনিয়োগকারীদের অনেক সময় সিদ্ধান্ত বদল করতে হয়। বিদেশিরা এটা পছন্দ করেন না। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং শ্রীলঙ্কা ইস্যুতেও বিদেশিরা বাজার ছাড়ছেন।

জানতে চাইলে পুঁজিবাজার অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বিভিন্ন কারণে বিদেশিরা বিনিয়োগ তুলে নেন। ঘন ঘন আইন-কানুন পরিবর্তন করাটা বিদেশিদের অপছন্দ। এমন হলে তাদের বাজার ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করলে প্রয়োজনের সময় সেটি ফেরত নিতে পারবেন কিনা সেটি নিয়ে শঙ্কা কাজ করে বিদেশিদের মধ্যে। এ কারণেও অনেকে বাজার ছেড়ে দেন। একইভাবে তাদের ধরে রাখতে হলে বাজার ভালোমানের কোম্পানির সংখ্যা বাড়াতে হবে।

একই বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি মার্চেন্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ধরে রাখার জন্য সবার আগে বাজারের পরিবেশ ঠিক করা দরকার। বিএসইসি চেষ্টা করলেও আমাদের বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না। ফলে বাজার বিমুখ হচ্ছেন বিদেশিরা। তাই সবার আগে বাজারের পরিবেশ ঠিক করা দরকার।

সাম্প্রতিক বাজারচিত্রে দেখা যায়, তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানি থেকে বিনিয়োগ তুলে নিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। তালিকায় রয়েছে বড় বড় বাজার মূলধনধারি কোম্পানির পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানিও। প্রতিনিয়ত যার প্রভাব পড়ছে পুঁজিবাজারে। কারণ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করলে সব সময়ই সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।

প্রাপ্ততথ্য মতে, সম্প্রতি আইপিডিসি থেকে বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন বিদেশিরা। শূন্য দশমিক শূন্য সাত শতাংশ থেকে বিনিয়োগ নেমে এসেছে শূন্য দশমিক শূন্য পাঁচ শতাংশ। একইভাবে বহুজাতিক কোম্পানি ম্যারিকো থেকে বছরের ব্যবধানে এক শতাংশের বেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার হয়েছে। পূর্বে এই প্রতিষ্ঠানটিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ ছিল তিন দশমিক ৩৫ শতাংশ। বর্তমানে যার পরিমাণ দুই দশমিক ৩৩ শতাংশ। একইভাবে ওরিয়ন ইনফিউশন থেকে বিদেশি বিনিয়োগ শূন্য দশমিক ২৬ শতাংশ থেকে শূন্য দশমিক ২০ শতাংশতে নেমে এসেছে। একইভাবে বহুজাতিক কোম্পানি রেকিট বেনকিজার থেকেও প্রত্যাহার হয়েছে বিদেশি বিনিয়োগ। কোম্পানিটিতে বিদেশি বিনিয়োগ দুই দশমিক ৯৪ শতাংশ থেকে দুই দশমিক ৯১ শতাংশে নেমে এসেছে। এদিকে তালিকাভুক্ত ওষুধ খাতের আলোচিত কোম্পানি বেক্সিমকোফার্মার শেয়ারও ছেড়ে দিয়েছেন বিদেশিরা। ২৯ দশমিক ৪০ শতাংশ থেকে সর্বশেষ তা ২৯ দশমিক ১৯ শতাংশে নেমে এসেছে। একইভাবে এসিআই ফরমুলেশনে এই সময়ে বিদেশিদের শেয়ার ধারণের পরিমাণ ছিল ২৭ দশমিক ১১ শতাংশ। বর্তমানে তা নেমে এসেছে ২৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে।

অন্যদিকে বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকোর শেয়ারও ছাড়তে দেখা গেছে বিদেশিদের। সর্বশেষ মার্চের পর তাদের শেয়ার ধারণের পরিমাণ সাত দশমিক ৯৪ শতাংশ থেকে সাত দশমিক ৮৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এ সময়ে টেলিযোগাযোগ খাতের কোম্পানি গ্রামীণ ফোনের শেয়ার ধারণ দুই দশমিক ৯৬ শতাংশ থেকে দুই দশমিক ৮৬ শতাংশে নেমে এসেছে। একইভাবে তালিকাভুক্ত আরো অনেক কোম্পানি থেকে বিদেশি বিনিয়োগ তুলে নিয়েছেন তারা। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীও প্রতিনিয়ত এসব কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে দিচ্ছে।

এদিকে মার্চ শেষে এক্সিম ব্যাংকের শেয়ার ছেড়ে দিয়েছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। তাদের বিনিয়োগ এক দশমিক ২১ শতাংশ থেকে এক দশমিক ১৮ শতাংশে নেমে গেছে। এই সময়ে ফাস্ট সিকিউরিটিজ ইসলামি ব্যাংকের বিদেশি বিনিয়োগ এক দশমিক ৮৪ শতাংশ থেকে এক দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমে এসেছে। একইভাবে ব্যাংকখাতের কোম্পানি ব্র্যাক ব্যাংকে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ৩৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। সর্বশেষে তা ৩৭ দশমিক ৩৭ শতাংশে নেমে এসেছে। কমেছে সিটি ব্যাংকের বিদেশিদের শেয়ারধারণ। তিন দশমিক ৫৩ শতাংশ থেকে তিন দশমিক ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত চার বছর ধরে বিদেশিদের বিনিয়োগ ধারাবাহিকভাবে কমছে। তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশিদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এর পরের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এটি কমে ১৭ কোটি ১০ লাখ ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পুঁজিবাজারে বিদেশিদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ আরো কমে দাঁড়ায় মাত্র ৪ কোটি ৪০ লাখ ডলারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগ ঋণাত্মক ২৬ কোটি ৯০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশিদের নিট পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৯ কোটি ২০ লাখ ডলারে।

এদিকে বিনিয়োগ তুলে নেয়া ভিন্নমত জানান বিএসইসি কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসইসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, গত দুই বছরে পুঁজিবাজারের সূচক বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিদেশিরা শেয়ার বিক্রি করে মূলধনি মুনাফা তুলে নিয়েছেন। সম্প্রতি পুঁজিবাজারে দর সংশোধন হওয়ার কারণে বিদেশিদের মধ্যে শেয়ার কেনার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

অন্যদিকে পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করছে বিএসইসি। এজন্য গত এক বছরে সংযুক্ত আরব-আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যে রোড শো আয়োজন করেছে সংস্থাটি। সামনে বিনিয়োগ আকর্ষণে কাতার ও সৌদি আরবে রোড শো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যাতে সহজেই নিটা অ্যাকাউন্ট, ব্যাংক হিসাব ও বিও হিসাব খুলতে পারেন, সেজন্যও উদ্যোগ নিয়েছে কমিশন।