logo
আপডেট : ২০ মে, ২০২২ ১১:৩২
সুপ্রিম কোর্টে ২১ নথির মধ্যে ২০টিতেই নকল কোর্ট ফি
* সুপ্রিম কোর্টে তোলপাড়, নকল কোর্ট ফির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু * নকল কোর্ট ফি চিহ্নিত করতে সব আদালতে ২ হাজার মেশিন সরবরাহ করবে সুপ্রিম কোর্ট * বছরে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার * সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে সিআইডির হাতে আটক ৩ * তিন বছরের প্রচেষ্টার ফসল এ অভিযান : হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার
এম বদি-উজ-জামান

সুপ্রিম কোর্টে ২১ নথির মধ্যে ২০টিতেই নকল কোর্ট ফি

ফাইল ফটো

পারিবারিক বিরোধের জেরে যশোরের শার্শা উপজেলার যাদবপুর গ্রামের মৃত মজিবুর রহমানের ছেলে রবিউল ইসলামের সঙ্গে তার স্ত্রী মাহমুদা খাতুনের মামলা গড়িয়েছে হাইকোর্ট পর্যন্ত। এ বিষয়ে হাইকোর্টে দাখিল করা মামলার নথিতে যে কোর্ট ফি লাগানো হয়েছে, তার সবগুলোই নকল। কোর্ট ফি আসল নাকি নকল, তা গতকাল বৃহস্পতিবার পরীক্ষার পরই নথিটি জব্দ করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। শুধু এ একটি নথি নয়, গতকাল সকালে ২১টি মামলার নথি পরীক্ষা করে তার ২০টিতেই নকল কোর্ট ফি পেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। ফলে ওই ২০টি মামলার নথিই জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনা ধরা পড়ার পর বৃহস্পতিবার থেকেই আগের সব মামলার নথি পরীক্ষা করা শুরু হয়েছে।

শুধু মোশন মামলাই নয়, আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে দাখিল করা পুরোনো মামলায়ও নকল কোর্ট ফির অস্তিত্ব পেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। আর এ ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। নকল কোর্ট ফি সরবরাহকারীদের ধরতে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী আপিল বিভাগের অপরাপর বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি-সম্পাদকের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন বলে জানা গেছে। এই নকল কোর্ট ফির কারণে সরকার প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী বছরে সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

জানা গেছে, নকল কোর্ট ফি বিক্রি ও সরবরাহকারীদের ধরতে তিন বছর আগে সুপ্রিম কোর্ট উদ্যোগ নিলেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সাড়া না পাওয়ায় তা এতদিন আলোর মুখ দেখেনি। সর্বশেষ গত এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের বৈঠকের পরই এ অভিযান শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। শুধু দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মামলার নথিতে নকল কোর্ট ফি মিলছে না, দেশের সব অধস্তন আদালতের নথিতেও নকল কোর্ট লাগানোর অভিযোগ বেশ পুরোনো। এ কারণে নকল কোর্ট ফিমুক্ত মামলার নথি প্রস্তুতের জন্য দেশের সব আদালতে ২ হাজার মেশিন সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।

এদিকে নকল কোর্ট ফি বিক্রির অভিযোগে সুপ্রিম কোর্ট চত্বর থেকে তিনজনকে আটক করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রব্বানী ভোরের আকাশকে বলেন, গত তিন বছর ধরে এ নিয়ে কাজ করছি। আজ (বৃহস্পতিবার) সিআইডিকে নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন অভিযান চালিয়ে তিনজনকে আটক করেছে। নকল কোর্ট ফি চিহ্নিত করতে ২ হাজার মেশিন কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব মেশিন দেশের সব অধস্তন আদালতে পাঠানো হবে। সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ সাইফুর রহমান জানান, এই নকল কোর্ট ফির কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রধান বিচারপতির নির্দেশে নকল কোর্ট ফি রোধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

দেশের কোনো আদালতে নতুন কোনো মামলা বা কিংবা মামলা সংক্রান্ত আবেদন দাখিল করতে হলে তাতে কোর্ট ফি লাগাতে হয়। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ৩৪ ধরনের মামলায় কোর্ট ফির প্রয়োজন পড়ে। এই কোর্ট ফি ছাড়া মামলা বা আবেদন দাখিল করার সুযোগ নেই। ১৫০ টাকার কোর্ট ফি থেকে মামলাভেদে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকার কোর্ট ফির প্রয়োজন পড়ে প্রতিটি মামলায়। দেশের বিভিন্ন সরকারি নথিতে কোর্ট ফি লাগানোর প্রয়োজন পড়ে। ২ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা মূল্যমানের কোর্ট ফি চালু আছে। এই কোর্ট ফি বিক্রি করে সরকারের প্রতি বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়। এ সুযোগে একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি নকল কোর্ট ফি ছাপিয়ে অল্প টাকায় বিক্রি করে। মাঝে মাঝে এ চক্রের সদস্যরা ধরাও পড়ে। কিন্তু তাতে থামছে না তাদের এই নকল কোর্ট ফি ছাপানো।

জানা গেছে, নকল কোর্ট ফির বিস্তার নিম্ন আদালত থেকে সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। তথ্যানুযায়ী সারা দেশে আদালতে ৩৯ লাখ মামলা বিচারাধীন। প্রতি বছর কয়েক লাখ নতুন মামলা হচ্ছে। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টেই প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার মামলা দাখিল হয়। সব মামলার নথিতেই কোর্ট ফি লাগানোর প্রয়োজন পড়ে। এ কোর্ট ফি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনের চারতলায় এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রশাসনিক ভবনের পাশে বিক্রি হয়। লাইসেন্সধারী নির্ধারিত ব্যক্তিরা এটা বিক্রি করে থাকেন। আইনজীবীরা এই কোর্ট ফি সংগ্রহ করে নথিতে যুক্ত করেন। জানা যায়, সাধারণত আইনজীবী সহকারীরা এসব কোর্ট ফি কিনে থাকেন। আর অসাধু চক্র এ আইনজীবী সহকারীদের হাত করেই নকল কোর্ট ফি বিক্রি করে থাকে। জানা যায়, ২ হাজার টাকার কোর্ট ফি ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকায় পাওয়া যায়। আর নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কম দামে পাওয়া কোর্ট ফিই নকল। এভাবেই বিভিন্ন মূলম্যানের কোর্ট ফি কম দামে কিনে নথিতে লাগানো হয়।

জানা যায়, এ নকল কোর্ট ফি বেচাকেনার তথ্য তিন বছর আগে পান হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রব্বানী। এরপর তিনি ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে সত্যতা পান। এরপর তিনি এ নিয়ে বিস্তারিত জানতে একাধিকবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাননি। কিন্তু হাল চাড়েননি তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় গত তিন-চার মাস আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার। এরই ধারাবাহিকতায় গত মাসে সুপ্রিম কোর্টের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ ব্যাংক, সিআইডি, ডাকঘরসহ সংশ্লিষ্টদের (স্টেকহোল্ডার) নিয়ে বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে ৫টি মামলার নিথর কোর্ট ফি পরীক্ষা করা হয়। সেখানে সবক’টি নথির কোর্ট ফি নকল হিসেবে চিহ্নিত হয়। এর পরই বাংলাদেশ ব্যাংকের টনক নড়ে। এ বৈঠকের পর সুপ্রিম কোর্ট নকল কোর্ট ফি চিহ্নিত করতে দুটি মেশিন কেনে। বুধবার এ মেশিন হাতে পায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এরপর গতকাল সকালে ২১টি নথি নিয়ে তা পরীক্ষা করেন হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার। এর মধ্যে ২০টিতেই নকল কোর্ট ফি মেলে। এ ঘটনায় হতবাক হয়ে যান তিনি। এরপরই তিনি বিষয়টি প্রধান বিচারপতিকে জানান। ঘটনা শুনে প্রধান বিচারপতিও বিস্ময় প্রকাশ করেন। এরপরই প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগের অপরাপর বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতাদের নিয়ে এক বৈঠক করেন। এ বৈঠকের পর সুপ্রিম কোর্টে সিআইডিকে ডাকা হয়।

বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দুটি টিম একযোগে অভিযান চালায়। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. বজলুর রহমান ও হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. গোলাম রব্বানীর নেতৃত্বে একটি টিম যায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনের চারতলায়। অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুর রহমান ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হারুনুর রশিদের নেতৃত্বে পৃথক একটি টিম যায় সুপ্রিম কোর্টে প্রশাসনিক ভবন এলাকায়। উভয় টিমেই সিআইডি ও সমিতির নেতারা ছিলেন। এরপর শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি গ্রামের দুই ভাই দেলোয়ার হোসেন ও মো. মনির হোসেন এবং কুমিল্লার তিতাস উপজেলার জাকির হোসেনকে আটক করা হয়। সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি নিয়ে তাদের নিয়ে যায় সিআইডি। এছাড়া এ ঘটনার প্রতিটি নথি পরীক্ষা করা শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।