logo
আপডেট : ১৭ মে, ২০২২ ১১:১৫
দৃষ্টিজুড়ে
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রনই বড় চ্যালেঞ্জ
নিজস্ব প্রতিবেদক

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রনই বড় চ্যালেঞ্জ

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চিত্রটা দিন দিন যেন নিয়মে পরিনত হচ্ছে। ব্যাপারটা এমন মনে হয় যেন- দিন গেলে তো জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই

করোনাভাইরাসের কারণে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে দৈন্যদশা নেমে এসেছে বিগত দু বছর ধরে। জীবন-জীবিকার শঙ্কার যেন শেষ ছিল না। মানুষজন বর্তমানে করোনার শঙ্কা কাটিয়ে উঠে যখন হামাগুড়ি দিয়ে নতুন করে কর্মসংস্থান ও জীবন-জীবিকার কথা ভাবছে, তখন নতুন বিপদের মোকাবেলা করা যেন গোদের উপর বিষের ফোঁড়া! আর এই নতুন বিপদটা হলো- দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এমনিতেই অনেকে হারিয়েছেন কর্মসংস্থান, কাজের খোঁজে দিশেহারা। পরিবার-পরিজন নিয়ে আবার নতুন করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা অনেকটা বড় চ্যালেঞ্জ। এত শঙ্কার মাঝেই নতুন করে বড় শঙ্কা নিত্য পণ্যদ্রব্য মূল্যের লাগামহীন দাম। নাভিশ্বাস আজ নিম্নমধ্যবিত্তের! এর আগেও আমরা অনেক কান্ড দেখেছি। যেমন, লবণ কান্ড, তরমুজ কান্ড, পেয়াজ কান্ড, তারপর তেল কান্ড! কতসব কান্ডে যে সাধারণ মানুষ লন্ডভন্ড তার ইয়ত্তা নেই! দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধিতে অসাধুরা যেসব অবান্তর যুক্তি দেখিয়েছেন তা অবাক করার মতো!


দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চিত্রটা দিন দিন যেন নিয়মে পরিনত হচ্ছে। ব্যাপারটা এমন মনে হয় যেন- দিন গেলে তো জিনিসপত্রের দাম বাড়বেই। সামগ্রিক কারণে কিছু নিত্যপণ্যের দাম উঠা-নামা হতে পারে কিন্তু এটাকে কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের জিম্মি করছে। পণ্যের অবৈধ মজুদ রেখে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে হাতিয়ে নিচ্ছে ভোক্তার টাকা। এতে করে অসাধু ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে আর বিপদে, শঙ্কায় পড়ছে ভোক্তারা। সম্প্রতিক সময়ে নিত্যপণ্যের দাম পাগলা ঘোড়ার মত ছুটছেই।

নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে বিশেষ নজরদারী রেখে সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে তা দ্রুত সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। যেহেতু সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে নাগরিকের ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা একটা বড় বিষয়, সেহেতু এটা নিশ্চিতে বড় পরিসরে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মাধ্যমে নাগরিক সেবা দিতে হবে। সর্বোপরি, সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষনে সচেতন হতে হবে


দাম বৃদ্ধিও কারসাজিতে অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম আরো বেড়ে গেছে। ব্যবসায়ি সিন্ডিকেটের কৌশলগত কারণে বাজারে ভোজ্য তেলের মারাত্মকভাবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সংকট সৃষ্টি করে নির্ধারিত দামের চেয়েও অধিকহারে দাম নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। সরকারপক্ষ বলছে, ভোজ্যতেলের কোন ঘাটতি না থাকলেও ডিলারদের কারসাজিতে বাজারে সয়াবিন তেলের ‘কৃত্রিম সংকট’ তৈরি হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন, তেলের এত তেলেসমাতি কেন?
সম্প্রতি বেসরকারি ভোক্তা অধিকার সংগঠন ‘কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি’ (সিসিএস) জানিয়েছে, ভোক্তা সাধারণকে জিম্মি করে ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টিকারীদের আইনের আওতায় আনা হোক। সূত্রমতে, বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। নিজস্ব জোগান বাদ দিয়ে ১৮ লাখ টন তেল আমদানি করতে হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে ১৮ লাখ টনের বেশি তেল আমদানি করা হয়েছে। ফলে দেশে তেলের কোনো সংকট নেই। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের তদারকির ফলে মিল থেকেও তেল সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত মুনাফার লোভে ডিলার ও খুচরা পর্যায়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার অস্থিতিশীল করেছে। একই সঙ্গে সরকারকেও বেকায়দায় ফেলেছে। ফলে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া এখন সময়ের দাবি।


তেলের সংকট সৃষ্টির মতো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পণ্য নিয়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি ও সিন্ডিকেট করে বাজার অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যতসামান্য জরিমানার মতো লঘুদ- দেওয়ায় তাদের অনৈতিক কর্মকান্ডের দৌরাত্ম বন্ধ হচ্ছে না। উপরন্তু ভোক্তাকে জিম্মি করার এই করুন চিত্র তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি এখন খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাও ভোজ্যতেল লুকিয়ে রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির করে ভোক্তাদের সাথে প্রতারণা করছে। এসব অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এখন সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। এদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে সাজা লঘুদন্ডের পাশাপাশি কঠোর প্রচলিত আইনের প্রয়োগ করতে হবে। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের কঠোর প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। এ আইনে মজুদদারি নিষিদ্ধ করে এই অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এই আইনের ২(ঙ) ধারায় মজুদদারির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘মজুদদারি বলতে বোঝায়, কোনও আইন দ্বারা বা আইনের আওতায় কোনও ব্যক্তি মজুদ বা গুদামজাত করার সর্বোচ্চ পরিমাণের বেশি দ্রব্য মজুদ বা সংরক্ষণ করা।’


এ আইনের ২৫(১) ধারার বিধানে শাস্তির কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘কেউ মজুদদারি বা কালোবাজারে লেনদেনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তার আজীবন কারাদ- বা চৌদ্দ বছরের কারাদ- হতে পারে। যদি প্রমাণ হয় যে, মজুদদার কোনও লাভের জন্য পণ্য মজুদ করেনি, তাহলে ৩ মাসের কারাদ-ে দ-িত হতে হবে’। ইতিমধ্যে সেবা সীমিতকরণ বা নিয়ন্ত্রণের অভিযোগে দেশের ভোজ্যতেল আমদানিকারক আট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। বিভিন্নভাবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।


বর্তমানে নিম্নমধ্যবিত্তের বড় সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে নিত্যপণ্য ক্রয়ে অর্থনৈতিক সমস্যা। এ সমস্যা নিরসনে নাগরিক অধিকার, ভোক্তা অধিকার নিশ্চিতে প্রথমে সরকারী উদ্যোগ বাড়াতে হবে। বাজার মনিটরিং কার্যক্রমের উপর জোড়দার বৃদ্ধি করতে হবে। প্রচলিত ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে অবৈধ মজুদদারদের সাজা নিশ্চিত করতে হবে। নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে বিশেষ নজরদারী রেখে সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে তা দ্রুত সমাধানের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। যেহেতু সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে নাগরিকের ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা একটা বড় বিষয়, সেহেতু এটা নিশ্চিতে বড় পরিসরে চ্যালেঞ্জ গ্রহণের মাধ্যমে নাগরিক সেবা দিতে হবে। সর্বোপরি, সরকারের পাশাপাশি জনগণকেও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষনে সচেতন হতে হবে।


লেখক: আইনজীবী