logo
আপডেট : ১৬ মে, ২০২২ ১১:৩৭
ইউক্রেন যুদ্ধোত্তর ‘বিশ্বব্যবস্থা’ পরিকল্পনা এখনই
নিজস্ব প্রতিবেদক

ইউক্রেন যুদ্ধোত্তর ‘বিশ্বব্যবস্থা’ পরিকল্পনা এখনই

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই প্রত্যাবর্তনের একটি চূড়ান্ত পথ খুঁজে বের করতে হবে। এমন একদিন আসবে যেদিন ক্লান্ত, আঘাতপ্রাপ্ত রাশিয়া তার খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসবে

ইউক্রেনে যুদ্ধ তুঙ্গে। এই অবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ন্যাটো অংশীদারদের আগের মতো একই ধরনের চিন্তাপ্রসূত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। পশ্চিমা নেতারা হয়তো এখনো জানেন না যে, কীভাবে অথবা কখন এ ভয়াবহ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে। তবে তারা নিরাপত্তা, সমৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলা, গণতন্ত্রের মতো বাধা-বিপত্তিগুলো সম্পর্কে আঁচ করতে পারেন এবং এ কারণেই তাদের উচিত হবে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করা, যদিও লড়াই এখনো চলছে।
রাশিয়ার আক্রমণকে রুখে দিয়ে ইউক্রেন শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিজয় উদযাপন করবে। কিন্তু এর জন্য লম্বা সময় লাগবে। হতে পারে সেটা কয়েক বছর কিংবা কয়েক দশক। আমরা খুব শিগগিরি কোনো শান্তি চুক্তির লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ শেষে যুদ্ধবিরতি-সীমান্ত চুক্তির মাধ্যমে ইউক্রেন একটি আংশিকভাবে বিভক্ত দেশও হয়ে উঠতে পারে।


এই অচলাবস্থা এবং বিভক্তি অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও নির্মম হবে। কাজেই ইউক্রেনীয়রা যদি পরবর্তী কয়েক বছরের জন্য এখনই পরিকল্পনা হাতে নেয়, সে ক্ষেত্রে তারা দক্ষিণ কোরিয়া এবং পশ্চিম জার্মানির দৃষ্টান্তগুলো বিবেচনায় নিতে পারে। অসমাপ্ত যুদ্ধের ছায়া এবং স্বৈরাচারী প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করেও দেশ দুটি গণতন্ত্রের প্রশ্নে অবিস্মরণীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
কঠোর প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের সঙ্গে সঙ্গে কৌশলগত ধৈর্য ইউক্রেনের জন্য কার্যকরী অস্ত্র হতে পারে। পশ্চিমাদের উচিত হবে স্পষ্ট করে বলা যে, তারা রাশিয়ার দখলকৃত কোনো অঞ্চলের সার্বভৌমত্বের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মেনে নেবে না। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহুকাল ধরে বাল্টিক রাষ্ট্রগুলোর ওপর সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে আসছে। শেষ পর্যন্ত, এটা ঠিক বলেই প্রমাণিত হবে।


উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইউক্রেন এবং তার ন্যাটো মিত্রদের উচিত হবে দক্ষিণ-পূর্ব ইউক্রেনে রুশ আক্রমণকে প্রতিহত করতে মনোনিবেশ করা। যথাসম্ভব পুতিন বাহিনীকে কোণঠাসা করা এবং চলমান যুদ্ধকে অনির্দিষ্টকালের জন্য চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়ার পক্ষে অতিমাত্রায় অসহনীয় ও কঠিন করে তোলা। সাম্প্রতিক মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদন মতে, এটি একটি অর্জনযোগ্য লক্ষ্য। তবে এ ক্ষেত্রে ইউক্রেন এবং তার মিত্র দেশগুলোকে বেশ চড়া মূল্য চোকাতে হবে।
মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক এভ্রিল হেইনস এ বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট দিক তুলে ধরেছেন। তিনি তার ব্যাখ্যায় বলেছেন, ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধ একটি ‘ক্ষয়মূলক-বিধ্বংসী’ যুদ্ধে পরিণত হয়ে উঠছে দিনদিন। পুতিন কিয়েভকে পুরোপুরি কবজা করে আধিপত্য বিস্তারের আশায় আছেন। তাছাড়া কৃষ্ণ সাগর উপকূলজুড়ে নিয়ন্ত্রণ বলয় গড়তে চান তিনি। তবে এসব লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে তাকে বেশ সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পুতিন সামরিক শক্তির স্বল্পতার মুখোমুখি হচ্ছেন। অর্থাৎ, উচ্চাকাক্সক্ষা এবং সামর্থ্যের মধ্যে এই ‘ফারাক’ পুতিনকে অপ্রত্যাশিতভাবে নতুন নতুন দিকে পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।


পুতিনের ‘অপরিণামদর্শী’ আক্রমণের কারণে ইউরোপের দেশগুলো বাধাহীনভাবে পুতিনের বিপক্ষে চলে যাচ্ছে। ফিনল্যান্ড ন্যাটোতে যোগদানের জন্য আবেদন করেছে। সম্ভবত এ দেশটিও সুইডেনের পথেই হাঁটবে। রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই ন্যাটো সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে ‘প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি দিমিত্রি মেদভেদেভ হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, রাশিয়ার ওপর সামরিক চাপ শেষ পর্যন্ত ‘পূর্ণমাত্রার পরমাণু যুদ্ধ’ ডেকে আনবে।

