অনিয়ন্ত্রিত এবং চিকিৎসাবিহীন উচ্চরক্তচাপ থেকে মারাত্মক শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। এমনটি জানালেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা। তারা বলেন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ চারটি অঙ্গ- মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড, কিডনি ও চোখের মারাত্মক ধরনের জটিলতা হতে পারে। ৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চরক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না। ফলে উচ্চরক্তচাপের কারণে কিছু বোঝার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে অসংখ্য মানুষ। এ কারণে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল ও জটিল হওয়ায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুও ঘটে। তাই যেকোনো উপায়ে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা জানান, স্বাভাবিক রক্তচাপে শরীরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পৌঁছায়। রক্তচাপের কোনো একক নির্দিষ্ট মাত্রা নেই। বিভিন্ন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে একেকজন মানুষের শরীরে রক্তচাপের মাত্রা ভিন্ন এবং একই মানুষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে স্বাভাবিক এ রক্তচাপও বিভিন্ন রকম হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, উচ্চরক্তচাপ ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। অনেক সময় উচ্চরক্তচাপের কোনো প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যায় না। নীরবে উচ্চরক্তচাপ শরীরের বিভিন্ন অংশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এ জন্যই উচ্চ রক্তচাপকে ‘নীরব ঘাতক’ বলা যেতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত এবং চিকিৎসাবিহীন উচ্চরক্তচাপ থেকে মারাত্মক শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ চারটি অঙ্গে মারাত্মক ধরনের জটিলতা হতে পারে। যেমন- হৃৎপিণ্ড, কিডনি, মস্তিষ্ক ও চোখ।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, ৯০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের কোনো নির্দিষ্ট কারণ জানা যায় না, একে প্রাইমারি বা অ্যাসেন্সিয়াল রক্তচাপ বলে। কিছু কিছু বিষয় উচ্চরক্তচাপের আশঙ্কা বাড়ায়। যেমন বংশানুক্রমিক, ধূমপান, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ, অধিক ওজন এবং অলস জীবনযাত্রা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস, অতিরিক্ত মদ পান, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত উৎকণ্ঠা ইত্যাদি। অতিরিক্ত রাগ, উত্তেজনা, ভীতি এবং মানসিক চাপের কারণেও রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যেতে পারে। কিছু কিছু রোগের কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে একে বলা হয় সেকেন্ডারি হাইপারটেনশন। এ কারণগুলোর মধ্যে কয়েকটি হল-কিডনির রোগ, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ও পিটুইটারি গ্রন্থির টিউমার, ধমনির বংশগত রোগ, গর্ভধারণ অবস্থায় অ্যাকলাম্পসিয়া ও প্রি-অ্যাকলাম্পসিয়া হলে, অনেক দিন ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ির ব্যবহার, স্টেরয়েডজাতীয় হরমোন গ্রহণ এবং ব্যথানাশক কিছু কিছু ওষুধ খেলে। কেউ কেউ এমনও ভাবেন যে উচ্চরক্তচাপ তার দৈনন্দিন জীবনপ্রবাহে কোনো সমস্যা করছে না বা রোগের কোনো লক্ষণ নেই, তাই উচ্চরক্তচাপের ওষুধ খেতে চান না। এ ধারণাটাও সম্পূর্ণ ভুল। এ ধরনের রোগীরাই হঠাৎ হৃদরাগ বা স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, এমনকি মৃত্যুও হয়ে থাকে।
ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, রক্তনালি বা ধমনীর দেয়ালের বিপরীততে রক্ত প্রবাহের ধাক্কাকেই রক্তচাপ বলে। রক্তচাপ খুব বেড়ে গেলে তা হৃৎপিণ্ডের কাজ অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দেয় এবং রক্তনালির মারাত্মক ক্ষতি করে। ১২০/৮০ এর অধিক রক্তচাপকে উচ্চরক্তচাপ বলে। ওপরের মাত্রাটিকে সিস্টোলিক চাপ বলে, যা হৃৎযন্ত্রের স্পন্দনের সময়কার রক্তচাপ। নিচের মাত্রাকে ডায়াস্টোলিক চাপ বলে, যা হৃদস্পন্দনের অন্তর্ববর্তীকালীন সময়ের রক্তচাপ যখন হৃদযন্ত্রে রক্ত এসে জমা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উচ্চ রক্তচাপের কারণ জানা যায় না। উচ্চরক্তচাপ বা হাইপারটেনশনকে নীরব ঘাতক বলা হয়। বছরের পর বছর এটি উপসর্গহীন থাকতে পারে। প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন জানে না যে, তাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে। এটি হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, রক্তনালি, মস্তিষ্ক এমনকি কিডনিরও ক্ষতি করতে পারে, যদি এর চিকিৎসা না করা হয়। যাদের রক্তচাপ ক্রমাগতভাবে স্বাভাবিক মাত্রার সামান্য ওপরে থাকে; অর্থাৎ সিস্টোলিক মাত্রা ১২০ থেকে ১৩৯-এর মধ্যে এবং ডায়াস্টোলিক মাত্রা ৮০ থেকে ৮৯ এর মধ্যে থাকলে তাকে প্রি-হাইপারটেনশন বলে। এদের উচ্চরক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হবার ঝুঁকি অনেক বেশি। চিকিৎসকেরা তাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে রক্তচাপ কমানোর পরামর্শ দিয়ে থাকেন। গড়ে রক্তচাপ ১৪০/৯০ বা এর ওপরে থাকলে কোন উপসর্গ না থাকলেও ধরে নিতে হবে, আপনি রক্তচাপে ভূগছেন। রক্তচাপ ১৮০/১১০ বা এর ওপরে হলে তা উচ্চরক্তচাপের বিপজ্জনক পর্যায়, অস্থির না হয়ে এ অবস্থায় কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার রক্তচাপ মাপুন। এর পরও রক্তচাপ বেশি থাকলে দ্রুত হাসপাতালে যাবার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ডাকুন। এই অবস্থা থেকে হার্ট অ্যাটাক, কিডনি ফেইলিয়র, জ্ঞান হারানোর মতো মারাত্মক কিছু হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়াও অসহ্য মাথাব্যথা, বুক ধড়ফড় করা, নাক দিয়ে রক্তপাত, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে বলে জানান অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ।
উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারেন। এমন কথা বলেছেন বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. শহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, কিডনি অকেজো হয় বিভিন্ন কারণে। এর মধ্যে দ্বিতীয় কারণে হিসাবে কাজ করে উচ্চরক্তচাপ। উচ্চরক্তচাপ ও কিডনি সমস্যা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উচ্চরক্তচাপ সৃষ্টি হলে কিডনি সমস্যা বেড়ে যায় এবং কিডনি সমস্যা হলেও বেড়ে যায় উচ্চরক্তচাপ। তাই যেকোনোভাবে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে। এদের মধ্যে কারো কারো কিডনি হঠাৎ করে অকেজো হয়ে যায়।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল পরিচালক হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল সাফী মজুমদার ভোরের আকাশকে জানান, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে দায়িত্ব পালনকালে দেখেছি, ওই হাসপাতালের সেবা প্রাপ্তদের শতকরা ১৫ দশমিক ৫৬ ভাগ উচ্চরক্তচাপের রোগী। ৪০ থেকে ৪৯ বছর বয়সের রোগীরাই অধিক হারে উচ্চরক্তচাপ নিয়ে হাসপাতালে আসেন। ১৯ বছরের নিচে শিশু কিশোরদের মধ্যেও ইদানীং উল্লেখযোগ্য হারে উচ্চরক্তচাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। শিশু কিশোরদের উচ্চরক্তচাপে আক্রান্তের প্রধান কারণ হলো পরিবর্তিত জীবনাচরণ অর্থাৎ অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস এবং স্থূলতা। এ ছাড়াও তাদের উচ্চরক্তচাপের জন্য পারিবারিক ইতিহাস, ডায়াবেটিস, কিডনির রোগও কম দায়ী নয় বলে জানান অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল সাফী মজুমদার।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, করোনায় আক্রান্ত রোগী যদি আগে থেকেই উচ্চরক্তচাপ বা ডায়াবেটিসে ভুগতে থাকেন, তাহলে হয় বেশ বিপজ্জনক। তাদের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া রোগ সারতেও অনেক সময় লেগে যায়। এ ধরনের কো-মরবিডিটি (সহরোগ) থাকলে রোগীর মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। সে কারণে শরীরে অন্য কোনো রোগ থাকলে তাদের আরো বেশি সাবধানে থাকতে বলা হয় বলে জানান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।
বাংলাদেশে উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা আনুপাতিকহারে অনেক বেশি। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি চারজন মানুষের মধ্যে কমপক্ষে একজন বা তার বেশি উচ্চরক্তচাপের রোগী আছে। বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) ২০১৭-১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১১ সালে ৩৫ বছর ও তার বেশি বয়সের ৩২ শতাংশ নারী এবং ২০ শতাংশ পুরুষের উচ্চরক্তচাপ ছিল। ২০১৭-১৮ বছরে এ হার যথাক্রমে ৪৫ শতাংশ ও ৩৪ শতাংশ এ উন্নীত হয়েছে। প্রতি বছর গড়ে বৃদ্ধির হার ২ শতাংশ। এ ধারাবাহিকতায় বর্তমানের চিত্র যে আরও আশঙ্কাজনক সন্দেহ নেই।