logo
আপডেট : ১৯ মে, ২০২২ ১২:৫৪
জঙ্গলে জীবিকা
সোহেল রানা, ঠাকুরগাঁও

জঙ্গলে জীবিকা

শাহারবানু তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা শাক প্রক্রিয়াজাত করছেন

‘কাকডাকা ভোরে ওঠে ট্রেন ধরি। পরিবারের সবাই চলে যাই পঞ্চগড়। সেখানে বিভিন্ন এলাকার জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করি হরেকরকম বন শাক। সেগুলো বস্তাবন্দি করে নিয়ে আসি ঠাকুরগাঁওয়ে। এখানে বাছাই করে আঁটি বেঁধে শাক বিক্রির উদ্দেশে নিয়ে যাই দিনাজপুরে। এভাবেই ৩৫ বছর ধরে বনজঙ্গল থেকে শাকপাতা সংগ্রহ করে বিক্রি করছি। বলতে পারেন জঙ্গল থেকেই জীবিকার সন্ধান করি।’

ঠাকুরগাঁও সদরের আখানগর রেল স্টেশনের রেললাইনের পাশে বসে শাকপাতা বাছাই করেন বৃদ্ধা শাহারবানুসহ তার দুই মেয়ে ও নাতি-নাতনিরা। সেখানেই একটি গুচ্ছগ্রামে থাকেন তারা। শাক বিক্রি করেই চলে পরিবার। কথাগুলো ৬৮ বছরের বৃদ্ধা শাহারবানুর। বয়সের ভারে ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না তিনি।

শাহারবানুর মেয়ে রাফি বেগম বলেন, এ অঞ্চলে এই শাকটি চামগাছ নামে পরিচিত। অনেকে এটাকে টেকনাই বলে থাকে। কচু শাকের মতোই দেখতে এ শাক। ঠাকুরগাঁওয়ে খুব বেশি না খেলেও দিনাজপুরে এক কেজি শাকের আঁটি বিক্রি হয় ২০-২৫ টাকায়। শাকের এক চালান দিনাজপুরের জন্য প্রস্তুত করতে সময় লাগে তিন দিন। আয় আসে দুই হাজার টাকা।

আরেক মেয়ে রহিমা বেগম বলেন, ‘অন্যের খেতে বা পুকুর ধারে এবং বাড়ির আশপাশের জঙ্গলে অনেক পুষ্টিকর শাক-সবজি পাওয়া যায়। যেগুলো আপনা থেকে বেড়ে ওঠে। কেউ চাষ করে না বরং চাষাবাদি জমিতে এগুলো আগাছা হিসেবে নিড়ানি করা হয়।

‘আমরা সে শাকগুলো সংগ্রহ করি এবং বিক্রি করি; তার জন্য কোনো বিনিয়োগ করতে হয় না। তবে অনেক স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে শাক সংগ্রহ করতে হয়। বিভিন্ন পোকামাকড়ের আক্রমণের শিকার হয়ে থাকি। কিন্তু আমরা গরিব মানুষ। এভাবেই চলছি দীর্ঘ বছর ধরে। এত বেশি কষ্ট হয়, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ভিক্ষা করে খাই। তারপরেও মনে হয় এভাবেই ভালো আছি’, বলেন রহিমা বেগম।

বৃদ্ধা শাহারবানু বলেন, ঢেকি শাক, বনউসনি, তিতারি, চামগাছ, কাঁটা শাকসহ হরেকরকম শাক কৃষিজমি ও বনজঙ্গলে পাওয়া যায়। এগুলো চাষ ছাড়াই জন্মে। আমরা কৃষকদের সহযোগিতা পাই। তাদের জমি থেকে আগাছা পরিষ্কার হয় বলে তারা শাক সংগ্রহে বাধা দেন না।

‘কিন্তু শ্রম অনুযায়ী আমরা ভালো দাম পাই না। আমাদের সংগৃহীত শাক হাতবদল হয়ে খুচরা বাজারে ৪০-৪৫ টাকা কেজিতেও বিক্রি হয়। তারপরও শাক সংগ্রহ করি। এ কাজ আমার নেশাতে পরিণত হয়েছে। এভাবেই দুবেলা দুমুঠো খেতে পারছি বলে আমি খুশি’, বলেন শাহারবানু।

যেখানেই শাকপাতা বাছাই করতে বসে শাহারবানুর পরিবার, সেখানেই জমে যায় ছোটখাটো শাকের ভ্রাম্যমাণ আড়ত। যারা শাকের পুষ্টিগুণ বোঝেন তারা শাহারবানুকে খুঁজে শাক কিনে নিয়ে যান।
শাকের ক্রেতা মাসুদ রানা পলক বলেন, ‘এ ধরনের বনশাকে অনেক পুষ্টি থাকে। চামগাছ বা টেকনাইয়ের অসাধারণ স্বাদ। এগুলো ঠাকুরগাঁওয়ে খুব একটা পাওয়া যায় না। মাঝে মধ্যে দিনাজপুর থেকে নিয়ে আসি। এখানে পেয়ে যাব বুঝতে পারিনি।’

স্থানীয় শাক ক্রেতা রুবেল খান বলেন, ‘শাহারবানু দাদি আর রাফি আপারা দীর্ঘদিন ধরে শাকের চাহিদা পূরণের কাজ করছেন। আমি তাদের বনশাকের জন্য অপেক্ষায় থাকি। খুব কম দামে শাক পাওয়া যায়। সব সময় মিলে না, তাই আজ ১০০ টাকা দিয়ে পাঁচ কেজি কিনে নিলাম।’

ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষি কর্মকর্তা আবু হোসেন বলেন, ‘ঠাকুরগাঁওয়ের মাটি শাকসবজি উৎপাদনে অনেক উপযোগী। এখানকার ফসলি মাঠে আপনা থেকে কিছু উদ্ভিদ বেড়ে ওঠে। এগুলো এ অঞ্চলে শাক হিসেবে পরিচিত। খেতে অনেক সুস্বাদু। অনেক অসচ্ছল পরিবার এগুলো বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এতে কৃষির আগাছা দমন হচ্ছে।’