logo
আপডেট : ২৫ মে, ২০২২ ১০:০৩
খুলছে পদ্মার দ্বার
সেতু উদ্বোধন ২৫ জুন
রাজন ভট্টাচার্য

খুলছে পদ্মার দ্বার

আরেকটি সুখবর। আরো একটি নতুন মাইলফলক স্পর্শ করতে যাচ্ছে দেশ। অপেক্ষার পালা শেষ। দ্বার খুলছে পদ্মা সেতুর। একের পর এক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে বহুল কাঙ্ক্ষিত এই সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে আগামী ২৫ জুন। দেশের ইতিহাসে যোগাযোগ খাতের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্পটি চালুর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সড়ক ও রেল যোগাযোগে প্রবেশে বাংলাদেশ আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। উদ্বোধনের পরই যানবাহন চলাচলে সেতুর সড়কপথ খুলে দেওয়া হবে। আর ২০২৪ সালে সেতু দিয়ে শুরু হবে ট্রেন চলাচল।

-উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

-দুই পাড়ে উচ্ছ্বাস

-সরাসরি উপকৃত হবে ৩ কোটি মানুষ

-আন্তর্জাতিক সড়ক ও রেল যোগাযোগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ

-দেশে দীর্ঘ, বিশ্বে ১১তম

-আয় থেকে ঋণের টাকা পরিশোধ

-কর্মসংস্থান হবে কোটি মানুষের

-জিডিপিতে অবদান রাখবে ১ দশমিক ২৬ শতাংশ

-আমন্ত্রণ পাচ্ছে বিএনপিও

মঙ্গলবার (২৪ মে) সেতু উদ্বোধনের খবর প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উল্লাস প্রকাশ করেন গোটা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। সুখবর পেয়ে কোথাও কোথাও মিষ্টি বিতরণ পর্যন্ত হয়েছে। সেতু চালুর মধ্য দিয়ে সরাসরি উপকার হবে ২১ জেলার মানুষের। তাইতো স্থানীয় মানুষের যেন আর তর সইছে না। অপেক্ষার প্রহর কতটা দীর্ঘ তা সাধারণ মানুষের আকুতি থেকেই স্পষ্ট হয়েছে।

এদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচলের মধ্য দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের চলাচলের পথ সুগম হবে। সময় বাঁচবে তিন ঘণ্টার বেশি। দূরত্ব কমবে ৭০ থেকে শত কিলোমিটার পথের। সরাসরি উপকৃত হবে তিন কোটির বেশি মানুষ।

এছাড়াও সেতু চালুর মধ্য দিয়ে বাড়বে জিডিপি। দারিদ্র্য কমবে ১ দশমিক ৯ শতাংশ হারে। সেইসঙ্গে বাড়বে কর্মসংস্থান ও বিদেশি বিণিয়োগ। সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাই শহরের আদলে গড়ে তোলার হবে পদ্মা আশপাশের এলাকা। প্রায় কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে পদ্মার দুই পাড়ের নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে; এমন প্রত্যাশা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের।

২৫ জুন দ্বার খুলছে পদ্মার : বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে আসছে ২৫ জুন। সেদিন সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন। আর এ সেতুর নাম পদ্মা নদীর নামেই হবে বলে সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন।

পদ্মা সেতুর উদ্বোধন এবং নামকরণের বিষয়ে সারসংক্ষেপ নিয়ে মঙ্গলবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গণভবন যান ওবায়দুল কাদের। বেরিয়ে এসে অপেক্ষমাণ সাংবদিকদের তিনি বলেন, ‘বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু, সেটা কবে উদ্বোধন হবে জানার আগ্রহ সবার মধ্যে। সেই সুসংবাদ আপনাদের দিচ্ছি। ২৫ জুন শনিবার সকাল ১০টায় বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী, দেশরত্ন শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন করবেন।’ সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে প্রশ্ন করলে মন্ত্রী বলেন, ‘সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হবে, যারা বেশি বিরুদ্ধে বলছে, তাদেরকে আগে আমন্ত্রণ জানানো হবে।’

দেশে দীর্ঘ, বিশ্বে ১১তম : বিশ্বের দীর্ঘতম সেতুর তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে চীনের ডেনইয়াং কুনশান গ্র্যান্ড ব্রিজ। চীনের জিয়াংসু প্রদেশের সাংহাই ও নানজিং এলাকায় দীর্ঘতম সেতুটি অবস্থিত। চীনের ইয়াংজি নদীর ওপর ব্রিজটি স্থাপিত। সেতুর সঙ্গে রয়েছে রেললাইনও। সেতুটির দৈর্ঘ্য ১৬৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। ২০১০ সালে সেতুটি উদ্বোধন করা হয়। সেতুটিতে খরচ হয় ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। পৃথিবীর বৃহত্তম সড়ক সেতুগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বাস্তবায়নাধীন পদ্মা সেতুর অবস্থান ১১তম। তবে নদীর ওপর প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, বিশ্বের শক্তিশালী সেতুগুলো সাধারণত ‘সি’ আকৃতির হয়। কিন্তু নদীর অবস্থানের কারণে ওপর থেকে দেখলে পদ্মার নির্মাণ হয়েছে ‘এস’ আকৃতির। পদ্মার লাইফ টাইম ধরা হয়েছে শত বছর। এই সময়ে বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে সেতুর বড় রকমের কোনো মেরামতের প্রয়োজন হবে না। নতুন করে রং করা, প্রয়োজনে নাট-বল্ট টাইট দেওয়া, ঝালাই কাজ প্রয়োজন হতে পারে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের ইতিহাসে যোগাযোগ খাতের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্পটি রেললাইন থেকে সড়ক পথের উচ্চতা ৪০ ফুট।

আয় থেকে ঋণের টাকা পরিশোধ : নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হলেও এর ব্যয়ের টাকা ঋণ হিসেবে সেতু কর্তৃপক্ষকে দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। পদ্মা সেতুর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সেতু কর্তৃপক্ষ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ নিজেদের আয়ে চলবে প্রতিষ্ঠানটি। পদ্মা সেতুর জন্য নেওয়া ঋণ ১ শতাংশ সুদসহ ৩৫ বছরে ফেরত দিতে হবে সেতু কর্তৃপক্ষকে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করার উল্লেখ রয়েছে। এখন পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপান সরকারের ঋণ মওকুফ তহবিলের অর্থ ৩০০ কোটি টাকা। এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। ফলে প্রায় ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়কে ফেরত দিতে হবে। এর সঙ্গে বাড়তি ১ শতাংশ হারে সুদ ধরলে মোট পরিশোধ করতে হবে ৩৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, চুক্তি অনুসারে প্রথম বছরই সেতু বিভাগকে ৬০০ কোটি টাকা কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। এই সময়ে টোল থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। আয় থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে।

সড়কেও টোল লাগবে : পদ্মা সেতুর বাইরে ঢাকার পোস্তগোলা বা বাবুবাজার থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে (ছয় লেনের দ্রুতগতির সড়ক) ব্যবহারের জন্যও টোল দিতে হবে। সেতু চালুর পর টোল আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। পরিকল্পনা অনুযায়ী এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারের জন্য একটি বাসে প্রতি কিলোমিটারে ৯ টাকা হারে টোল দিতে হবে। মাঝারি একটি ট্রাকের টোল হবে প্রতি কিলোমিটারে ১০ টাকা। বর্তমানে এই পথে তিনটি সেতুর জন্য একটি বড় বাসে গড়ে ২০০ টাকা টোল দিতে হয়। সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিদেশি অর্থায়নে সেতু নির্মাণ করা হলে কত টাকা টোল ধার্য করা উচিত, সে বিষয়ে দাতাদের শর্ত বা পরামর্শ থাকে। কিন্তু দেশীয় অর্থায়নে নির্মিত সেতুর ক্ষেত্রে এ রকম কোনো নীতিমালা নেই। সাধারণত সেতু হওয়ার আগে ফেরিতে যে হারে টোল নেওয়া হয়, সেতুতেও সেই হারে টোল নির্ধারণ করে থাকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)।

সেতু ব্যবহারে টোল: পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে চলতে হবে টোল দিয়ে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, মোটরসাইকেলের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ টাকা, আর বড় বাসের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৪০০ টাকা। সর্বোচ্চ টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ হাজার টাকার বেশি। সরকার নির্ধারিত টোল অনুযায়ী মোটরসাইকেল এবং বড় বাস ছাড়াও মাঝারি ধরনের বাসের টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার টাকা, কার ও জিপের ৭৫০ টাকা, চার এক্সেল টেইলারের ৬ হাজার টাকা, মাইক্রো বাস ১ হাজার ৩০০ টাকা এবং মিনিবাসের (৩১ সিট বা তার কম) টোল নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৪০০ টাকা। সেতু বিভাগের উপসচিব আবুল হাসান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপন থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
সেতুর শেষ মুহূর্তে পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি বিষয়ে জানতে চাইলে সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মো. আবদুল কাদের বলেন, ইতোমধ্যে সেতুর ৯৮ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। উদ্বোধনের প্রস্তুতি হিসেবে বাকি কাজ চলমান। সেতুতে রোড মার্কিং, আলোকিত করা এবং উদ্বোধনের কাজ বাকি। এছাড়া দুই পাশে দুটি ম্যুরাল হবে। একটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, অন্যটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত টোলহার সেতু চালুর ১৫ বছরের জন্য প্রযোজ্য হবে। প্রতি ১৫ বছর পরপর টোলের হার ১০ শতাংশ করে বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। সেতুর নকশা করেছে আমেরিকান মাল্টিন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্ম এইচসিওএম নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

নানা বাধা-বিপত্তি : বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ওই বছরের ২৮ আগস্ট ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করেছিল। পরে আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাব্য তারিখ ধরা হয়েছিল ২০১৩ সাল। প্রকল্পের অর্থ ঋণ হিসেবে জোগান দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পাঁচটি সংস্থা।

এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। আর জাইকার দেওয়ার কথা ছিল ৪১ দশমিক ৫ কোটি ডলার। কিন্তু বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ২০১২ সালের ২৯ জুন অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়। বিশ্বব্যাংক আর্থিক সহযোগিতা থেকে সড়ে দাঁড়ানোর পর ২০১২ সালের ১০ জুলাই জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের মূল সেতুর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন। নির্মাণ শেষে পদ্মা সেতু জিডিপিতে ১ দশমিক ২৬ শতাংশ অবদান রাখবে বলে আশা করছেন সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন।