জাদুঘরকে বলা হয় জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়। একটি দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, প্রথা, ইতিহাস, নিদর্শন সবকিছুই সংরক্ষণ থাকে জাতীয় জাদুঘরে।
সেখান থেকে মানুষ একটা দেশের পূর্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি কৃষ্টি সম্পর্কে তাড়াতাড়ি জানতে পারে। তখন সেটা পাঠশালার অংশ হয়ে যায়।
ঢাকার ইতিহাসের সঙ্গে জাদুঘরের ইতিহাস জড়িত। ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের পথচলা শুরু। বহুমাত্রিক শিক্ষা, সাংস্কৃতিক কর্মপরিসরে আজ বিস্তৃত তার শাখা-প্রশাখা।
জাতীয় জাদুঘর ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক শিল্পকলা ও প্রাকৃতিক নিদর্শন সংগ্রহ করে, প্রদর্শন করে এবং গবেষণার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করে।
জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯০৯ সালে শিলং থেকে কিছু মুদ্রা ঢাকায় স্থানান্তর হওয়ার পর।
১৯১০ সালের ১ মার্চ বিশিষ্ট মুদ্রাতত্ত্ববিদ এইচ এ স্টাপলটন গর্ভনর ল্যান্সলট হিয়ারকে ঢাকায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
১৯১২ সালের ২৫ জুলাই ঢাকার নর্থব্রুক হলে সুধীবৃন্দ সভায় মিলিত হন। ১৯১৩ সালের ৫ মার্চ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার অনুমোদন গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
সে সময়ে ১৯১৩ সালের ২০ মার্চ ঢাকা জাদুঘর ২ হাজার রুপি তহবিলে যাত্রা শুরু করে।
বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল তৎকালীন ঢাকা মেডিকেল কলেজের একটি কক্ষে ‘ঢাকা জাদুঘর’ উদ্বোধন করেন। তখন ৩০ সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রভিশনাল জেনারেল কমিটি গঠিত হয়।
পরের বছর ১৯ মে প্রথম নির্বাহী কমিটির সভায় ১৯১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়। এ সময় জাদুঘরের একজন কিউরেটর নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
পরে এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯১৪ সালের ৬ জুলাই নলিনী কান্ত ভট্টশালী মাসিক একশ রুপি বেতন ভাতায় কিউরেটর নিযুক্ত হন। নলিনী কান্ত ভট্টশালী ছিলেন বিশিষ্ট মুদ্রাতত্ত্ববিদ, ভাস্কর বিশেষজ্ঞ।
তার অধ্যবসায়, কর্মদক্ষতার ইতিহাস, ঐতিহ্য অনুরাগের মাধ্যমে জাদুঘর বিকশিত হয়। নিদর্শন সংগ্রহ, গবেষণা, প্রদর্শন সজ্জিত করার কাজ দ্রুত এগোতে থাকে।
৩৭৯টি নিদর্শন নিয়ে জাদুঘর প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করা হয় ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট। ঢাকার দানশীল ব্যক্তিরা জাদুঘরে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারকগুলো প্রদর্শনের জন্য উপহার হিসেবে প্রদান করেন।
সচিবালয় থেকে নিমতলীর বারোদুয়ারি ও দেওড়িতে ‘ঢাকা জাদুঘর’ স্থানান্তর করা হয় ১৯১৫ সালের জুলাই মাসে।
নিমতলীতে অবস্থিত ‘ঢাকা জাদুঘর’ ক্রমে পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিত্তবান, ইতিহাসমনস্ক ব্যক্তিদের নিরলস পৃষ্ঠপোষকতায় জাদুঘরে সংগ্রহ বাড়তে থাকে।
১৯৮৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জাতীয় জাদুঘর অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়। একই বছরের ২০ নভেম্বর জাতীয় জাদুঘর ভবন উদ্বোধন করা হয়।
‘ঢাকা জাদুঘর’ ‘বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে’ আত্তীকৃত হয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় উন্নীত হয়।
শাহবাগে অবস্থিত বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর আজ গৌরবের বহুমাত্রিক নিদর্শন প্রদর্শন ও সংরক্ষণের প্রতিষ্ঠান হয়ে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের সেতুবন্ধন রচনা করেছে।
৮.৬৩ একর জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর শুধু একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপনা নয়, পরিপূর্ণ সংরক্ষণশালাও বটে। ৪৫টি প্রদর্শনী কক্ষ, দুটি মিলনায়তন, একটি বিশেষ গ্রন্থাগার, একটি শ্রুতি চিত্রন শাখা, প্রকাশনা শাখা নিয়ে জাতীয় জাদুঘর বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান।
এই চারতলাবিশিষ্ট জাদুঘর ভবনের ২০ হাজার বর্গমিটারজুড়ে রকমারি নিদর্শনের প্রদর্শন দৃষ্টিনন্দন।
বাংলার ইতিহাসের ধারাবাহিক উপস্থাপন অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত ঘটনাপঞ্জি ইতিহাসের স্মারকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়।
বীর, যোদ্ধা, ইতিহাসের পাত্রপাত্রী সরব উপস্থাপনায়। বাংলা অঞ্চলের ইতিহাস, বাঙালির আত্মত্যাগে গৌরবদীপ্ত।
জাতীয় জাদুঘর উপস্থাপন শৈলীর মাধ্যমে মূর্ত করে তুলেছে ইতিহাসকে। তরুণ প্রজন্মের কাছে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবন ও কর্ম তুলে ধরা হয়েছে।
আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ভিডিও, অডিও উপস্থাপন হৃদয়গ্রাহী।
সেমিনার, আলোচনা, প্রদর্শনীতে মনীষীদের অবদান তুলে ধরা হচ্ছে। জাতীয় জাদুঘরের আর্কাইভ ও শ্রুতচিত্রণ শাখা কথ্য ইতিহাস ও প্রাচীন দলিলপত্রে সমৃদ্ধ।
বিশাল ভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে অমূল্য রত্ন। এর পেছনে রয়েছে উপহারদাতা, বিক্রেতা ও জাদুঘর কর্মীদের মিলিত শ্রম।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের নিরন্তর পথচলা কল্যাণময় হোক।
প্রাচীন নিদর্শন সংগ্রহের মাধ্যমে জাদুঘরের গোড়াপত্তন হয়েছিল। আজ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমকালীন বস্তুসম্ভার সংযুক্ত হয়েছে জাদুঘরে।
পৃথিবীব্যাপী জাদুঘরের কর্মকাণ্ড প্রসারিত হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে জাদুঘরকে দর্শকপ্রিয় করার ব্যাপারে জাদুঘর কর্মীদের নিত্য নতুন ভাবতে হচ্ছে।
প্রদর্শনের নতুনত্ব ও পর্যাপ্ত তথ্য জাদুঘর ভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর অনুষ্ঠানমালায় নতুনত্ব এনেছে।
প্রদর্শনীতে উপস্থাপিত নিদর্শনের খুঁটিনাটি দিক কম্পিউটার ও ট্যাবে প্রতিনিয়ত আকর্ষণীয়, চলমান ও জীবন্ত করে দর্শকদের কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে স্বাধীন বাংলা বেতার কক্ষে শব্দ সৈনিকের অংশগ্রহণ, স্মৃতিচারণ ও স্মৃতি সামগ্রী প্রদর্শন করা হয়েছে।
এ ধরনের অসংখ্য বিশেষ প্রদর্শনী জাতীয় জাদুঘরে হয়ে থাকে। নিদর্শন সংগ্রহ চলমান প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।
আধুনিক জাদুঘর নিত্যনতুন পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বস্তু নিদর্শন উপস্থাপন আকর্ষণীয় ও তথ্যবহুল করার বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের বিশেষ বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠেছে।
জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান এনডিসি বলেন, আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস উপলক্ষে আমরা একটা র্যালি করব।
তার আগে জাদুঘরের আঙ্গিনায় আমরা বেলুন উড়াব। অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা, জাতীয় জাদুঘরের বিভিন্ন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।
র্যালিটা জাদুঘর থেকে শুরু করে টিএসসি হয়ে আবার জাতীয় জাদুঘরে এসে শেষ হবে। এ ছাড়া র্যালি শেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে।
একইসঙ্গে জাতীয় জাদুঘরের নিয়ন্ত্রণাধীন সাতটা জাদুঘরের সাজসজ্জা হবে এবং শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, জাতীয় জাদুঘর দিবস উপলক্ষে স্কুলের ছাত্র, ছাত্রী, সিনিয়র নাগরিক ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন লোকদের বিনামূল্যে জাতীয় জাদুঘরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে।
আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসে কামনা সাধারণ জনগণ ও জাদুঘর কর্মীরা ভবিষ্যতে আধুনিক জাদুঘর গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষ অবদান রাখবে।
এ বিষয়ে জাতীয় জাদুঘরের জনশিক্ষা বিভাগের কিপার শিহাব শাহরিয়ার বলেন, আমাদের এ জাদুঘর ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এখন ১০৯ বছরে পা দিল। এটা একটা বহুমাত্রিক জাদুঘর। তা ছাড়া এটা দক্ষিণ এশিয়ার বড় জাদুঘর। এখানে সব ধরনের নির্দশন রয়েছে।
এখানে চারটি বিদেশি কর্ণার স্থাপন করা হয়েছে। সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ইরান, ভারতের কর্নার স্থাপন করা হয়েছে।
জাদুঘর হচ্ছে সংস্কৃতি, শিক্ষা, সাহিত্যের অবদানের সংগ্রহ ভান্ডার। বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমকালীন চিত্রকর্ম সেগুলো নিয়ে আমাদের এ জাদুঘর।
এখানে ৯৪ হাজার সংগ্রহ রয়েছে। আমরা এখানে বাঙালির ২৫০০ বছরের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
সেদিক থেকে আমরা অনেক আধুনিক। তথ্য প্রযুক্তি, বিজ্ঞাননির্ভর, ও ডিজিটাল কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে।
আমাদের একটা ভার্চুয়াল গ্যালারি আছে। যেটা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে আমাদের ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা যাবে।
আমরা চেষ্টা করছি পৃথিবীর যেসব জাদুঘর অতি আধুনিক ও উন্নত সে আঙ্গিকে এ জাদুঘরকে সাজানোর চেষ্টা করছি।
উন্নত জাদুঘর থেকে আমরা যতটুকু পিছিয়ে আছি সেটা পূরণ করতে চাচ্ছি । খুশির খবর হলো এ জাদুঘরের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সুনজর রয়েছে।
তাই তিনি জাতীয় জাদুঘরের ১৩ তলা ভবনের অনুমোদন দিয়েছেন।