logo
আপডেট : ১৭ মে, ২০২২ ১২:৩৪
বিপদের আশঙ্কা করছেন বিনিয়োগকারীরা
পুঁজিবাজারের অবস্থা হযবরল
মুস্তাফিজুর রহমমান নাহিদ

পুঁজিবাজারের অবস্থা হযবরল

সূচকের অবিরাম পতন। কমছে মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ারের পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারদর। শীর্ষ বাজার মূলধনধারী কোম্পানির অবস্থাও করুণ। অস্বাভাবিক পতন থেকে রক্ষা পাচ্ছে না বাজারের ব্লু-চিপস খ্যাত কোম্পানিগুলো। পক্ষান্তরে বাড়ছে নাম সর্বস্ব বা তলানিহীন কোম্পানির শেয়ারদর। বাজার ভালো সংশ্লিষ্টদের এমন কথাও কাজে আসছে না। কমদরে শেয়ার কিনেও প্রতিনিয়ত পোর্টফোলিওতে থেকে পুঁজি কমছে। পতনে লাগাম টেনে ধরার জন্য বার বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এরপরও থামছে না পতন। সব মিলে পুঁজিবাজার রয়েছে হযবরল অবস্থায় রয়েছে। এতে শঙ্কায় রয়েছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী।

বাজারচিত্রে দেখা যায়, শেয়ার ও ইউনিটেরদর পতনের ধারা অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি প্রতিনিয়তই হ্রাস পাচ্ছে লেনদেন হওয়া সিংহভাগ কোম্পানির শেয়ারদর। এর জের ধরে লাগামহীনভাবে কমছে সূচক। বিনিয়োগকারীদের চোখের সামনে প্রতিদিন হাজার হাজার কোটি টাকা কমছে বাজার মূলধন। গতকাল এক দিনের পতনে বাজার মূলধন কমেছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ৫ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা থেকে গতকাল দিন শেষে বাজার মূলধন নেমে গেছে ৫ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। গত পাঁচ কার্যদিবসে বাজার মূলধন কমেছে ১৯ হাজার কোটি টাকা।

সাম্প্রতিক বাজার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভালো মন্দ কোন বাছবিচার ছাড়াই কমছে শেয়ারদর। দুর্বল কোম্পানির পাশাপাশি মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানি রয়েছে এই তালিকায়। এখন এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। বড় বড় এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ারে ক্রেতার আকাল থাকায় কমেছে তালিকাভুক্ত সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ারদর।

বছরের শুরু থেকে পুঁজিবাজারে পতন থাকলেও বর্তমানে এই পরিস্থিতি আরো প্রকট হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং শ্রীলঙ্কা ইস্যুতে বাজারে পতন আরো ভারী হয়। দুটি ইস্যুতেই পুঁজিবাজারে ব্যাপক দর পতন হয়। যদিও এর তেমন কোনো ভিত্তি খুঁজে পাননি পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বাজার পতনের মার্জিন ঋণ সমন্বয় করার বিষয়টিও তুলে আনছেন অনেককে। কিন্তু সব বিষয়ে ছাপিয়ে গেছে বিনিয়োগকারীদের মনোগত কারণ। তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে শেয়ার বিক্রির কারণেই এমন ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন বাজার সংশ্লিষ্টরা। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যুদ্ধ ইস্যুকে কাজে লাগাতে যাচ্ছে একটি চক্র। যুদ্ধের প্রভাবে দেশের পুঁজিবাজারে তেমন না থাকলেও তারা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এটা করছে তারা কমদরে শেয়ার কেনার জন্য। আর এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। তারা ভয়ে শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে করে ওই চক্রটিও বেশি সুবিধা পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ ভোরের আকাশকে বলেন, আমি বারবার একটি কথাই বলি। তা হচ্ছে আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা অল্পতেই ভেঙে পড়েন। তারা ভীত হয়ে শেয়ার ছেড়ে দেন। এতে করে পতন আরো ভারী হয়। বিনিয়োগকারীদের এ ধরনের মানসিকতা পরিহার করা দরকার। তা না হলে বাজার চিত্রে পরিবর্তন আসবে না। বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীদের কাজ হচ্ছে যে কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। এটা না করলে কোনো সিদ্ধান্তই কাজে আসবে না।

এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সার্কুলার কারণে বাজারে পতন নেমে আসে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তখন পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কোনো উপাদান পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সার্কুলারে বলা হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ধারণকৃত পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত সব ধরনের শেয়ার, ডিভেঞ্চার, করপোরেট বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিট এবং পুঁজিবাজারের অন্যান্য নিদর্শনপত্রের বাজার মূল্য হয়। তবে নিজস্ব সাবসিডিয়ারি কোম্পানি বা কোম্পানিকে প্রদত্ত ইক্যুয়িটি দীর্ঘমেয়াদি ইক্যুয়িটি বিনিয়োগ, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল, সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি (বিডি) লিমিটেড স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর শেয়ার ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে না। এতে আরো বলা হয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের পুজিবাজারে বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিবরণী প্রতি ত্রৈমাস শেষ হবার পর পরবর্তী মাসের সাত কর্মদিবসের মধ্যে সংযুক্ত ছক মোতাবেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগে দাখিল করতে হবে। বিষয়টিকে বাজার পতনের জন্য দায়ী করছেন অনেকে।

এদিকে পতন ঠেকাতে সম্প্রতি দুই পদক্ষেপ নিয়েছে বিএসইসি। এরমধ্যে রয়েছে সার্কিট ব্রেকার বা একদিনে শেয়ার দাম বৃদ্ধি বা কমার সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেওয়া এবং এবং বাজার স্থিতিশীলতায় গঠিত নতুন তহবিল থেকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ। নতুন নিয়মে শেয়ারদর সর্বোচ্চ বাড়তে পারবে ১০ শতাংশ। আর কমতে পারবে ২ শতাংশ। পাশাপাশি স্ট্যাবলাইজড ফান্ড (স্থিতিকরণ তহবিল) থেকে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের জন্য সরকারি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকা করে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের কথা রয়েছে। এছাড়া যাতে কোনো ধরনের কারসাজি না হয় সেজন্য বিএসইসিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারের প্রতি কঠোর নজরদারি রেখেছে। কিন্তু তারপরও স্বাভাবিক হচ্ছে না বাজার।

বিষয়টি নিয়ে কথা বললে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্রোকারেজ হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, পুঁজিবাজার সবসময় কিছু সুবিধাভোগী থাকেন। অর্থওয়ালা এসব ব্যাক্তিই বাজার উত্থান-পতনের জন্য দায়ী। এদের অস্বাভাবিক লেনদেন খতিয়ে দেখলে অনিয়ম বেরিয়ে আসবে। সংশ্লিষ্টদের এই বিষয়টিতে নজর দেওয়া দরকার। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা তাদের সঠিক দায়িত্ব পালন করছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার।

একই বিষয়ে বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক ভোরের আকাশকে বলেন, বাজারে ইউক্রেন-রাশিয়া, শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থাসহ বিভিন্ন গুজন রয়েছে। তবে এর চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে বাজারের এই পরিস্থিতিতে আইসিবির শেয়ার বিক্রি করা। শোনা যাচ্ছে, তারা প্রতিনিয়ত বড় অঙ্কের শেয়ার বিক্রি করছে। যদি এটা সত্যি হয় তা দুঃখজনক। বাজারের এই সময়ে যদি তারা শেয়ার বিক্রি করে তাহলে পতন ঠেকানো মুশকিল।