উদ্বোধনের অপেক্ষায় বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু। দেশের যোগাযোগ খাতের সর্ববৃহৎ এই প্রকল্পের উদ্বোধন ঘিরে চলছে নানা আলোচনা।
দক্ষিণের ২১ জেলার বেশি মানুষের এখন দীর্ঘ প্রতীক্ষা- কবে চালু হবে স্বপ্নের সেতুটি। তবে সুবিধা পাবেন গোটা দেশের মানুষ।
গতি বাড়বে অর্থনীতিতে। হবে কর্মসংস্থান ও পর্যটন খাতের উন্নয়ন। আন্তর্জাতিক সড়ক ও রেল যোগাযোগে পা রাখবে বাংলাদেশ।
যেকোনো সময় সেতু উদ্বোধনের ঘোষণা দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আলোচনা আছে ২৩ অথবা ২৫ জুন সেতু উদ্বোধনের তারিখ চূড়ান্ত হতে পারে।
অনেকেই বলছেন, ২৩ জুন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। বিশেষ এই দিন উপলক্ষে সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হতে পারে।
২৩-২৫ জুলাই উদ্বোধন হতে পারে একথা উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারের মন্ত্রীরাও স্ট্যাটাস দিয়ে যাচ্ছেন।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বাকি আর মাত্র ২ শতাংশ কাজ। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের ঘষামাজা। তবে জুনের প্রথম সপ্তাহেই আলোয় আলোয় সাজছে পুরো পদ্মা সেতু।
সেতু সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই জানা গেছে।
সূত্র বলছে, এখন রোড মার্কিং, সেতুতে বিদ্যুতের লাইন দেওয়াসহ শেষ মুহূর্তের টুকিটাকি কাজ চলছে। এ ছাড়া সেতুর দুই প্রান্তে দুটি ম্যুরাল নির্মিত হচ্ছে।
সেগুলোরও নির্মাণ কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। প্রতিটি ম্যুরাল হবে ৪০ ফুট উঁচু। সব মিলে সেতুর কাজ ইতোমধ্যে ৯৮ শতাংশ শেষ হয়েছে।
এ ছাড়া সেতুতে বাতি বসানোর কাজও শেষ। এখন শুধু বিদ্যুৎ সংযোগ দিলেই আলোকিত হবে স্বপ্নের সেতু।
এদিকে উদ্বোধনের আগেই সেতু দেখতে পদ্মা নদীতে প্রতিদিন হাজারো পর্যটক ভিড় করছেন।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দেশীয় অর্থায়নে নির্মিত সেতুটি এই স্থাপনা দেখতে যাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ট্রলার বা স্পিড বোর্ড রিজার্ভ করে দিনভর সেতু দেখার পাশাপাশি নদী ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেকেই।
নদী আর সেতু মিলিয়ে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করছেন কেউ কেউ। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন যত ঘনিয়ে আসছে ততই এ নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়ছে।
সেতুর শেষ মুহূর্তে পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের বলেন, কিছু ছোটো-খাটো কাজ বাকি আছে।
বলতে গেলে মূল কাজ শেষ। এখন সেতুতে রোড মার্কিং, আলোকিত করা এবং উদ্বোধনের কাজ বাকি।
এছাড়া দুই পাশে দুটি ম্যুরাল হবে। একটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, অন্যটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
সেগুলোর নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি।
উদ্বোধন কবে হবে এবং কী কী নির্দেশনা এখন পর্যন্ত পেয়েছেন?- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জুনের শেষ সপ্তাহে উদ্বোধনের কথা আমাদের বলা হয়েছে।
তবে নির্দিষ্ট কোনো তারিখ জানানো হয়নি। কেননা আবহাওয়ার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। জুনের শেষ সপ্তাহে ঝড়-বৃষ্টির প্রকোপ বেশি থাকার কথা।
সেই অনুযায়ী আমরা সবকিছুর প্রস্তুতি নিচ্ছি। যদিও আমাদের প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি নেই। আর যেসব কাজ বাকি আছে সেগুলো আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে শেষ হয়ে যাবে আশা করছি।
এদিকে সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, সেতুতে বাতি বসানোর কাজ শেষ। ল্যাম্পপোস্টে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়ার কাজও শেষের দিকে।
