বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির চাপ প্রায় সব দেশে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে খাদ্য উৎপাদন হলেও বৈশ্বিক মন্দার চাপে বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। সরকার বাজার পরিস্থিতি নানাভাবে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। প্রতিদিনই বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম।
দেশের ১৬ কোটি মানুষের চাহিদার বেশি খাদ্য উৎপাদন হলেও কমবেশি প্রায় সব পণ্যই আমদানি করতে হয়। বাজারে যাতে অস্থিরতা সৃষ্টি না হয় সে কথা বিবেচনা করেই সরকার খাদ্যপণ্য আমদানি করে থাকে। এর ফলে খাদ্য নিয়ে অস্থিরতা থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু তারপরও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বৈশ্বিক সরবারহে বিঘ্ন ঘটলে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। চলতি অর্থবছর থেকেই করোনার প্রকোপ কমে আসার প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হয়। এ সময়ে উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা বেড়ে যাওয়া ও সরবারহে বিঘ্ন ঘটার কারণে সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মূল্যস্ফীতিকে আরো উস্কে দিয়েছে। এর ফলে আমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়ে বাজার পরিস্থিতি মোটামুটি নাগালের মধ্যে রাখলেও মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেছে। সরকার, অর্থনীতিবিদ ও বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়েছে কিন্তু আন্তর্জাতিক উৎপাদন, সরবারহ ও মূল্যস্ফীতির অবস্থা বিবেচনা করলে দেশের বাজার এখনো ভালো।
মূল্যস্ফীতির ফলে দেশে নিত্যপণ্যের দাম যে হারে বেড়েছে প্রতিবেশী দেশ ও বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশগুলোতে তার দ্বিগুণ হারে বেড়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, এসব দেশে যে হারে পণ্যের দাম বেড়েছে বাংলাদেশে তার চেয়ে কম হারে বেড়েছে। ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ারর মতো দেশগুলোতে গত ১০ মাসেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে প্রায় ৬ শতাংশ। বাংলাদেশে একই সময়ে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ থেকে আড়াই শতাংশ। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চায়ন (রিজার্ভ) থেকে ডলার বিক্রি করে টাকার মান শক্তিশালী করে রাখার মধ্য দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। সেই সঙ্গে রেমিট্যান্স প্রবাহ ইতিবাচক ধারাতে থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করছে, যা টাকার মান ধরে রাখতে সহায়তা করছে। ডলার বিক্রি করে টাকার মান ধরে রাখার চেষ্টা যদিও দীর্ঘ সময়ের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
খাদ্য আমদানি করে সরবরাহ ঠিক রাখার ক্ষেত্রে আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য এখনো যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও রয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর ড. ফজলে কবীর বলেন, টাকার মান ধরে রাখার ক্ষেত্রে যে ডলারের প্রয়োজন তা বেশ ভাল অবস্থানে আছে। সর্বশেষ এপ্রিলের এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন-আকুর বিল পরিশোধ করার পরও ৪২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ রয়েছে। যা দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির:
ভোজ্যতেলের চাহিদার তিন-চতুর্থাংশ আমদানি করতে হয়। দেশের চাহিদা ১৯ থেকে ২০ লাখ টন। দেশে উৎপাদন হয় ৫ লাখ টনের মতো। চাহিদার বাকি ভোজ্যতেল বিশে^র বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। করোনা-পরবর্তী পুনরুদ্ধার কার্যক্রম শুরু হলে সরবারহ ঘাটতির কারণে এমনিতেই ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যায়। তার ওপর পড়ে মূল্যস্ফীতির ঘা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ভোজ্যতেল বাণিজ্যের ম্যাপ বদলে যায়। এর ফলে দেশে তেলের দাম বেড়ে যায়। আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার, এলসি খোলার ক্ষেত্রে সুবিধা প্রদান ও সরকারি ব্যবস্থাপনায় ট্রেডিং করপোরেশনের মাধ্যমে তেল বিক্রির উদ্যোগ নেয়। তারপরও তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে যায়। দাম বেড়ে বাজারে প্রতি লিটার তেল বিক্রি হচ্ছে ১৯৮ টাকা। ভোজ্যতেলের চাহিদার তুলনায় যতটা স্বল্পতা আছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা মজুত করে তেলের বাজার তার চেয়ে বেশি অস্থির করে তুলছে।
গম:
গম হলো দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানিনির্ভর খাদ্যপণ্য। দেশে ৫০ লাখ মেট্রিক টন গমের চাহিদার বিপরীতে ১০ থেকে ১১ লাখ মেট্রিক টন গম উৎপাদন হয়। ৪০ থেকে ৪২ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। বাংলাদেশ প্রধানত রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করে থাকে। এর বাইরে ভারত ও কানাডা থেকে স্বল্প পরিমাণে গম আমদানি করে থাকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ভারত থেকে গম আমদানি বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ভারত গত শুক্রবার গম রপ্তানি বন্ধ ঘোষণা করলে খাদ্য সংকটের আভাস দেওয়া হয়। কিন্তু পরের দিনই ভারতের খাদ্য মন্ত্রী প্রতিবেশী ও ভঙ্গুর দেশগুলোতে গম রপ্তানি করবে বলে ঘোষণা দেওয়ার পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকার আশা করছে বাংলাদেশর গম আমদানি কারকরা।
