প্রতারণার কত রূপ যে পাখা মেলেছে তা সামান্য কথায় বুঝানো মুশকিল। প্রতারকদের পাখার ঝঁপটা রাস্তাঘাট ছাড়িয়ে মানুষের ঘরের হাঁড়িতে ঢুকে পড়েছে। ‘ন্যায্য’ না পেয়ে নাজেহাল ভোক্তা সাধারণ। কোথাও একট-আধটুু দুর্বলতা বা একটুখানি ফাকঁ-ফোকর পেলেই প্রতারণার জালে জড়িয়ে পড়ছে সহজ-সরল মানুষ। করোনাকালীন দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ঘরে বসে থেকে মানুষের মধ্যে এক ধরণের অলসতা তৈরী হয়েছিল। সেই অলসতা থেকে এবছর রোজা ও ঈদের বাজারে ভীড়ের মধ্যে যেতে অনেকে পছন্দ করছেন না। তাই ই-কমার্সের চটকদার কমার্শিয়ালে প্রলোভিত হয়ে অনেকে ঘরে বসে কেনাকাটা করছেন। সেই সুযোগটা নিচ্ছে এক শ্রেণির জালিয়াত চক্র। সংবাদে এসেছে- দুই হাজার টাকা দামের টি-শার্টে ছয় হাজার টাকার ট্যাগ লাগিয়ে বিক্রি করা হয়েছে। যে জুতো ফুটপাতে দেড়শত টাকায় পাওয়া যায় সেটাকে বিদেশী দামী জুতো বলে বিক্রির জন্য প্রচার চালানো হয়েছে।
একসময় শুধু পঁচা মাছে ফরমালিন দিয়ে বিক্রি করা হতো। এখন নিত্যপণ্য তেল, চাল, শিশুখাদ্য, ফল, প্রসাধণী ছাড়িয়ে ব্যবহারের কাপড়, জামা-জুতো শাড়ির মধ্যে ভেজাল মেশানো হচ্ছে। এবারের ঈদের বাজারে পুষ্প শাড়ি, বেলাগন, কাঁচাবাদাম, লেহেঙ্গা নামে নানান বিদেশী তৈরী পোশাকে বাজার রমরমা হয়ে ওঠে যার অধিকাংশই নকল। জানা গেছে, ঐসব নামে আদতে কিছুই নেই, সবই প্রতারণা। যেসব দ্রব্যে সরাসারি ভেজাল মেশানো যায় না সেগুলোর কেনাকাটায় দামের মধ্যে বিস্তর প্রতারণার ফাঁদ পেতে মানুষকে ঠকানো হচ্ছে। মানুষে মানুষে আয়-বৈষম্য প্রকট হওয়ার কারণে ভোক্তা শ্রেণিতে চরম ভেদাভেদ লক্ষ্যণীয়। ফলে দেশে বাজাব্যবস্থার মধ্যে রকমফের তৈরী হয়েছে। হয়েছে পণ্যের গুণগত মানের তফাৎ। যাদের অবৈধ অর্থের যোগান আছে, যারা অফিস-আদালতে অপকর্ম, অনিয়ম, দুর্নীতি করে মোটা অঙ্কেও টাকা লোপাট করে বহু টাকার মালিক বনে গেছেন তাদের জন্য অধিক দামে পণ্য কেনা কোনো কঠিন বিষয় নয়। পণ্যের আসল মূল্য ছাড়িয়ে যত বেশী দরদাম হাঁকানো হোক না কেন, বেশী দামে কেনাকাটা করা তাদের জন্য কোন ব্যাপার নয়। সমস্যা সব আমজনতার, ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে কেবল সৎ, সাধারণ ও স্বল্প আয়ের মানুষকে।
আয়ের বৈষম্য থাকলে ভোক্তাদের মধ্যে ক্রয়ক্ষমতার পার্থক্য হবে। অবৈধ উপায়ে অর্থ আয় ও মানুষকে প্রতারণা করার কৌশলও বেড়ে যাবে। বিশেষ করে, বিক্রেতা শ্রেণি যখন দুর্নীতিবাজ, লোভী ও শঠ হয়ে ক্রেতাদের সাথে প্রতারণায় মেতে উঠে তখন বাজারের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার সকল কৌশল বিফলে যেতে বাধ্য। এভাবে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় শ্রেণি যখন জীবন-জীবিকার জন্য হতাশ তখন নিজেদের আইন, অধিকার ইত্যাদি নিয়ে ভাবার বা সচেতন হবার ফুরসৎ কোথায়?