এখন সেতুতে বিদ্যুতের মিটার বসানোর কাজ চলছে। বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ অফিসকে চিঠিও দিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ।
যেখানে জুনের প্রথম সপ্তাহে সেতুতে বিদ্যুৎ সরবরাহের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া সেতুতে মার্কিং, সড়ক সংকেত এবং অন্যান্য যেসব কাজ বাকি ছিল সেগুলোর কাজও শুরু হয়েছে।
জানা গেছে, দ্বিতল এই সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন আর নিচ দিয়ে ট্রেন চলাচল করবে।
যদিও সেতুতে রেললাইনের কাজ এখনো শেষ হয়নি। পদ্মাসেতু দিয়ে যানবাহন চালু হওয়ার পর লাইন বসানোর জন্য রেল কর্তৃপক্ষকে সেতুটি বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
আগামী জুলাইয়ে সেতু কর্তৃপক্ষ রেল কর্তৃপক্ষকে সেতু বুঝিয়ে দেবে বলে জানা গেছে। আর সেতুর ওপর রেললাইন বসাতে ছয় মাসের মতো সময় লাগবে।
২০২৪ সালের দিকে সেতু দিয়ে রেল চলার কথা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় পদ্মাসেতু।
এরপর পর একে একে ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর।
যদিও দুই প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার।
সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদী শাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।
দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোমেন লিমিটেড। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হয়েছে এ সেতুটি।
বহুল আকাঙ্ক্ষিত পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলকারী যানবাহনের টোল নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, মোটরসাইকেলের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা, আর বড় বাসের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৪০০ টাকা।
সর্বোচ্চ টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ছয় হাজার টাকার বেশি।
ইতোমধ্যে সেতুর টোলও নির্ধারণ করেছে সরকার। এক সপ্তাহ আগে সেতু বিভাগের উন্নয়ন শাখার প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, উদ্বোধনের দিন থেকে এই টোল কার্যকর হবে।
সরকার নির্ধারিত টোল অনুযায়ী মোটরসাইকেল এবং বড় বাস ছাড়াও মাঝারি ধরনের বাসের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার টাকা, কার ও জিপের ৭৫০ টাকা, চার এক্সেল টেইলারের ৬ হাজার টাকা, মাইক্রো বাস ১৩০০ টাকা এবং মিনি বাসের (৩১ সিট বা তার কম) টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪০০ টাকা।
সেতু বিভাগের উপসচিব আবুল হাসান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপন থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, পিকআপ ভ্যান ১ হাজার ২০০ টাকা; মাইক্রোবাস ১ হাজার ৩০০ টাকা; ছোট বাস (৩১ আসন বা তার কম) ১ হাজার ৪০০ টাকা; মাঝারি বাস (৩২ আসন বা তার বেশি) ২ হাজার টাকা; বড় বাস (৩ এক্সেল) ২ হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এছাড়া ছোট ট্রাকের জন্য (৫ টন পর্যন্ত) ১ হাজার ৬০০ টাকা; মাঝারি ট্রাক (৫ থেকে ৮ টন পর্যন্ত) ২ হাজার ১০০ টাকা; মাঝারি ট্রাক (৮ থেকে ১১ টন পর্যন্ত) ২ হাজার ৮০০ টাকা; ট্রাক (৩ এক্সেল পর্যন্ত) ৫ হাজার ৫০০ টাকা; ট্রেইলার (৪ এক্সেল পর্যন্ত) ৬ হাজার টাকা এবং ট্রেইলার (৪ এক্সেলের অধিক) ৬ হাজার টাকার সঙ্গে প্রতি এক্সেলের জন্য ১ হাজার ৫০০ টাকা যুক্ত হবে।
সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সেতু উদ্বোধনের তারিখ নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই দ্রুত সময়ের মধ্যে উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণা করবেন বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে সেতুতে অর্থায়ন থেকে সড়ে দাঁড়ায় বিশ^ব্যাংক। এরপর নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।