logo
আপডেট : ২২ মে, ২০২২ ১৯:৪৫
সিলেটে বন্যার ভয়াবহতা কমেছে
কামরুল ইসলাম মাহি, সিলেট

সিলেটে বন্যার ভয়াবহতা কমেছে

টানা পাঁচদিন পর অবশেষে কমছে বন্যার পানি। ছবিটি রোববার বিকেলে সিলেট নগরীর যতরপুর এলাকা থেকে তোলা।

সিলেটে বন্যার ভয়াবহতা কমে আসছে। নগরীতে কমতে শুরু করেছে পানি। এছাড়া জেলার সদর, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুরসহ বেশ কয়েকটি উপজেলায়ও পানি কমেছে। পানি কমে আসলেও বানভাসি মানুষে দুর্ভোগ যেন কিছুতেই কমছে না। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বেরুচ্ছে নতুন নতুন ক্ষত।

গত ১১ মে থেকে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটের বিভিন্ন উপজেলা পানিবন্দি হওয়ার পর ১৬ মে থেকে সুরমার পানি উপচে নগরেও পানি ঢুকতে শুরু করে। এতে প্লাবিত হয় বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট, দোকানপাটসহ জরুরি সেবাদানকারী অনেক প্রতিষ্ঠান।

এ কারণে বিদ্যুৎ ও গ্যাসহীন, খাবার পানির সংকটের পাশাপাশি জলমগ্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ। এসব রোগীদের সেবায় ১৪০টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এ পর্যন্ত সিলেটে বন্যায় মারা গেছেন ৬ জন।

গত পাঁচ দিন থেকে পানিবন্দি নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা। তবে শনিবার রাত থেকে পানি কমতে শুরু করলেও বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ যেন রয়েই গেছে। ঘরের মালামাল গোছানো থেকে শুরু করে ঘরের ভেতরে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনে ব্যস্ত সময় পার করছে বাসিন্দারা। এছাড়াও পানি ওঠায় বন্ধ ছিল অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পানি কমায় দোকান গোছাতেও ব্যস্ত সময় পার করছেন ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর শাহজালাল উপশহর, যতরপুর, তালতলা, জামতলা এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। প্রধান সড়কগুলোতে পানি কমে গেলেও পাড়া-মহল্লায় রয়ে গেছে পানি। জমে থাকা পানিগুলো কয়েকদিন একই স্থানে থাকায় কালো রঙ ধারণ করে তা থেকে বের হচ্ছে উৎকট গন্ধ।

বন্যাকবলিত লোকজনের মধ্যে পানিবাহিত নানা রোগের লক্ষ্মণ দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে সিলেট জেলা ও মহানগরে ১১৪ জন ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। আর ছয়জনের শরীরে চর্ম রোগ শনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়াও বন্যায় ৬ জনের প্রাণহানি হয়েছে। পাঁচজন পানিতে ডুবে একজন মাটিচাপায় মারা যান।

পানিবাহিত রোগ যাতে ছড়িয়ে না যায় সেজন্য সিলেট জেলা ও মহানগরে ১৪০টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। যারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ শহরের বন্যাকবলিত এলাকায় মেডিকেল ক্যাম্প তৈরি করে সেবা দিচ্ছে। এছাড়া বন্যাকবলিতদের মধ্যে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ওষুধ বিতরণ করছেন।

এসব তথ্য নিশ্চিত করে সিলেট জেলার সিভিল সার্জন ডা. এস এম শাহরিয়ার বলেন, ‘বন্যার কারণে পানিবাহিত রোগ বেড়েছে। শতাধিক লোক ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছেন। পাশাপাশি ছয়জন চর্ম রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। আমাদের মেডিকেল টিম ইউনিয়ন পর্যায় থেকে মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায় কাজ করছে। যাতে পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে না পড়ে।’

জেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, জেলার ১৩ উপজেলার মধ্যে ১০টি উপজেলার ৮৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এতে পানিবন্দি অবস্থায় আছেন ১৫ লাখ মানুষ।

বন্যার কারণে জেলার প্রায় ৭০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। আর জেলা বন্যাদুর্গতদের জন্য ৩২৬টি অশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়। সিলেট নগরীতে ১৬টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। এছাড়া ২৩৮টি গবাদিপশু বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. মজিবর রহমান বলেন, ‘সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সরকার বন্যার্তদের সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে। ইতোমধ্যে ২৩৪ টন চাল, ১৩ লাখ নগদ টাকা ও প্রায় ৩ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে।

এদিকে চলমান বন্যায় ব্যাপক লোকসানে ফেলে দিয়েছে ধান-চালের ব্যবসায়ীদের। সুরমা নদী তীরবর্তী ধান-চালের মিল ও আড়তে গুদামজাত করে রাখা কোটি টাকার ধান-চাল নষ্ট হয়েছে বন্যার পানিতে।

সিলেটের কাজীরবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সদস্য আবদুল মালেক বলেন, কাজীরবাজার ও শেখঘাট অংশে শতাধিক চালের ব্যবসায়ী রয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রায় ১০ থেকে ১৫টি অটো রাইসমিল।
চাল ব্যবসায়ীদের আলাদা গুদামও রয়েছে। গুদামে হাজার হাজার বস্তা চাল রাখা থাকে। সেগুলো একসঙ্গে সরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। নদীর পানি উপচে গুদাম ও রাইসমিলে প্রবেশ করে ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

এছাড়া রোববার দুপুরে সিলেট সিটি করপোরেশনের হলরুমে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অনলাইনে যুক্ত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।

এ সময় তিনি প্লাবিত এলাকার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মেরামত, পুনর্নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত বাসাবাড়ির তালিকা প্রণয়ন এবং নগরকে বন্যামুক্ত রাখতে করণীয় নির্ধারণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বক্তৃতাকালে বলেন, ‘ধাকস্মিক বন্যার ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে কিছুটা সময় লাগবে। দুর্গত মানুষের কল্যাণে সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসতে হবে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, সিলেটে দুটি নদী সুরমা-কুশিয়ারার পানি এখনো বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সিলেট পাউবো উপবিভাগীয় প্রকৌশলী এ কে এম নিলয় পাশা বলেন, ‘বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। পানি দ্রুত নেমে যেতে শুরু করেছে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে দ্রুতই পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে।’

সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘নগরীর সিংহভাগ এলাকা থেকেই পানি নেমে গেছে। নগরবাসী আশ্রয়কেন্দ্র থেকে নিজেদের বাসা-বাড়িতে ফিরছেন। আজকের মধ্যেই আশ্রয়কেন্দ্র খালি হয়ে যেতে পারে।’