সব সমস্যা যেন সাধারণ মানুষের জন্য। সীমিত আয়ের মানুষ বাজারে গিয়ে পণ্যের দামাদামি করে কেনাকাটা করেন। কিন্তু কিছু কিছু মার্কেটের ব্যবসায়ীরা এই দামাদামি করাটাকে পছন্দ করেন না। কেননা, সেসব ব্যবসায়ীরা অনেক ধনী। তাদের মানসিকতাও তেমনভাবে তৈরী হয়ে গেছে। এ ধরণের অনেক ব্যবসায়ী চান তাদের খদ্দের এসে পণ্য দেখে দাম না জিজ্ঞেস করেই টাকা ঢেলে দিয়ে পণ্য নিয়ে চলে যাবেন। এ ধরনের মানসিকতা আমাদের দেশে বহুদিন ধরেই চলে আসছে। বিশেষ করে প্রবাসী আয়ের বসতি এলাকাগুলোতে এই অভ্যাস মানুষকে গত কয়েক যুগ ধরে ভোগান্তিতে ফেলে আসছে। সেদিকে কারো কোনা ভ্রুক্ষেপ নেই। বিদেশে ‘ফিক্সড প্রাইসের’ দোকান গড়ে উঠলেও আমাদের দেশে সব জায়গায় সেরূপ দোকান নেই। বিশেষ করে কাঁচা বাজারে শুধু বড় শহরকেন্দ্রিক কয়েকটি দোকানে এই ব্যবস্থা থাকলেও সেটা কিছু বিশেষ ক্রয়-সুবিধাধারী মানুষের জন্য সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। সেখানেও ভেজাল।
কিছুদিন পূর্বে আমার এক বন্ধু চট্টগ্রামের এক কসাইয়ের স্টোর থেকে ফ্রজেন মাংস কিনে এনেছিলেন। যেখানে কোন তারিখ লেখা নেই। বাসায় এনে দেখা গেল, ফ্রজেন মাংসের মধ্যে মরা পোকা! অর্থাৎ, মেয়াদবিহীন পঁচন ধরা পোকাযুক্ত মাংস ডিপ ফ্রীজে রাখা হয়েছিল। নতুবা দীর্ঘসময় বিদ্যুৎ না থাকায় ফ্রীজের মাংস পচে গিয়েছিল। কারণ বরফ জমানো ঠান্ডার মধ্যে হঠাৎ এ ধরণের পোকা সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। বাসার কাজের মেয়ে মাংস কাটার সময় কোষের মধ্যে মরা পোকা দেখতে পেয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলে টনক নড়লো গৃহকর্ত্রীর! তারপর মাংস ক্রেতাকে বকাঝকা করা হলেও সবশেষে বিক্রেতার উপর দোষ গিয়ে পড়লো। নিরীহ ক্রেতাকে পঁচা জিনিস গছানোর জন্য বিক্রেতা যে কত কসরৎ ও ফন্দি-ফিকির করে থাকেন তা এখানে বলাই বাহুল্য। ভোক্তা সংরক্ষণ আইনে শাস্তির বিধান সামান্য জেল-জরিমানা অথবা সেটাও নানা অজুহাতে বলবৎ না হবার বিষয় জড়িত থাকায় ভেজাল ও পঁচা দ্রব্য বিক্রির ‘হীন’ প্রয়াস থামছে না।
সিলেটের কাঁচা বাজারের এক ঘটনা মনে পড়ে গেল। প্রায় দুই যুগ আগে সাস্টে থাকার সুবাদে একদিন মাংসের দোকানে গিয়েছিলাম। কসাইকে মাংসের কেজি কত দর জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি প্রশ্ন শুনেও না শোনার ভান করলেন। আবারো জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি কিছুক্ষণ নিরুত্তর থাকলেন। এই ফাঁকে আরেকজন ক্রেতা এসে ভিড় ঠেলে দর জিজ্ঞাসা না করেই উচ্চস্বরে দশ কেজি দিতে বললে কসাই তার দিকে মনোযোগ দিলেন। উক্ত ক্রেতা সব মাংস কিনে দ্রুত দাম দিয়ে চলে গেলেন। কিছু ভোক্তার এই আচরণ নিম্ন আয়ের ভোক্তাদেরকে কি পরিমাণ নাজেহাল করে দিতে পারে সেটা তাদের স্মরণে আস না। ফলে আমাদের দেশে আয় বৈষম্যের বিষয়টি মাথায় না নিয়ে শুধু বাজার মনিটরিং করে এবং জরিমানা করে কি কোন সুফল পাওয়া সহজ হবে?