পেঁয়াজ:
পেঁয়াজের চাহিদা প্রায় ৩৬ লাখ টন। দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ৩০ থেকে ৩২ লাখ টন। দেশেই ৯০ ভাগ পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। ১০ শতাংশের নিচে আমদানি নির্ভরতার সুযোগ নিয়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করা হয়। বিশেষ করে রপ্তানিকারক দেশগুলো যখন রপ্তানি বন্ধ করে দেয় তখন দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধি পায়। এবার পেঁয়াজের মৌসুম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেশে পেঁয়াজের দামে টান পড়েছে। গত এক সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১২ টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। চাহিদার তুলনায় বেশি পেঁয়াজ মজুত আছে। পেঁয়াজ রপ্তানিকারক দেশগুলোও রপ্তানি করছে। রপ্তানিকারক দেশগুলোর দ্বার খোলা আছে। প্রয়োজন হলে একাধিক দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা যাবে।
চাল:
চাল বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য এবং চাহিদার তুলনায় বেশি চাল দেশেই উৎপাদিত হয়। দেশে চালের চাহিদা ৩ কোটি টনের নিচে। দেশে শুধু চাল উৎপাদন হয় সাড়ে ৩ কোটি টন। এবার উৎপাদন হবে ৩ কোটি ৬৩ লাখ টন। এর বাইরে গম, ভুট্টাসহ অন্যান্য দানাদার খাদ্য উৎপাদন হয়। কিন্তু কোনো দুর্যোগের আভাস পেলেই চালের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালের হাওরে আগাম বন্যায় দুই লাখ মেট্রিক টন ধান নষ্ট হয়। আমদানি করা হয় ১১ লাখ মেট্রিক টন। তারপরও হাওরে ধান নষ্টের অজুহাত তুলে দেশজুড়ে চালের দাম বৃদ্ধি করা হয়। সরকার বাধ্য হয়ে চাল আমদানির ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনে। এবারো হাওরাঞ্চলে বন্যায় ধান উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবার ২০১৭ সালের নষ্ট ধানের এক-চতুর্থাংশেরও কম ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে অসাধু ব্যবসায়ীরা হাওরে বন্যার অজুহাত তুলে চালের দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা করছে। বাজারে চালের দাম ধরনভেদে ৫৫ থেকে ৭০ টাকা। সরকার কঠোর না হলে এবারো চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াতে পারে বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা আভাস দিয়েছে।
বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনিক ব্যবস্থা
নিত্যপণ্যের সরবারহ ঘাটতিজনিত কারণে মূল্যবৃদ্ধি শুরু হলেই অসাধু ব্যবসায়ী মজুদদারি করে বাজারকে আরো অস্থির করে তুলে। এবারো তেলের অবশিষ্ট শুল্ক প্রত্যাহার করে নেওয়ার পরও রপ্তানিকারক দেশগুলোর দিক থেকে সমস্যা ও আমদানিমূল্য বেড়ে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে তেলের দাম বৃদ্ধির আব্দার শুরু করে। বাজার পর্যবেক্ষণে সময় নেয় সরকার। এরই মধ্যে তেলের মজুত করে বাজার অস্থির করে তোলে পরিবেশক ও সরবারহকারীরা। সরকার অভিযান চালিয়ে অবৈধ মজুত করা তেল উদ্ধার করে। সারা দেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে। ২০১৮ সালের পর বেশ কয়েকবার চাল ও পেঁয়াজের অবৈধ মজুত উদ্ধার করে পুলিশ।
নিত্যপণ্যের দাম একবার বাড়লে তা আর কমে না। আর নিত্যপণের দাম বৃদ্ধি পাওয়া মানে মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। এজন্য সরকার আগে থেকেই নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে বলে মনে করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস-এর গবেষণা পরিচালক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, আমদানিনির্ভর পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি-কমাতে সরকারের হাত থাকে না। এটা নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্য বেড়ে যাওয়া ও টাকার বিপরীতে ডলার স্ট্রং হয়ে যাওয়ার ওপরে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে পণ্য কিনতে গেলেই বেশি দামে কিনতে হয়। দেশের ভেতরে চাহিদা অনুযায়ী সরবারহের ঘাটতি থাকলে সরকার টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করে মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। এবারো করছে।
তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধে আমরা পর্যাপ্ত রিজার্ভের সুবিধা নিচ্ছি। এক বছরের কম সময়ে আমরা প্রায় সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে ভূমিকা রেখেছি। পর্যাপ্ত রিজার্ভ ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। এটাই পর্যাপ্ত রিজার্ভের মাহাত্ম্য। আমাদের যথেষ্ট রিজার্ভ থাকার কারণে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে টাকার মান ধরে রেখেছি। ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়াতে যে হারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে বাংলাদেশে তার অর্ধেক বেড়েছে। এ কারণে আন্তর্জাাতিক বাজারে যে হারে পণ্যের দাম বেড়েছে আমাদের দেশে সে হারে বাড়েনি।