পুতিন কিয়েভকে পুরোপুরি কবজা করে আধিপত্য বিস্তারের আশায় আছেন। তাছাড়া কৃষ্ণ সাগর উপকূলজুড়ে নিয়ন্ত্রণ বলয় গড়তে চান তিনি। তবে এসব লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে তাকে বেশ সমস্যা পোহাতে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পুতিন সামরিক শক্তির স্বল্পতার মুখোমুখি হচ্ছেন। অর্থাৎ, উচ্চাকাক্সক্ষা এবং সামর্থ্যের মধ্যে এই ‘ফারাক’ পুতিনকে অপ্রত্যাশিতভাবে নতুন নতুন দিকে পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে


এটা বেশ ভয়ের কথা। মেদভেদেভের এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণের মধ্য দিয়ে মার্কিন উদ্বেগ সম্পর্কে হেইনসের বক্তব্যের মিল পাওয়া যাচ্ছে-‘আমরা বিশ্বাস করি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের ইউক্রেনকে সাহায্য করা থেকে নিবৃত্ত করতে মস্কো প্রাণঘাতী পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করার মতো বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্য চালিয়ে যাবে’। হেইনস বলেছেন, মস্কো আইসিবিএম, সাবমেরিন এবং বোমারু বিমানের আক্রমণের পাশাপাশি পারমাণবিক অনুশীলনের ব্যবহার বাড়ানোর চিন্তা করতে পারে।
হেইনস বলেন, “ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনকে ন্যাটো সদস্যপদ লাভের উপায় হিসেবে ব্রিটেন একটি ‘প্রতিরক্ষা চুক্তি’র প্রস্তাব দিচ্ছে। এ বিষয়ে আমি ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা সচিব বেন ওয়ালেসকে কিছু প্রশ্ন করি। আমি তার কাছে জানতে চাই-এটি দেশ দুটির জন্য ‘পারমাণবিক ছাতা’ কি না? আমার প্রশ্নের উত্তরে ওয়ালেসের উত্তর ছিল-‘না’।”
যুদ্ধ চলছে। এমন অবস্থার মধ্যেই ইউক্রেনে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ‘ইউনাইটেড-২৪’ নামে একটি অনলাইন খসড়া প্রকাশ করেছেন। পশ্চিমা দেশগুলোর উচিত হবে খসড়ায় উত্থাপিত অনুরোধগুলো পূরণের অঙ্গীকার করা।


এই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব-নিকাশ হবে অত্যন্ত গুরুত্ববহ। ইউক্রেনের একজন কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছেন, কিয়েভ স্কুল অব ইকোনমিক্স অনুমান করছে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৫০০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাবে। অবশ্য ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এবং অন্যান্য বৈশ্বিক সংস্থা ইতিমধ্যেই বিলিয়ন বিলিয়ন মানবিক সহায়তা নিয়ে ইউক্রেনবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছে।
এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়াতে শেষ পর্যন্ত রাশিয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এটা এখনকার পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক ও স্ববিরোধী মনে হতে পারে। তাছাড়া এটা খুব শিগ্গিরই ঘটবে না। সম্প্রতি রাশিয়া ছেড়ে আসা আলেকজান্ডার গাবুয়েভ নামক মস্কোর কার্নেগি সেন্টারের একজন সিনিয়র বিশ্লেষক আমাকে বলেছেন, রাশিয়ার একটি বড় সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভøাদিমির পুতিনের যুদ্ধকে সমর্থন করে। রাশিয়া দুঃখজনকভাবে ইরানের পথ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে। রুশরা একটি বহিষ্কৃত, অনোনুমোদিত এবং বিচ্ছিন্ন জাতিতে পরিণত হচ্ছে। তবে চিরকাল এভাবে থাকবে না। গাবুয়েভের যুক্তি ছিল-এক সময় এটা একটি ‘অগ্নিস্ফুলিঙ্গ’ হয়ে সামনে আসবে।


২০০২ সালে রোমে রাশিয়ার সঙ্গে ন্যাটোর শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন প্রাক্তন ন্যাটো মহাসচিব জর্জ রবার্টসন। আমি তার কাছ থেকে সেসময় করা পুতিনের একটি মন্তব্য সম্পর্কে জানতে পেরেছি। স্নায়ুযুদ্ধে রাশিয়ার দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতার কথা স্মরণ করে পুতিন সেসময় মন্তব্য করেছিলেন, ‘এই সংঘর্ষ আমাদের কিংবা বিশ্বের বাকি রাষ্ট্রগুলোর কারো জন্যই ভালো কিছু বয়ে আনেনি। আমরা এর দ্বারা কিছুই লাভ করিনি।’


ইউক্রেনে যুদ্ধ চলমান থাকা অবস্থাতেও আমি আশা করি, প্রেসিডেন্ট বাইডেন এই বার্তাটিরই পুনরাবৃত্তি করবেন-‘রাশিয়ার জনগণ আমাদের শত্রু নয়।’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই প্রত্যাবর্তনের একটি চূড়ান্ত পথ খুঁজে বের করতে হবে। এমন একদিন আসবে যেদিন ক্লান্ত, আঘাতপ্রাপ্ত রাশিয়া তার খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসবে।

লেখক: মার্কিন সাংবাদিক
দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ভাষান্তর: সুমৃৎ খান সুজন