আয়ের বৈষম্য থাকলে ভোক্তাদের মধ্যে ক্রয়ক্ষমতার পার্থক্য হবে। সমাজে এই অবস্থা বহুদিন বিরাজমান থাকলে কমদামী জিনিসের উদ্ভাবন ও বিক্রয় হবে। এছাড়া বেকারত্ব ও নিয়মিত উপার্জনহীন মানুষের মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেলে নকল ও ভেজাল দ্রব্য, ফুটপাতের দোকান ও স্বল্পমূল্যের ক্রেতাও বেড়ে যাবে। অবৈধ উপায়ে অর্থ আয় ও মানুষকে প্রতারণা করার কৌশলও বেড়ে যাবে। বিশেষ করে বিক্রেতাশ্রেণি যখন দুর্নীতিবাজ, লোভী ও শঠ হয়ে ক্রেতাদের সাথে প্রতারণায় মেতে উঠে তখন বাজারের দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার সকল কৌশল বিফলে যেতে বাধ্য। এভাবে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় শ্রেণি যখন জীবন-জীবিকার জন্য হতাশ তখন নিজেদের আইন, অধিকার ইত্যাদি নিয়ে ভাবার বা সচেতন হবার ফুরসৎ কোথায়?
আমাদের দেশে ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন তৈরী হয়েছে। কিন্তু সেই আইন সম্পর্কে মানুষ আজও অজ্ঞ ও উদাসীন কেন? তার উত্তর ব্যাপক দুর্নীতিবাজ ও সুবিধাভোগী শ্রেণির চাতুরীর ফলে আয়-বৈষম্য ও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ব্যাপক গরমিলের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত আটটি ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে পৃথিবীর বহু সভ্য দেশের মানুষ সচেতন। সেগুলা হলো- মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, তথ্য পাবার অধিকার, নিরাপদ পণ্য সেবা পাবার অধিকার, পছন্দের অধিকার, জানার অধিকার, অভিযোগ করার অধিকার ও প্রতিকার পাবার অধিকার, ভোক্তা অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার, সুস্থ পরিবেশের অধিকার। এর সবগুলোই মানুষের শিক্ষা, পছন্দমত কর্মসংস্থান ও পর্যাপ্ত আয়, সামাজিক নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত সচেতনতার ওপর নির্ভরশীল।
কিন্তু আমাদের দেশে এখনও পরিবারের সদস্যদের পেটের ভাত না থাকলেও ড্রইংরুম সাজিয়ে রাখার প্রতিযোগিতা করা হয়। যানজটে রাস্তায় গাড়ির চাকা না ঘুরলেও কিছু মানুষ দামী গাড়ি নিয়ে জ্যামে বসে তেল পোড়াতে ভালবাসে। কেউ গাড়ি নিয়ে বের হয়ে দিনভর জ্যামে আটকা থেকেও কোনমতে শীতাতপ বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করতে পছন্দ করে। অথচ সিংহভাগ মানুষ ফুটপাতে ভেজাল দ্রব্য কিনে নিত্য প্রতারিত হয়। বিশুদ্ধ পানি পানের অভাবে এখনও ডায়রীয়া-কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায় অনেকে। দেশে গত ২০২২ মার্চমাসে করোনার প্রকোপ না থাকলেও আইসিডিডিআরবি’র হিসাবমতে গত ষাট বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে একমাসে ৫০ হাজারেরও বেশী রোগী ভর্তি হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। এছাড়া সরকারী মতে তিনজনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও কলেরা হাসপাতালে নেয়ার পথেই ২৯ জন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। যা করোনার ভয়াবহতাকে হার মানিয়েছে।
জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত আটটি ভোক্তা অধিকার বিষয়ে শুধু বলা যায়- আমার একবেলাও খাবার পছন্দের অধিকার নেই। কারণ, ক্রয়ক্ষমতা আমার সীমিত অথবা নেই। বাসায় সুপেয় পানি সরবরাহ নেই, বস্তিতে থাকি তাই সেখানে থাকার পরিবেশও নেই। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ করতে চাইলে আমার করণীয় কি? আমি তো রুগ্ন, অসহায়। এ অবস্থায় আমি কোনো ভেজাল পণ্য কিনে প্রতারিত হলে অভিযোগ করব কোন সংস্থা বা কার কাছে? কোন তথ্যই তো আমি জানি না, বাস করি বড় শহরের বস্তিতে অথবা অজ পাড়াগাঁয়ে। সেজন্য কেউ কোনদিন আমাকে আমার ভোক্তা অধিকার বিষয়ে শেখাতেও আসেনি। আমার এর চেয়ে আর বেশী কিছু কি ভাববার বা বলবার উপায় আছে? এখন প্রতারিত হয়ে ভেজাল খেয়ে যে কয়দিন বেঁচে থাকা যায় সেটাই যেন ভোক্তার চরম নিয়তি! আধুনিক যুগে সচেতন মানুষকে এমনটা ভাবতে হবে কেন?
লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন