দেশে দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটময় পরিস্থিতিতে বিদেশ থেকে বিলাসজাতপণ্য এবং অপিরাহার্য নয়-এমন পণ্য আমদানি বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করছে সরকার।
সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও সংকট মোকাবেলায় এ সময়ে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে বিলাসপণ্য এবং অপ্রয়োজনীয় ধরনের পণ্য আমদানি বন্ধের ব্যাপারে নির্দেশনা রয়েছে।
আর বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সতর্কতার পাশাপাশি ব্যয় সাশ্রয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সরকার।
এজন্য অপরিহার্য নয় এবং বিলাসজাতপণ্য আমদানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার পরিকল্পনা করছে সরকার।
এক্ষেত্রে কোনো কোনো পণ্যের আমদানি বন্ধ রাখা হবে সে বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, অর্থমন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) একযোগে কাজ করবে।
অর্থমন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিষয়টি নিয়ে গত রোববার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এবং সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার কার্যালয়ে এক বৈঠক করেছেন।
ওই বৈঠকে বিষয়টি কিভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
এর আগে গত সপ্তাহে মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে বিলাসীপণ্য আমদানি না করা এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা করার নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার বিষয়ে তখন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং সম্ভাব্য সংকট মোকাবেলায় করণীয় নির্ধারণে বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রীকে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
সম্ভাব্য বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সার্বিক অবস্থা বিশ্লেষণে বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
এছাড়া বিলাসীপণ্য এবং অপরিহার্য নয় এমন পণ্য আমদানি না করার বিষয়ে পরিকল্পনা করারও নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসায় সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আমদানি ব্যয় অনেকটা বেড়েছে।
আর রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়লেও আমদানি বৃদ্ধির হার বাড়তে থাকায় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ আগের বছরের তুলনায় কমতে থাকা পরিস্থিতিতে সরকার বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ ভোরের আকাশকে জানান, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এবং বিশ^ব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সতর্ক রয়েছে সরকার।
এজন্য বিলাসপণ্য এবং অপয়োজনীয় ধরনের পণ্য আমদানির মাধ্যমে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় না করার জন্য উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনা রয়েছে।
তবে বিষয়টি নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো এ বিষয়ে পর্যালোচনার কাজ করছে।
আর আমদানি বন্ধ করা হবে এমন পণ্যের তালিকা এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি বলে জানান তিনি।
এদিকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসায় এবং ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য ইতোমধ্যে সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক-বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণও স্থগিত করেছে সরকার।
এর আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছিলেন, বিশেষ প্রয়োজন হলে তবেই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিদেশ যাবেন, অন্যথায় কেউ যেতে পারবেন না।
প্রধানমন্ত্রী পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছেন, কোনো জরুরি প্রয়োজন না থাকলে বিদেশ সফর নয়।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রণালয় থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের জন্য গত ১২ মের জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, কভিড-১৯-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত সব ধরনের এক্সপোজার ভিজিট, স্টাডি ট্যুর ও ইনোভেশনের আওতাভুক্ত ভ্রমণ এবং ওয়ার্কশপ, সেমিনারে অংশগ্রহণসহ সব ধরনের বৈদেশিক ভ্রমণ বন্ধ থাকবে।
এ আদেশ উন্নয়ন বাজেট ও পরিচালন বাজেট-উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে এবং কার্যকর হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া সতর্কতার অংশ হিসেবে ব্যয় সাশ্রয়ে এর আগেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশে বিলাসজাতপণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে এলসি মার্জিনের হার বাড়িয়েছে।
অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণও সাম্প্রতিক সময়ে আরো বেড়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৯১ কোটি ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।
আর উক্ত সময়ে রপ্তানিতে ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও আমদানি বেড়েছে ৪৪ শতাংশ।
এ ছাড়া এই ৯ মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ এক হাজার ৫৩০ কোটি ডলার।
যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম।